Monday, July 28, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Tourism – Jatar Deul of Raidighi

পর্যটন – রায়দিঘির জটার দেউল

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Tourism – Jatar Deul of Raidighi । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ‘জটার দেউল’ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Tourism - Jatar Deul of Raidighi
জটার দেউল, দক্ষিণ ২৪ পরগণা

বহুমাত্রিক পর্যটনের একটি শাখা হল ঐতিহাসিক পর্যটন (Historical Tourism) বা ‘হেরিটেজ ট্যুরিজম’ (Heritage Tourism), যার মাধ্যমে আমরা অতীতকালের নির্দশন চাক্ষুস করে সে-সময়ের চালচিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করি। আর, যেকোনো অঞ্চলের অতীত সম্পর্কে জানতে প্রত্নতত্ত্ব (Archaeology) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতত্ত্বের মূল উপজীব্য হল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অজানা ইতিহাসের প্রতি আজন্মকাল ধরে মানুষের এক অদ্ভুত টান রয়েছে। রহস্যময় ইতিহাস বিজড়িত যেকোনো নিদর্শনই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার আনাচে-কানাচে সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী এরূপ অনেক নিদর্শন রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা (South 24 Parganas) -এর ‘জটার দেউল’ (Jatar Deul) তারই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জটার দেউল বঙ্গদেশে মন্দিরের সুপ্রাচীন স্থাপত্য রীতি এবং রহস্যময় ও বিতর্কিত ইতিহাসে অনন্য, যা ইতিহাসপ্রেমী যেকোনো পর্যটককে আকর্ষণ করে থাকে। (Tourism – Jatar Deul of Raidighi)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – আলেয়ার আলো

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ডায়মন্ড হারবার (Diamond Harbour) মহকুমার মথুরাপুর-২ (Mathurapur-II) ব্লকের কঙ্কনদিঘি (Kankan Dighi) গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পশ্চিম জটা (Paschim Jata) গ্রামের নিকট ‘জটার দেউল’ অবস্থিত। রায়দিঘি (Raidighi) থেকে জটার দেউলের দূরত্ব মাত্র ৮ কিমি। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণে, জটার দেউল সুন্দরবন বসতি অঞ্চলের অন্তর্গত। জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৬৮ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে (লট নং ১১৬) জঙ্গল পরিষ্কারের সময় জটার দেউলের খোঁজ মেলে। ২০১১ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI) জটার দেউলে উৎখনন ও সংস্কারকাজ শুরু করে। ‘জটার দেউল’ নামটির সাথে ধর্মীয় ও স্থাপত্যকলা জড়িয়ে রয়েছে। ‘জটা’ শব্দটি এসেছে হিন্দু দেবতা শিব (Lord Shiva) -এর আরেক নাম জটাধারী থেকে। প্রচলিত মতে, এই দেব দেউলটিতে জটাধারী নামে এক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই স্থানীয় এলাকায় এই দেউলটিকে শিবের মন্দির হিসেবে গণ্য করা হয়। আর ‘দেউল’ শব্দটির প্রকৃত আভিধানিক অর্থ হল ‘মন্দির’ বা ‘দেবালয়’

‘দেউল’ (Deula/Deul) হল প্রকৃতপক্ষে ওড়িশার হিন্দু মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত এক প্রাচীন কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলী (Kalinga Architecture)। মনে করা হয়, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে দেউল স্থাপত্যরীতির বিকাশ ঘটেছিল এবং পরবর্তী কালে ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতাব্দীতে এই স্থাপত্যরীতি পুনর্জাগরণ ঘটে। দেউল প্রধানত তিন প্রকার — রেখ দেউল (Rekha Deul) বা শিখর দেউল, পীড় দেউল (Pidha Deula) বা ভদ্র দেউল এবং খখর দেউল (Khakhara Deula)। ওড়িশাজাত এই দেউল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি মন্দির পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মন্দিরশৈলীর একটি হল দেউল। ডেভিড ম্যাকাচন বাংলার মন্দিরগুলিকে ৪ টি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন, যার একটি হল দেউল। ‘জটার দেউল’-টি একটি রেখ দেউল। উল্লেখ্য, ওড়িশার ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির (Lingaraj Temple) স্থাপত্যশৈলীতে একটি রেখ দেউল।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মাজুলি – ভারতের বৃহত্তম নদী দ্বীপ

২০১১ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তরফে জটার দেউলে শুরু হয় উৎখননের কাজ। জটার দেউল প্রাঙ্গণে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বোর্ড থেকে জানা যায়, জটার দেউলটি পঞ্চরথ ভিত্তির ওপর এক শিখর বিশিষ্ট, যা উত্তর ভারতের অন্যান্য দেউলের অনুরূপ। মাটির একটি বড়ো ঢিবির ওপর ইঁট নির্মিত জটার দেউলটি রয়েছে। পূর্বমুখী চৌকাকার এই দেউলের একটি মাত্র দরজা রয়েছে। নিচ থেকে ওপরে দেউলের কাঠামোটি ক্রমশ সরু। দেউলের গায়ে টেরাকোটার কাজ রয়েছে। দেউলের সামনে মাটির নিচ থেকে কিছু ইটের কাঠামো আবিষ্কৃত হয়েছে। যা থেকে ধারণা করা হয়, ওড়িশার রেখ দেউলের মতো জটার দেউলের সামনেও জগমোহন (সভাকক্ষ) কাঠামো ছিল। জটার দেউলের উচ্চতা মোটামুটিভাবে ১০০ ফুট (মতান্তরে ৬৫ ফুট) এবং দেউলটি বর্তমানে ২৫ ফুট × ২৫ ফুট পাদদেশীয় শিলার উপর অবস্থিত। দেউলটির তলদেশ একটি গর্ভগৃহ বিদ্যমান এবং গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য একটি ইট নির্মিত সিঁড়ি রয়েছে। আবিষ্কারের সময় দেউলটির গর্ভগৃহে কোনো বিগ্রহ পাওয়া যায়নি। গর্ভগৃহটির পরিসর খুব বেশি নয়। জটার দেউলের আশেপাশে খনন করে পাথর ও ধাতুর কিছু মূর্তি, শুঙ্গ-কুষাণ ও পর্তুগিজ আমলের মুদ্রা, হাতির দাঁত পাওয়া গেছে। বর্তমানে দেউলটির গর্ভগৃহে একটি শিবলিঙ্গ সহ শিবঠাকুরের একাধিক মূর্তি অধিষ্ঠিত রয়েছে। জটার দেউলের গর্ভগৃহে অধিষ্ঠিত মূর্তিগুলির ঐতিহাসিক মূল্য না থাকলেও, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভক্তিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিকট এগুলি যথেষ্ট মূল্যবান।

প্রচলিত মতে, জটার দেউলটি মোটামুটিভাবে এক হাজার বছরের পুরানো। যদিও জটার দেউলের নির্মাণকাল এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে মতভেদ ও বিতর্ক রয়েছে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে, জটার দেউলটি আনুমানিক একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত। ডায়মন্ড হারবারের ডেপুটি কমিশনার (১৮৭৫) -এর মতানুসারে, জটার দেউলের কাছে একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায়। অধুনালুপ্ত ওই তাম্রশাসনটির প্রকাশক ছিলেন রাজা জয়চন্দ্র বা জয়ন্তচন্দ্র (King Jayachandra or Jayantachandra), যিনি ৮৯৭ শকাব্দে অর্থাৎ ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাম্রশাসনটি প্রকাশ করেন। তাই অনেকে মনে করেন, রাজা জয়চন্দ্রই জটার দেউল নির্মাণ করেন। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক নলিনীকান্ত ভট্টশালী (Nalini Kanta Bhattasali) -এর মতে, জটার দেউলের নির্মাণ হয়েছে মুঘলযুগে। অপর এক প্রত্নতাত্ত্বিক কাশীনাথ দীক্ষিত (Kashinath Dixit) মনে করেন, এই দেউলটির নির্মাণককাল দ্বাদশ শতাব্দী। সতীশচন্দ্র মিত্র (Sathish Chandra Mitra) -এর মতে, জটার দেউল হল ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে নির্মিত রাজা প্রতাপাদিত্যের জয়স্তম্ভ। আবার অনেকে মন্দিরের নির্মাণশৈলী বিচার করে বলেন, জটার দেউলটি নাকি গুপ্তযুগের। বিতর্কের শেষ এখানেই নয়! অনেকে জটার দেউলকে বৌদ্ধ মন্দির, আবার পর্তুগিজ নির্মিত ওয়াচ টাওয়ার বলে মনে করেন। সুতরাং, জটার দেউলের নির্মাণকাল ও নির্মাতা কে? — এবিষয়ে কোনো সর্বজনগৃহীত কোনো মত নেই। তাই জটার দেউলের ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সুন্দরবনের মাছ

আবিষ্কারের পর দীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত হওয়ার কারণে, উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে জটার দেউলের টেরাকোটা সহ অনেকাংশই সময়ের গ্রাসে চলে গেছে। বর্তমানে এই দেউলটি ভারত সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে এবং জটার দেউলকে ‘সংরক্ষিত পুরাসৌধ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে প্রতিবছর ২ রা বৈশাখ ঘোড়দৌড় হয় এবং মেলা বসে। ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে সুন্দরবন অঞ্চল নবীন হলেও, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চল যে যথেষ্ট প্রাচীন, জটার দেউল তারই প্রমাণস্বরূপ আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুন্দরবনের ইতিহাস চর্চায় জটার দেউলের গুরুত্ব অপরিসীম। চতুর্দিকে কৃষিজমি ঘেরা জটার দেউল যেন রহস্যময় এক ইতিহাস বহন করে চলেছে।

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]

পথনির্দেশ: রেলপথে শিয়ালদা (দক্ষিণ) স্টেশন থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ধরে কয়েক ঘন্টার সফরে পৌঁছে যাবেন মথুরাপুর স্টেশনে। মথুরাপুর স্টেশন থেকে সড়কপথে বাস বা অটোয় কম-বেশি ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যাবেন রায়দিঘি। রায়দিঘি থেকে সড়কপথে গাড়ি বা মোটরভ্যানে কম-বেশি ৩০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন ‘জটার দেউল’। (Tourism – Jatar Deul of Raidighi)

লেখিকা :- তানিয়া খাতুন (চাঁপাডাঙ্গা, হুগলি)
তথ্যসূত্রঃ- বঙ্গদর্শন; Wikipedia; কিশলয় বাংলার ই-পত্রিকা; Google Map; বাংলাপিডিয়া; E Travel Guru ; আনন্দবাজার পত্রিকা

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পর্যটন – রায়দিঘির জটার দেউল

6 thoughts on “Tourism – Jatar Deul of Raidighi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!