Topic – Golden Quadrilateral Project
প্রসঙ্গ – সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Topic – Golden Quadrilateral Project । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি ভারতের সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

অর্থনৈতিক ভূগোলের প্রেক্ষাপটে পরিবহণ (Transport) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেকোনো দেশ/অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিবহণ ব্যবস্থা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবহণ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়নশীল বিশ্বের বর্তমানে সর্বাধিক জনবহুল দেশ ভারতবর্ষে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থা কতখানি দরকারি, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প (Golden Quadrilateral Project) হল সেই সড়কপথ প্রকল্প, যা একুশ শতকের ভারতীয় পরিবহণ ব্যবস্থাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ভারতরত্ন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ীর প্রথম ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ হল সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প। যাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের সড়কপথ ক্ষেত্রে বৃহত্তম পরিকাঠামো হস্তক্ষেপ — সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প (Biggest Infrastructure Intervention in the Roadways Sector)।
ভারতের ৪ টি প্রধান মেট্রো শহর, যথা : পশ্চিমে মুম্বাই, উত্তরে দিল্লি, পূর্বে কলকাতা ও দক্ষিণে চেন্নাই-কে যে চার ও ছয় লেনের চতুর্ভুজ সড়কপথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়, তাই হল সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘সুপার হাইওয়ে’ -এর দ্বারা উপরোক্ত ৪ মেগাসিটির মধ্যে পরিবহণের দূরত্ব ও সময় হ্রাসকরণ। তবে শুধুমাত্র ওই ৪ মেগাসিটি নয়, এই প্রকল্পে ন্যাশনাল হাইওয়ে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভারতের অধিকাংশ প্রধান কৃষি, শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলি সংযুক্ত করা হয়। মোট ৫৮৪৬ কিমি দৈর্ঘ্যের সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প হল ভারতের দীর্ঘতম হাইওয়ে প্রকল্প (Largest Highways Project)। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার ১৯৯৯ সালে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালের ৬ ই জানুয়ারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। ২০০১ সালে এই প্রকল্পের সূচনা হয় এবং ২০১২ সালে এই প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়। এই প্রকল্পে ব্যয় হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ন্যাশনাল হাইওয়েজ অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া (NHAI)-এর পরিচালনায় সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প হল ন্যাশনাল হাইওয়েজ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (NHDP)-এর প্রথম পর্যায়। উল্লেখ্য, নর্থ-সাউথ এবং ইস্ট-ওয়েস্ট করিডোর প্রকল্প হল ন্যাশনাল হাইওয়েজ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (NHDP)-এর দ্বিতীয় পর্যায়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবনের দেবী বনবিবি
সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পের ৪ টি অংশ হল — (১) মু্ম্বাই-দিল্লি, যার দৈর্ঘ্য ১৪১৯ কিমি। এই অংশে মুম্বাই ও দিল্লির মধ্যবর্তী যেসব প্রধান শহরগুলি সংযুক্ত হয়েছে, সেগুলি হল : সুরাট, ভদোদরা, আমেদাবাদ, গান্ধীনগর, উদয়পুর, চিতোরগড়, জয়পুর, গুরগাঁও প্রভৃতি। (২) দিল্লি-কলকাতা, যার দৈর্ঘ্য ১৪৫৩ কিমি। এই অংশে দিল্লি ও কলকাতার মধ্যবর্তী যেসব প্রধান শহরগুলি সংযুক্ত হয়েছে, সেগুলি হল : ফরিদাবাদ, মথুরা, আগ্রা, ফিরোজাবাদ, কানপুর, প্রয়াগরাজ, বারাণসী, সাসারাম, ধানবাদ, আসানসোল, দুর্গাপুর, বর্ধমান প্রভৃতি। (৩) কলকাতা-চেন্নাই, যার দৈর্ঘ্য ১৬৮৪ কিমি। এই অংশে কলকাতা ও চেন্নাইয়ের মধ্যবর্তী যেসব প্রধান শহরগুলি সংযুক্ত হয়েছে, সেগুলি হল : খড়্গপুর, কটক, ভুবনেশ্বর, বিশাখাপত্তনম, রাজামুন্দ্রি, বিজয়ওয়াড়া, গুন্টুর, নেল্লোর প্রভৃতি। (৪) চেন্নাই-মুম্বাই, যার দৈর্ঘ্য ১২৯০ কিমি। এই অংশে চেন্নাই ও মুম্বাইয়ের মধ্যবর্তী যেসব প্রধান শহরগুলি সংযুক্ত হয়েছে, সেগুলি হল : ভেলোর, বেঙ্গালুরু, হুবলি-ধারওয়ার, বেলগাভি, কোলাপুর, সাতারা, পুণে প্রভৃতি। (Topic – Golden Quadrilateral Project)
ভারতের জাতীয় সড়কপথ (National Highways)-এর নতুন সংখ্যায়ন (২০১০) অনুসারে, সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পের মুম্বাই-দিল্লি অংশটি ন্যাশনাল হাইওয়ে-৪৮ ; দিল্লি-কলকাতা অংশটি ন্যাশনাল হাইওয়ে-৪৪ (দিল্লি-আগ্রা) ও ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ (আগ্রা-কলকাতা) ; কলকাতা-চেন্নাই অংশটি ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৬ এবং চেন্নাই-মুম্বাই অংশটি ন্যাশনাল হাইওয়ে-৪৮ নামে পরিচিত। ভারতের ১২ টি রাজ্য (অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, কর্ণাটক, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, বিহার, ঝাড়খন্ড, হরিয়ানা) এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (দিল্লি)-এর মধ্য দিয়ে সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প প্রসারিত হয়েছে। রাজ্য অনুসারে, সোনালী চতুর্ভুজ সড়কপথের দৈর্ঘ্য অন্ধ্রপ্রদেশে সর্বাধিক, ১০১৪ কিমি ও হরিয়ানাতে সর্বনিম্ন ১৫২ কিমি এবং দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২৫ কিমি। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পের সড়কপথের দৈর্ঘ্য ৪০৬ কিমি।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মুর্শিদাবাদের রেশম শিল্প
সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পের ৪ টি প্রধান সুবিধা হল — (১) পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ অনেক বেশি উন্নততর হওয়া (২) শিল্পোদ্যোগের জন্য আরও বেশি পছন্দসই স্থান প্রাপ্তি (৩) কৃষিক্ষেত্রে অপচয় হ্রাস এবং (৪) যানবাহন চলাচলে ব্যয় ও সময়ের সাশ্রয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের প্রধান শহর ও বন্দরগুলির মধ্যে দ্রুততর পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং অপেক্ষাকৃত ছোটো শহরগুলিতেও শিল্পোন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। এছাড়া সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পে জাতীয় সড়কের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী ট্রাক পরিবহণ ব্যবস্থা আরও বিকশিত ও বিস্তৃত হয়। একাধিক গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই প্রকল্পে নির্মিত জাতীয় সড়কপথের ১০ কিমি এলাকার মধ্যে উৎপাদনমুখী কার্যকলাপ ও উৎপাদনশীলতা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বোপরি পরিবহণ ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত এই উন্নয়নের ফলে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি আরও গতিময় হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প হল ভারতের প্রথম জাতীয় পর্যায়ের পরিবহণ পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, যা ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ীর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতায় বাস্তবায়িত হয়। জমি অধিগ্রহণ, তহবিল নির্মাণ, প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রীতা প্রভৃতি সমস্যা মোকাবিলা করে এই প্রকল্পকে প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার সফল করে তোলে। সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পকে ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে নর্থ-সাউথ ও ইস্ট-ওয়েস্ট করিডোর গড়ে ওঠে, যা ভারতের সড়কপথ পরিবহণকে আরও উন্নত করেছে। ২০১৫ সালে ভারত সরকার দেশব্যাপী সড়ক ও জাতীয় সড়কপথ নির্মাণে ‘ভারতমালা পরিযোজনা’ গ্রহণ করেছে, যা সোনালী চতুর্ভুজের উত্তরসূরী হিসেবে ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে। (Topic – Golden Quadrilateral Project)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- National Highways Authority of India (NHAI) ; Financial Express ; The Indian Express ; The Hindu ; Business Standard
Pingback: Only Fossil Park in West Bengal - ভূগোলিকা-Bhugolika
তথ্যসমৃদ্ধ রচনা..শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন
ধন্যবাদ ❤️
Pingback: Sundarban - Epicenter of Gynaecological Diseases - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Sisal Cultivation in Tribal Development - ভূগোলিকা-Bhugolika