Tuesday, July 29, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Tusu Festival of Rarh Region

রাঢ় অঞ্চলের টুসু উৎসব

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Tusu Festival of Rarh Region । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের টুসু উৎসব সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Tusu Festival of Rarh Region
টুসু উৎসব, রাঢ় অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গ

কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সেই তেরো পার্বণের এক পার্বণ হল পৌষ পার্বণ। আর পৌষ পার্বণে রাঢ় বাংলায় টুসু উৎসব (Tusu Festival) উদযাপন হয়। টুসু উৎসব হল কৃষিভিত্তিক এক গ্রামীণ লোক উৎসব। টুসু উৎসব মূলত ভারতের তিন রাজ্যের কিছু অংশে সাড়ম্বরে পালিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা ; ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা, ধানবাদ, রাঁচি, হাজারিবাগ জেলা এবং উড়িষ্যার কেওনঝাড় ও ময়ূরভঞ্জ জেলা। গবেষক ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে, তাই এই দেবীকে ‘তুষু দেবী’ নামেও অভিহিত করা হয়। (Tusu Festival of Rarh Region)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : আলফা, বিটা ও গামা বৈচিত্র্য

টুসু দেবী মূলত লৌকিক কুমারী দেবী। শারদীয়াতে যেমন আমরা দেবী উমাকে কন্যা হিসেবে দেখে থাকি, তেমনই পৌষালি শীতে টুসু দেবীকে বাড়ির কন্যা হিসেবে কল্পনা করা হয়। যেহেতু টুসু দেবী কুমারী দেবী, তাই এই পূজার প্রধান উদ্যোক্তা ও ব্রতী হয় গ্রামবাংলার কুমারী মেয়েরা। টুসু দেবীর পূজা মূলত মহিলাকেন্দ্রিক। পুরোহিতের কোনও বালাই নেই। আচার উপাচারও নামমাত্র। এই পূজায় মূলত কুড়মি, মাহাতো, মুন্ডা, ভূমিজ, লোধা, বাগাল, কোড়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সব বয়সের রমণীরা যোগদান করেন। রাঢ় বাংলার প্রান্তিক জনজাতি সমাজে টুসু দেবীকে বাড়ির আদরিনী কন্যা ‘টুসুমণি’ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। তাই, টুসুমণির উদ্দেশ্যে গাওয়া হয় —

‘টুসু, কি শাড়ি চাই গো দকানে।
যেটি লাগে তর মনে।।
হরেক রকম সায়া শাড়ি
বেলাউজ্ নাই দকানে।।
কলকাতা গেলে ইবার দিব গ বেলাউজ কিনে।
পয়সা দিতে হবে নাই গ দিব গ অন্যে দিনে।।’
[টুসু গান : ঝাড়গ্রাম জেলার লোহামিল্যা গ্রাম থেকে সংগৃহীত]

টুসু উৎসব ৪ টি ধাপে পালিত হয়, যথা : স্থাপন, পালন, জাগরণ ও বিসর্জন। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন স্নান করে ঘরে ঘরে মেয়েরা ‘টুসুমণির’ স্থাপন করে। নিরালা ঘরের এক কোণে বা কুলুঙ্গিতে একটি মাটির সরা ও বাঁশের তৈরি ডালা ধানের তুষ ও গোবরের গোলা সহযোগে স্থাপন করা হয়। দেওয়ালে ও মেঝেতে আলপনা দেওয়া হয়। সরার ওপর রাখা গোবরের গোলাকে দূর্বা, হলুদ ফুল (গাঁদা, সরষে) ছড়িয়ে হলুদ জলে ডোবানো একটুকরো কাপড় দিয়ে ঢেকে ধান, দূর্বা, ফুল, মালা, হলুদ টিপ লাগিয়ে টুসুদেবী জ্ঞানে পূজা করা হয়। স্থাপন পর্বের মুখ্য অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় হয়, সব বয়সের মহিলারা, বিশেষত ছোট মেয়েরা টুসু দেবীর কাছে প্রদীপ জ্বালায়। ফুল-মালা দিয়ে সাজায়। টুসু দেবীর উদ্দেশ্যে মুড়ি, বাতাসা, গুড়, সাধ্যমত নৈবেদ্য নিবেদন করে। তারপর শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে টুসু গান। যা টুসু উৎসবের মূলমন্ত্র।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : গোয়ার খজান কৃষি

স্থাপনার গান:
‘উঠ উঠ উঠ তুষু, উট করাতে আস্যেছি,
তোমার সব সখি মোরা পা তলাতে বস্যেছি,
চাঁদকে যেমন তারায় ঘেরে তেমন ঘেরণ ঘেরেছি।’
[সংগৃহীত টুসু গান]

টুসু পরবের দ্বিতীয় পর্ব হল পালন। যা চলে সারা পৌষ মাস জুড়ে, প্রতি সন্ধ্যায় মেয়েরা দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীকে ফুল দিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে গান শুরু করে। এই গানের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। কারও কোনো গান মনে পড়লে শুরু করে, তাতে সবাই গলা মেলায়। গান শুনিয়ে শুনিয়ে টুসুকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর ঘুমোতে যায় ব্রতীরা।

পালনের গান:
‘টুসু নাই যাব শ্বশুরার দেশে,
ওগো মোর ছোট ননদ নাই ভালবাসে,
শাশুড়ি বলে ভোরে উঠ,
ননদ বলে ধান কুট,
বুড়া শ্বশুর আগে মরু,
হুকা টানে ভুরু ভুরু,
রাত হলে খকর খকর কাশে।’
[টুসু গান : ঝাড়গ্রাম জেলার লোহামিল্যা গ্রাম থেকে সংগৃহীত]

টুসু গানই হল টুসু উৎসবের মূল আকর্ষণ। এক-দুই কলির ছোটো ছোটো এই গান তৈরি হয় গ্রামের রমণীদের মুখে মুখে। টুসুগানে গ্রাম্য মহিলাদের ভাবাবেগ থাকে। সাংসারিক সুখ-দুঃখ, মনের কথা, মেয়েলি কলহ, ঈর্ষা, ভালোবাসা, এছাড়াও সমকালীন রাজনীতির কথা ব্যাপকভাবে এই গানে প্রভাব বিস্তার করে। টুসু গানে পণপ্রথা, বেকারত্ব, বধূ নির্যাতন প্রভৃতি সামাজিক বিষয়ও উঠে আসে। যেমন টুসুগানের পরিচিত গীতিকার রাখহরি মাহাতোর আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেলপথ নিয়ে লেখা একটি টুসু গান হল — ‘আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেলপথের কথা টুসু বইলতে যাবেক কইলকাতা/এত যে মন্ত্রী-নেতা কেউ শুনে না টুসুর কথা/মিটিং-মিছিল কত হইল সই দিল খাতা খাতা/বান্দোয়ান-আদ্রা পদযাত্রায় টুসুর হৈল পা ব্যথা/মকরবাসী বইলছে টুসু হাঁইটব দিল্লি কইলকাতা/ অনশনে বইসব শেষে না হইলে লাইন পাতা’

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – ইকোটোন ও এজ ইফেক্ট

টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ তিন দিন যথাক্রমে চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং পয়লা মাঘ আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে ঘরদোর পরিষ্কার করে চালগুঁড়ি তৈরি করা হয়। বাঁউড়ির দিন বিভিন্ন রকম পিঠে তৈরি করা হয়। এই বাঁউড়ির রাত হল টুসু দেবীর ‘জাগরণ’। টুসু দেবী জ্ঞানে যে পাত্র পূজা করা হয়, বাঁউড়ির দিন ওই পাত্র ফুল দিয়ে সাজানো হয়। কেউ কেউ ওইদিন টুসু পুতুল কিনে আনেন, যাকে ওই টুসু সরার কাছেই বসানো হয়। ঘিয়ের বাতির প্রদীপ জ্বালানো হয়। জাগরণের দিন সারারাত টুসুকে গান শুনিয়ে জাগিয়ে রাখা হয়। একটানা চলতে থাকে গানের লহরা। যেন তাদের আদরিনী কন্যা ‘টুসুমণি’ পরের দিন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। মকর সংক্রান্তির আনন্দ হিল্লোলের মাঝেও যেন তাদের মন কেঁদে ওঠে, বিদায় ব্যথা জেগে ওঠে তাদের গানে —

‘শুশনি শাক বড় বড় শিমুলতলাতে,
বড় দিদির খুঁটে ধরে কত তুষু কেঁদেছে,
কেঁদো না কেঁদো না তুষু আবার আসবে পৌষ মাসে।’
[তুষু ব্রত ও গীতি সমীক্ষা – রবীন্দ্রনাথ সামন্ত]

টুসু উৎসবের অন্তিম পর্ব হল বিসর্জন, যা ভাসান নামে পরিচিত। এই পর্ব সত্যিই খুব বেদনাদায়ক। পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের দিন ভোর বেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে টুসু দেবীকে বাঁশ বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী, খাল, পুকুর বা যে কোনো জলাশয়ে নিয়ে যায় গান গাইতে গাইতে। নদী বা পুকুরের ঘাটেও চলে গান। টুসুকে জলে নিয়ে নেমে যাওয়ার পরেও চলতে থাকে গান —

‘তিরিশ দিন রাখলাম মাকে তিরিশ সলতা জ্বেলে গো,
আর রাখতে নারলাম যে মকর আইচে লিতে গো।
এসেছ মকর বেশ করেছো তুষু রাখবে যতনে,
আবার মোরা লিতে যাবো পৌষ মাসের প্রথমে।।’
[সংগৃহীত টুসু গান]

এরকম বিভিন্ন গান গাইতে গাইতে টুসুকে জলে ভাসিয়ে ডুব দিয়ে স্নান করে। তারপর পাড়ে উঠে নতুন বস্ত্র পরিধান করে এবং ছেলেরা খড়-কাঠ দিয়ে ম্যাড়াঘর বানিয়ে তাতে আগুন লাগায়। এভাবেই টুসু উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

টুসু উৎসব উপলক্ষ্যে রাঢ় বাংলার শিলাই, কাঁসাই সহ ছোটোবড়ো নানা নদীর ধারে মেলা বসে, যেখানে গ্রামের মানুষ আসে এবং আনন্দে মেতে ওঠে। এই মেলায় জিলিপি, পাঁপড়, বিভিন্ন রকমের মিষ্টি থাকে অন্যতম লোভনীয় খাবার। টুসু শুধুমাত্র একটি লোক উৎসব নয়, টুসু উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। এই মেলাগুলিতে কেনাবেচার মাধ্যমে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের আর্থিক উন্নতিও ঘটে। (Tusu Festival of Rarh Region)

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]

লেখিকাঃ- সোনালী দন্ডপাট (মানিকপাড়া, ঝাড়গ্রাম)
তথ্যসূত্রঃ- বঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য পরিচয় (সন্তোষ কুমার পড়্যা) ; স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে লেখিকা কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : এশিয়ার পরিষ্কারতম নদী ডাউকি

7 thoughts on “Tusu Festival of Rarh Region

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!