Topic – Minority Population of Bangladesh
প্রসঙ্গ – বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনসংখ্যা
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Topic – Minority Population of Bangladesh । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনসংখ্যা (হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান) সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

সংখ্যালঘু জনসংখ্যা (Minority Population) জনমিতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির দৃষ্টিকোণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন প্রশ্ন হল, সংখ্যালঘু কারা? কোন কোন বিষয়ের ওপর সংখ্যালঘু মর্যাদা নির্ধারিত হয়? আন্তর্জাতিক মহলে সংখ্যালঘুর কোনো সুনির্দিষ্ট, সর্বজনগৃহীত সংজ্ঞা নেই এবং সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা নিয়েও বিতর্ক/মতভেদ রয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনে (১৮/১২/১৯৯২) রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৭/১৩৫ সিদ্ধান্ত অনুসারে গৃহীত রাষ্ট্রসংঘের সংখ্যালঘু ঘোষণাপত্রের ধারা ১ অনুযায়ী, জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু নির্যাতনে বাংলাদেশ একটি বহু-চর্চিত দেশ। বাংলাদেশের সংবিধানেও সংখ্যালঘুর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবুও, রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণাপত্র ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, বাংলাদেশে জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই সংখ্যালঘু।
ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হল মূলত হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান। ২০২২ সালের জনগণনা অনুসারে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৭.৯৫% হিন্দু, ০.৬১% বৌদ্ধ এবং ০.৩০% খ্রিস্টান। এছাড়াও, বাংলাদেশে শিখ ধর্মেরও স্বল্প জনসংখ্যা রয়েছে। ভাষাগত দিক দিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হল বিষ্ণুপ্রিয়া, চাকমা, হাজং, সাঁওতালি, মুন্ডারি, খাসি, কোচ, মিজো, রিয়াং, মারমা প্রভৃতি। নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হল চাকমা, বিহারি, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরী, মেইতেই, বড়ুয়া, ওরাওঁ, খাসি, গারো প্রভৃতি। আজকের এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। (Topic – Minority Population of Bangladesh)
আজকের বাংলাদেশ ভূখন্ডটি প্রায় সাড়ে সাত দশক আগে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের অন্তর্গত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হয়। বিবিসি বাংলা-তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮.৯৮% সংখ্যালঘু। এই তথ্যানুসারেই বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার সাপেক্ষে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল — ১৯৫১ সালে ২৩.১%, ১৯৬১ সালে ১৯.৬%, ১৯৭৪ সালে ১৪.৬%, ১৯৮১ সালে ১৩.৩%, ১৯৯১ সালে ১১.৭%, ২০০১ সালে ১০.৪%, ২০১১ সালে ৯.৬%। অর্থাৎ দেশভাগ পরবর্তী কালে পূর্ব পাকিস্তান রূপেই হোক, বা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র; বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ক্রমশ ধারাবাহিক ভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মাউন্ট এভারেস্ট বিজয়ের ইতিহাস
বাংলাদেশের সর্বপ্রধান, বৃহত্তম সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হল হিন্দু। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল সার্ভে দ্বারা নির্ধারিত তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬.৫১ কোটি এবং হিন্দু জনসংখ্যা ১.৩১ কোটি। ২০১৫ সালে যা ছিল যথাক্রমে ১৫.৮৯ কোটি এবং ১.৭০ কোটি। ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। দেশভাগের পূর্বে, ১৯১১, ১৯২১, ১৯৩১ ও ১৯৪১ সালে বর্তমান বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩১.৫০%, ৩০.৬০%, ২৯.৪০% এবং ২৮%। দেশভাগের পর, পূর্ব পাকিস্তান রূপে বর্তমান বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ১৯৫১ সালে ২২.০৫% ও ১৯৬১ সালে ১৮.৫০%। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশের পর, ১৯৭১, ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১, ২০১১ সালে বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৩.৫০%, ১২.১৩%, ১০.৫১%, ৯.২০%, ৮.৫%। সর্বশেষ জনগণনাতে অর্থাৎ ২০২২ সালে বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ হল মাত্র ৭.৯৫%। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিভাগ অনুসারে হিন্দু জনসংখ্যার চিত্রটা এইরূপ – সিলেট বিভাগে ১৪.০৫%, খুলনা বিভাগে ১৩.৯১%, রংপুর বিভাগে ১৩.২১% বরিশাল বিভাগে ৯.১৫%, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭.১১%, ঢাকা বিভাগে ৬.৯২%, রাজশাহী বিভাগে ৫.৮৮% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪.২২%। যা ২০২২ সালের জনগণনা অনুসারে — সিলেট বিভাগে ১৩.৫০%, খুলনা বিভাগে ১১.৫২%, রংপুর বিভাগে ১২.৯৮%, বরিশাল বিভাগে ৮.২৪%, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬.৬১%, ঢাকা বিভাগে ৬.২৫%, রাজশাহী বিভাগে ৫.৬৭% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩.৯২%। সুতরাং এ তথ্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এক দশকে (২০১১-২২) বাংলাদেশের প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যায় শীর্ষ ৫ টি জেলা ছিল — ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ জেলা (৩০.১৮%), সিলেট বিভাগের মৌলভিবাজার জেলা (২৪.৫৯%), খুলনা বিভাগের খুলনা জেলা (২২.৬৮%), রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলা (১৯.৫১%) এবং রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলা (১৮.৬৫%)। ২০২২ সালে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যায় শীর্ষ ৫ টি জেলা হল — ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ জেলা, (২৬.৯৫%), সিলেট বিভাগের মৌলভিবাজার জেলা (২৪.৪৫%), রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলা (২২.১৪%), খুলনা বিভাগের খুলনা জেলা (২০.৭৬%) , রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলা (১৯.৫৬%)। (Topic – Minority Population of Bangladesh)
বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হল বৌদ্ধ। ২০২২ জনগণনা অনুসারে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার নিরিখে বৌদ্ধ জনসংখ্যা মাত্র ০.৬১%, যা সংখ্যাতে প্রায় ১০ লাখ। ১৯৫১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দশক অনুসারে বাংলাদেশের বৌদ্ধ জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল — ০.৭% (১৯৫১), ০.৭% (১৯৬১), ০.৬% (১৯৭১), ০.৬% (১৯৮১), ০.৬% (১৯৯১), ০.৭% (২০০১), ০.৬% (২০১১)। বাংলাদেশে মূলত চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলা এবং ঢাকা পৌর অঞ্চলে বৌদ্ধ জনসংখ্যা বসবাস করে। বাংলাদেশে তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হল খ্রিস্টান। ২০২২ জনগণনা অনুসারে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার নিরিখে খ্রিস্টান জনসংখ্যা মাত্র ০.৩০%, যা সংখ্যাতে ৫ লাখের মতো। ১৯৫১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দশক অনুসারে বাংলাদেশের খ্রিস্টান জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল — ০.৩% (১৯৫১), ০.৩% (১৯৬১), ০.২% (১৯৭১), ০.৩% (১৯৮১), ০.৩% (১৯৯১), ০.৩% (২০০১), ০.৩৭% (২০১১)। বাংলাদেশে মূলত ঢাকা, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলে খ্রিস্টান জনসংখ্যা বসবাস করে। বাংলাদেশে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান জনসংখ্যা সেভাবে হ্রাস না পেলেও, গত সাত দশক ধরে প্রায় একই অবস্থায় রয়েছে, যা জনবৃদ্ধির স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দক্ষিণের ডুয়ার্স – ঝালুয়ারবেড়
কেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই — ভয়ংকর সংখ্যালঘু নির্যাতন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু জনসংখ্যার ওপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে হিন্দু-নিধন ঘটে এবং নির্যাতনের ফলে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ধর্মীয় উৎপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতার কারনে ভারতে শরণার্থী হিসেবে চলে আসেন। গত ১০০ বছরে বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের তথ্যে দেখা যায়, ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ সালে ৪.৯৫% এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালে ৫% হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তবে, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পরেও প্রতি জনগণনাতে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমশ কমেছে। যার মূল কারণ হল — সাংবিধানিক পরিবর্তন, মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, উগ্র ধর্মান্ধতা, সংখ্যালঘু সুরক্ষায় সরকারি ব্যর্থতা প্রভৃতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষক ড. আবুল বারকাত তাঁর ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামের গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল সময়কালে বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। (Topic – Minority Population of Bangladesh)
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক ভাবে নির্যাতন ঘটে চলেছে। যার অন্যতম রূপ হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে ১৯৯২, ২০০১, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৭, ২০২৪ সালে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসার শিকার হয়েছেন হিন্দুরা। বৌদ্ধরা ১৯৬২ সালে রাজশাহী গণহত্যা, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা ও ২০১২ সালে রামু হিংসার শিকার। খ্রিস্টানরা ২০০১, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৯ সালে সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার। এ সবই কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। ‘এনিমি প্রপার্টি অ্যাক্ট’ ও ‘ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট’ -এর অপব্যবহার করে সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি, জমি, দোকান দখল; ধর্মীয় স্থল (মন্দির, চার্চ প্রভৃতি) ভাঙচুর; ধর্মীয় উৎসবে বাধা/হামলা; জোরপূর্বক ধর্মান্তরন; সামাজিক পরিসরে সংখ্যাতত্ত্বের জোরে বঞ্চনা প্রভৃতি কারনের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এর সাথে সাম্প্রতিক কালে যুক্ত হয়েছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ‘ডিজিটাল’ ছক। Deutsche Welle -এর এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত, সোস্যাল মিডিয়া বিশেষত ফেসবুকে সংখ্যালঘু নামধারী কোনো ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট করে, স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে সেই ইস্যুতে পরিকল্পিতভাবে উত্তেজিত করে সংখ্যালঘুদের আক্রমণ ও নির্যাতন করা হচ্ছে। মূলত ২০১২ সাল থেকেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবেড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়া, ২০১৭ সালে রামুর বৌদ্ধ পল্লিতে এই পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে Deutsche Welle -এর ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, “পুলিশ ও প্রশাসন যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলেও এই প্রতিটি ঘটনাই ঠেকানো যেত। কারণ প্রতিটি ঘটনাই পরিকল্পিতভাবে হয়েছে। হামলার কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রুপগুলো প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছে। মাইকিং করেছে, বিদ্বেষ ছড়িয়েছে এবং লোকজনকে সংগঠিত করেছে। আর প্রতিটি ঘটনায়ই দেখা গেছে ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার গুজব বা অন্যরা তা পোস্ট করে সংখ্যালঘুদের ফাঁসিয়েছে। যা আগেই পুলিশ জানত।”
১৯৭২ সালে শেখ মুজিব জমানায় বাংলাদেশের আদি সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ৪ টি প্রধান নীতির একটি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাতিল করেন, যা ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাশ হয়। ১৯৮৮ সালে এরশাদ জমানায় ইসলামকে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ (State Religion) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি পুনরায় বহাল করলেও, রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলাম আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা জমানায় পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ‘Unique local culture & tradition of the tribes, minor races, ethnic sects & communities’ শীর্ষক স্পেশাল প্রভিশন যুক্ত হয়।
সুতরাং সাংবিধানিক পরিসরে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু যার জাতীয় ধর্ম ইসলাম! আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব কোনো প্রেক্ষাপটেই সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই! তবে বাংলাদেশ মাইনোরিটি ওয়াচ (BDMW), জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, Transperancy International Bangladesh প্রভৃতি সংস্থা রয়েছে। কিন্তু তাদের পরিসর সীমিত ও অবহেলিত। বাংলাদেশে তাই সাংবিধানিক ও সরকারি কাঠামোতে সংখ্যালঘুরা আজও অসহায়। তবে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একাধিক সংগঠন গড়েছেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রধান হল ১৯৮৮ সালে স্থাপিত বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এছাড়াও রয়েছে জাতীয় হিন্দু মৈত্রী পরিষদ, জাতীয় হিন্দু মহাজোট প্রভৃতি সংগঠন। এই সব সংখ্যালঘু সংগঠনগুলি দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ করে সরকারের নিকট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় কড়া আইন প্রণয়নে দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আজও সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্রটা বদলায়নি।
বাংলাদেশ! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার বাংলা’ ভারতের পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হলেও, সেদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং সে কারণে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা হ্রাসের গতিপথ পরিবর্তন হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মীয় মতবাদে তৈরি রাজনৈতিক দলগুলি কর্তৃক উগ্র ধর্মান্ধতা প্রসারের কারণে বাংলাদেশ আজ শুধু খাতায় কলমেই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, আর্থিক উন্নতি, শিক্ষা ব্যবস্থা সবেতেই ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়া বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা। তিনিও তাঁর পিতার মতো ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার আদর্শে চলতেন, এনিয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর দল আওয়ামি লিগকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবচেয়ে ভরসা করে। কিন্তু তাঁর আমলেও একাধিকবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্মীয় সংগঠনের প্রবল চাপ, রাজনৈতিক আপোষ আর ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ের মাঝে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষবাষ্প থেকে তিনিও বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পারেননি। ২০২৪ সালের অক্টোবরে তথাকথিত ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। বর্তমানে মহম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা রূপে বাংলাদেশের কান্ডারী। ক্ষমতার এই পালাবদল কালেও প্রশাসনিক পঙ্গুত্ব ও মৌলবাদী শক্তিগুলি অতি সক্রিয়তায় হিন্দু সম্প্রদায় হিংসার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাজপথে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে হিন্দুরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। বাংলাদেশের পরবর্তী জনগণনায় হিন্দু সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চিত্রটা কিরূপ উঠে আসবে, তা জানার অপেক্ষায় রইলাম। আর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ছবিটা যদি না বদলায়, তবে আগামী কয়েক দশকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর, কয়েক দশক ধরে সুপরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশের জনমিতি বদলের যে প্রচেষ্টা চলে আসছে, তা ১০০% সাফল্যলাভ করবে। অতঃপর বাংলাদেশে বহুল চর্চিত ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ — বাক্যটি জাদুঘরে জীবাশ্মের ন্যায় সংরক্ষিত থাকবে। (Topic – Minority Population of Bangladesh)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- UN Declaration; Census of India (১৯০১-৪১); Census of East Pakistan (১৯৫১-৬১); Bangladesh Government Census (১৯৭৪-২০১১); Bangladesh Bureau of Statistics (BBS) – ২০১১, ২০২২ ; প্রথম আলো ; Wikipedia ; The Daily Star; বিবিসি বাংলা; Deutsche Welle (DW); Constitution of Bangladesh
Pingback: Kawah Ijen - Blue Flame Volcano - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Dampier-Hodges Line of Sundarban - ভূগোলিকা-Bhugolika
Good
Pingback: Topic - Description of Clouds - ভূগোলিকা-Bhugolika