Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Wildlife Tourism – Blackbuck National Park

বন্যপ্রাণ পর্যটন – কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যান

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Wildlife Tourism – Blackbuck National Park । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বন্যপ্রাণ পর্যটনের প্রেক্ষাপটে গুজরাটের বেলাবদরের ‘কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যান’ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Wildlife Tourism - Blackbuck National Park
কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যান, বেলাবদর, গুজরাট

বর্তমান সময়ে পর্যটন যেকোনো সমাজ ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। একেবারে সহজ কথায়, বিনোদন, অবসরযাপন, জ্ঞানার্জন প্রভৃতির উদ্দেশ্যে কোনো স্থানে ভ্রমণকে পর্যটন (Tourism) বলে। প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য অনুসারে পর্যটন বিভিন্ন প্রকারের হয়, যার একটি হল বন্যপ্রাণ পর্যটন (Wildlife Tourism)। প্রাকৃতিক আবাসস্থলে কোনো অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জীবনশৈলী পর্যবেক্ষণ এবং মিথস্ক্রিয়া কেন্দ্রিক পর্যটনকে, বন্যপ্রাণ পর্যটন বলে। রাষ্ট্রসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) এর মতে, বর্তমানে (২০২১) বিশ্ব পর্যটনের ০৭%-ই বন্যপ্রাণ পর্যটন এবং বর্তমানে প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বন্যপ্রাণ পর্যটনের কর্মে নিযুক্ত রয়েছেন। ভারত ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে অনন্য এবং একই সাথে একটি বৃহৎ জীববৈচিত্র্য (Mega Biodiversity)-এর দেশ। ভারতে বিশ্বের সমস্ত সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতির ৬%, সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রজাতির ৭.৬%, সমস্ত পক্ষী প্রজাতির ১২.৬%, সমস্ত সরীসৃপ প্রজাতির ৬.২%, সমস্ত মৎস্য প্রজাতির ১১.৭% ও সমস্ত উভচর প্রজাতির ৪.৪% পাওয়া যায়। যা থেকে সহজেই অনুমেয়, পর্যটনের বিকাশে ভারতে বন্যপ্রাণ পর্যটনের ভূমিকা ও সম্ভাবনা কতখানি উল্লেখ্যযোগ্য। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রধানত সংরক্ষিত জীবমন্ডল (Biosphere Reserve), জাতীয় উদ্যান (National Park), বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য (Wildlife Sanctuary), জীববৈচিত্র্য উদ্যান (Biodiversity Park) প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে বন্যপ্রাণ পর্যটন গড়ে উঠেছে। গুজরাটের বেলাবদর (Velavadar) -এ অবস্থিত ‘কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যান’ (Blackbuck National Park) হল ভারতের একটি জাতীয় উদ্যান, যা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও পর্যটনে বিশেষ খ্যাত।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পর্যটন – বাঁকুড়ার বিহারীনাথ পাহাড়

ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকে এই জাতীয় উদ্যানটি গুজরাটের সৌরাষ্ট্র বা কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপের ‘ভাল’ (Bhal) অঞ্চলের অন্তর্গত। প্রশাসনিক ভাবে, গুজরাট রাজ্যের ভাবনগর জেলা (Bhavnagar District) -এর বল্লভিপুর ও ভাবনগর তালুকের অন্তর্গত। বেলাবদরে অবস্থিত কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যান হল কৃষ্ণসার হরিণের সংখ্যা অনুসারে, ভারত তথা পৃথিবীর বৃহত্তম কৃষ্ণসার হরিণ সংরক্ষিত অঞ্চল (Largest Protected Area of Blackbuck in the World by Number)। প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল ভাবনগরের মহারাজাদের চিতা ও কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের তৃণভূমি, যার স্থানীয় নাম ‘বিডি’ (Vidi)। ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার এটিকে ‘জাতীয় উদ্যান’ রূপে ঘোষণা করে, যার বর্তমান আয়তন ৩৪.০৮ বর্গকিমি। উত্তরে কৃষিজমি ও পতিতভূমি এবং দক্ষিণে খাম্বাত উপসাগরের উপকূল ঘেরা এই জাতীয় উদ্যানটি উপ-শুষ্ক জীব-ভৌগোলিক অঞ্চলের গুজরাট-রাজওয়াড়া (Gujarat-Rajwada) জৈব অঞ্চলের অন্তর্গত। রিমোট সেনসিং অধ্যয়ন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জানা যায়, এই জাতীয় উদ্যানের ৭.৫৭ বর্গকিমি এলাকা ঘন তৃণভূমি, ৯.৯১ বর্গকিমি এলাকা বিক্ষিপ্ত তৃণভূমি, ৫.০৫ বর্গকিমি খেজরি ঝোপঝাড়, ৫.১৩ বর্গকিমি লবণাক্ত ভূমি ও ৫.০৮ বর্গকিমি জোয়ারের কাদাক্ষেত্র। এই জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে পার্ভালিয়া (Parvalia) ও আলাং (Alang) নামে দুটি নদী প্রবাহিত হয়ে খাম্বাত উপসাগর (Gulf of Khambhat) -এ পতিত হয়েছে। বেলাবদরে কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যান যেন প্রকৃতির এক অন্য রাজ্য। দিগন্তবিস্তৃত সাভানা তৃণভূমি (Savannah Grassland)। পাকা গমের রঙের মতো কোমর সমান উঁচু ঘন ঘাস, মাঝে মাঝে খেজরি-বাবলা গাছ যেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তারই মাঝে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণসার হরিণ। কখনো কখনো প্রবল হাওয়া ঢেউ তুলছে তৃণভূমিতে। এক অসীম নীরবতার মাঝে শিকারী পাখির চিৎকার আর ভীরু কৃষ্ণসার হরিণের ছোটাছুটি।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পর্যটন – রায়দিঘির জটার দেউল

এই জাতীয় উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ হল কৃষ্ণসার হরিণ (বৈজ্ঞানিক নাম Antilope cervicapra)। প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণসার হরিণ কোনো হরিণ (Deer) নয়, একপ্রকার অ্যান্টিলোপ (Antilope)। বর্তমানে ভারত ও নেপালের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে টিকে থাকা এই দৃষ্টিনন্দন প্রাণীটি ‘ভারতীয় অ্যান্টিলোপ’ (Indian Antelope) নামেও পরিচিত। পুরুষ কৃষ্ণসার হরিণের দেহের উপরের দিক গাঢ় বাদামি থেকে কালো রঙের এবং নিচের দিক সাদা রঙের হয়। মুখমন্ডলের চিবুক অংশে এবং চোখের চারপাশে সাদা রঙের বলয় দেখা যায়। মাথায় ১৪-৩০ সেমি লম্বা, ঘোরালো ঘোরালো, পিছন দিকে বাঁকানো একজোড়া শিং থাকে। পুরুষ কৃষ্ণসার হরিণ প্রায় ১২০ সেমি লম্বা, ৭৪-৮৪ সেমি উঁচু ও গড়ে ৩৫-৪৫ কেজি ওজনের হয়। অন্যদিকে, স্ত্রী কৃষ্ণসার হরিণের দেহের উপরের দিক হালকা হলদে-বাদামি রঙের এবং নিচের দিক সাদা রঙের হয়। এদের কখনো শিং থাকে আবার থাকেনা। স্ত্রী কৃষ্ণসার হরিণ তুলনায় কম ওজনের হয়, গড়ে ২০- ৩৫ কেজি। ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে এই জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৬০০০ কৃষ্ণসার হরিণ রয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো সংরক্ষিত অঞ্চলে এতো বেশি সংখ্যক কৃষ্ণসার হরিণ নেই। ভীরু, নিরীহ এই কৃষ্ণসার হরিণ দলে দলে বিচরণ করে। সামান্যতম বিপদের আভাস পেলেই সুন্দর গঠনশৈলীর কৃষ্ণসার হরিণ লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। দৌড়ানোর সময় এরা হঠাৎ স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে পুরো শরীরটা শূন্যে ছুঁড়ে দেয়, যা মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য।

তবে এই জাতীয় উদ্যানে কৃষ্ণসার হরিণ ছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রকার বন্যপ্রাণী রয়েছে। নীলগাই, সম্বর হরিণ, নেকড়ে, হায়েনা, শিয়াল, জংলি বিড়াল, খরগোশ, বন্য শূকর প্রভৃতির পাশাপাশি এই জাতীয় উদ্যানে স্যান্ডগ্রাউজ, বুশচ্যাটস্, লেসার ফ্লোরিকান সহ বিভিন্ন প্রকার পক্ষী প্রজাতি রয়েছে। উল্লেখ্য, বেলাবদর তৃণভূমি হল হ্যারিয়ার (Harrier) পরিযায়ী পাখির ৩ টি প্রজাতি (Marsh Harrier, Pallid Harrier ও Montagu’s Harrier) -এর অন্যতম বৃহৎ বিশ্রামক্ষেত্র। কৃষ্ণসার হরিণের প্রজনন ঋতুর কারণে প্রতিবছর ১৫ ই জুন থেকে ১৫ ই অক্টোবর পর্যন্ত এই জাতীয় উদ্যান বন্ধ থাকেডিসেম্বর থেকে মার্চ হল এই জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের সেরা সময়। এসময় এখানে হ্যারিয়ার, ঈগল সহ অনেক পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। আর বেলাবদর তৃণভূমিতে কৃষ্ণসার হরিণ সহ বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার সেরা ঠিকানা হল ‘কালিয়ার ভবন’ (Kaliyar Bhavan), যা এই জাতীয় উদ্যানের ভেতরে অবস্থিত ফরেস্ট গেস্ট হাউস। এই জাতীয় উদ্যানে ভারতীয়দের প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা, ফোটোগ্রাফি চার্জ অতিরিক্ত। এছাড়া গাড়ি, ক্যামেরা এবং গাইড চার্জ দিয়ে এই জাতীয় উদ্যানে সাফারি করার ব্যবস্থাও রয়েছে। উল্লেখ্য, আমেদাবাদ থেকে ১৪৫ কিমি ও ভাবনগর থেকে ৫০ কিমি দূরে বেলাবদরে কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যানটি অবস্থিত। তাই, শুধু গির-সোমনাথ-কচ্ছ নয়, কৃষ্ণসার হরিণের বিচরণভূমি এই জাতীয় উদ্যানও আপনার গুজরাট পর্যটনের তালিকায় ঠাঁই পেতে পারে। (Wildlife Tourism – Blackbuck National Park)

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]

কিভাবে যাবেন? কলকাতা থেকে আকাশপথে বা রেলপথে আমেদাবাদ। আমেদাবাদ থেকে সড়কপথে ঢোলকা-বারণা-পিপলি-ঢোলেরা-বাভলিয়ারি হয়ে ৩-৪ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন বেলাবদরে অবস্থিত কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যানে।

কোথায় থাকবেন? ‘কালিয়ার ভবন’-ফরেস্ট গেস্ট হাউস হল সেরা ঠিকানা। এখানে থাকতে হলে আগেভাগে বুকিং করতে হবে। যোগাযোগ: অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর, বেলাবদর, ব্ল্যাকবাক ন্যাশনাল পার্ক। এছাড়াও জাতীয় উদ্যান থেকে স্বল্প দূরত্বে রয়েছে বিলাসবহুল ‘দ্য ব্ল্যাকবাক লজ’।

লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Gujarat Tourism; UNWTO; সাপ্তাহিক বর্তমান; The Indian Express; Official Website of Bhavnagar District, Gujarat; The Hindu

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবনের মাতলা নদী

9 thoughts on “Wildlife Tourism – Blackbuck National Park

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!