Topic – Will-o’-the-Wisp
প্রসঙ্গ – আলেয়ার আলো
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Topic – Will-o’-the-Wisp । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি আলেয়া সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

২০২২ সালের মে মাসের প্রথমার্ধ। হুগলির রিষড়া পুরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ৩ নম্বর পদ্মপুকুর। সন্ধ্যা নামলেই পুকুরের মাঝে জ্বলে উঠছে হলদে-সবুজ রঙের গোলাকার অদ্ভুত আলো। যা নিয়ে উৎসাহী জনতার ভিড়, অলৌকিক ব্যাখ্যা, আরও কত কি! আসলে যা ছিল ‘আলেয়ার আলো’ (Lights of Aleya)। আলেয়া (Aleya) শব্দটির অর্থ হল মায়া বা প্রহেলিকা। আলেয়ার আলো এক প্রকার বায়ুমণ্ডলীয় ভৌতিক আলো (Atmospheric Ghost Lights), যা সাধারণত রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে দেখা যায়। আলেয়ার আলো হল জলাভূমিতে দৃষ্ট এক ধরনের জ্বলন্ত গ্যাস, মাটি থেকে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। রাতের অন্ধকারে এধরনের ভুতুড়ে আলো মানুষের মনে বিভ্রান্তি বা ভ্রম সৃষ্টি করে। তাই, এটি আলেয়ার আলো নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের গাঙ্গেয় নিম্ন সমভূমি ও সুন্দরবনের জলাভূমি অঞ্চলে সাধারণত আলেয়ার আলো দেখা যায়। (Topic – Will-o’-the-Wisp)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মুর্শিদাবাদের আহিরণ বিল
আলেয়ার আলো ইংরাজিতে উইল-ও’-দ্য-উইসপ্ (Will-o’-the-wisp) বলা হয়। ইউরোপিয়ান লোকগাঁথায় এধরনের ভুতুড়ে আলো জ্যাকের লন্ঠন (Jack-o’-lantern), ফ্রাইয়ারের লন্ঠন (Friar’s Lantern), হিঙ্কিপাঙ্ক (Hinkypunk) প্রভৃতি নামে পরিচিত। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন অঞ্চলে আলেয়ার আলোর অনুরূপ ভুতুড়ে আলো দেখা যায়, যা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন — পশ্চিমবঙ্গে যা আলেয়ার আলো, তা গুজরাটের কচ্ছের রণ অঞ্চলে ‘চির বাত্তি’ (Cheer Batti), তামিলনাড়ুতে ‘কোল্লিভায় পেয়’ (Kollivay Pey), কেরালাতে তা ‘কুলিয়ান্দে চুতে’ (Kuliyande Choote) নামে পরিচিত। আলেয়ার আলো অস্ট্রেলিয়াতে মিন মিন লাইট (Min Min Light), জাপানে হিতোদামা (Hitodama), থাইল্যান্ডে নাগা অগ্নিগোলক (Naga Fireballs), মেক্সিকোতে ব্রুজাস (Brujas) ও লুসেস দেল দিনেরো (Luces Del Dinero), ব্রাজিলে বই-তাতা (Boi-Tata), আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়েতে লাজ মালা (Luz Mala) নামে পরিচিত।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মাজুলি – ভারতের বৃহত্তম নদী দ্বীপ
আলেয়ার আলো-কে নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক কিংবদন্তী, অলৌকিক ও ভৌতিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, আলেয়ার আলো দেখলেই নাকি শরীরে-মনে এক ঘোরের সৃষ্টি হয়, বোধ-বুদ্ধি কাজ করে না। লোকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই আলো অনুসরণ করে এগোতে থাকে। তার পরে, হয় জলে ডুবে নাহলে অন্য কোনও রহস্যজনক কারণে মৃত্যু হয় তাদের! পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে এবিষয়ে প্রচলিত কাহিনী হল — একসময় সুন্দরবন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন রাজা শ্রুতঞ্জয়। তাঁর ছেলের নাম ছিল অলঞ্জয়। সৎ গুণের জন্য প্রিয় সেই রাজকুমারকে সবাই আলেয়া নামে আদর করে ডাকতেন। রাজ্য অভিষেকের সময়, রাজবংশের নিয়ম মেনে তিনি চললেন শিকারে। কেন না, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে প্রমাণ দিতে হবে যোগ্যতার। বাবার সাথে সুন্দরবনের জঙ্গলে শিকারে গিয়ে চাঁদের আলোয় আলেয়া দেখতে পেলেন, এক খাঁড়ির মুখে জল খাচ্ছে এক বাঘিনী ও তার শাবক। দলবল নিয়ে আলেয়া বধ করলেন সেই বাঘিনী ও তার শাবককে। মনের আনন্দে রাজ্যের দিকে ফিরতে থাকলেন আলেয়া। কিন্তু, বিপদ ঘনিয়ে এল পরের রাতেই। বাঘ শিকারের পরের রাতে আলেয়া দেখলেন, আরও এক বাঘিনী তার শাবককে নিয়ে জল খাচ্ছে। ঠিক আগের মতো এবারেও শিকার করতে এগিয়ে গেলেন রাজকুমার। এবার কিন্তু আর আগের মতো ঘটনা ঘটল না! সবার চোখের সামনে, রাজকুমারকে মুখে নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল বাঘিনী আর তার শাবক। সন্তানহারা রাজা হাহাকার করতে করতে ফিরে এলেন ঘরে। কিন্তু আলেয়ার অতৃপ্ত আত্মা থেকে গেল সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলেই! নিজের অকালমৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আজও তিনি আলো হয়ে ঘুরে বেড়ান সেখানে। যাঁরা সেই আলো দেখতে পান, অনুসরণ করতে করতে তলিয়ে যান মৃত্যুমুখে।
যদিও বিজ্ঞানীরা এসব অলৌকিক কাহিনী বিশ্বাস করেন না। আলেয়ার আলোর উৎপত্তি কেন, কিভাবে ঘটে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক মতে, সাধারণত পাহাড়ের পাদদেশে অরণ্যাঞ্চলের বদ্ধ হ্রদে, জলাভূমি বা বিলে, পুকুরে, ধানজমিতে, নদী তীরবর্তী অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে উদ্ভিদ পদার্থের জৈব যৌগের (ঘাস, পাতা, ডালপালা প্রভৃতি) ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিয়োজনের ফলে মিথেন গ্যাস সৃষ্টি হয়। আবার অনেক সময় প্রাণীদেহের বিয়োজনের ফলে জলাভূমিতে ফসফিন, ডাইফসফিন গ্যাস সৃষ্টি হয়। তাই জলাভূমিতে সৃষ্ট মিথেনের সাথে অনেক সময় ফসফিন ও ডাইফসফিন গ্যাস মিশে থাকে, যা বায়ুতে আপনাআপনিই জ্বলে ওঠে। এর ফলে সৃষ্ট তাপে মিথেন গ্যাস নীলাভ শিখায় জ্বলতে থাকে। মিথেন সহ অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণের ফলে হলুদ, সবুজ, নীল বিভিন্ন রঙের আলো দেখা যায়। বাতাসের কারণে গতিশীল এই আলোই হল আলেয়া। অনেক সময় প্রাচীন পুকুর দীর্ঘদিন সংস্কার না হলে পাঁক কিংবা পচে যাওয়া গাছের পাতা অথবা আবর্জনা থেকে বেরনো মিথেন গ্যাস একই ভাবে বায়ুর সংস্পর্শে এসে জ্বলে যায়। মিথেন গ্যাস বেশি পরিমাণে তৈরি হলে জলের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে এবং অনেক সময় জলের উপরের স্তরে বাতাসের সংস্পর্শে তা জ্বলে উঠতে পারে।
সুতরাং, বৈজ্ঞানিক ব্যাখাতে এটা পরিষ্কার যে, আলেয়ার আলো কোনো ভৌতিক বা অলৌকিক ব্যাপার নয়। তবুও কুসংস্কারের বশে গ্রামবাংলার অনেক মানুষই আলেয়ার আলো-কে আজও ভৌতিক ঘটনা বলে মনে করেন। বাংলা সিনেমা-সাহিত্যেও উঠে এসেছে আলেয়ার আলো। ১৯৭০ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘আলেয়ার আলো’ নামে একটি বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। কবি জীবনানন্দ দাশ ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থের আলেয়া নামক কবিতায় লিখেছেন,
‘প্রান্তরের পারে তব তিমিরের খেয়া
নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া!’
(Topic – Will-o’-the-Wisp)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- অয়ন বিশ্বাস (ঘোড়ালিয়া, শান্তিপুর, নদীয়া)
তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা ; সংবাদ প্রতিদিন ; Wikipedia ; বর্তমান পত্রিকা ; কালের কন্ঠ ; প্রথম আলো
Pingback: Thanjavur - Granary of South India - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Tourism - Jatar Deul of Raidighi - ভূগোলিকা-Bhugolika