Topic – Ecotone & Edge Effect
প্রসঙ্গ – ইকোটোন এবং এজ ইফেক্ট
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Topic – Ecotone & Edge Effect । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বাস্তুতন্ত্রের ইকোটোন এবং এজ ইফেক্ট সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

জীবভূগোল এবং বাস্তুতান্ত্রিক অধ্যয়নে ইকোটোন (Ecotone) এবং এজ ইফেক্ট (Edge Effect) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং পরস্পর নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। একেবারে সহজ কথায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে বসবাসকারী জীবগোষ্ঠীর পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়া এবং জীবগোষ্ঠীর সাথে ওই পরিবেশের উপাদানগুলির আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে যে বসবাসরীতি গড়ে ওঠে, তাকে বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) বলে। প্রত্যেক বাস্তুতন্ত্রের একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকে। দুটি ভিন্ন বাস্তুতন্ত্র যখন একে অপরের সাথে মিলিত হয়, তখন দুটি ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের সংযোগস্থলে অধিকমাত্রায় জীববৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই বিশেষ অঞ্চলকে ইকোটোন (Ecotone) বলে। অন্যভাবে বলা যায়, পাশাপাশি অবস্থিত দুটি বাস্তুতন্ত্র যে সংকীর্ণ স্থানে মিলিত হয়ে একটি পরিবর্তনশীল বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলে, তাকে ইকোটোন বলে। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ বায়োডাইভার্সিটি (দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৩) গ্রন্থে ইকোলজিস্ট সলিট কার্ক (Salit Kark) -এর মতে, ‘Ecotones are areas of steep transition between ecological communities, ecosystems, or ecological regions along an environmental gradient’। আবার, স্থিতিশীল উন্নয়ন গবেষক ডেভিড থর্প (২০১৪) -এর মতে, ‘An Ecotone describes an area that acts as a transition or boundary between two ecosystems’। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও স্থলভাগের বাস্তুতন্ত্র যেখানে পরস্পর সংযুক্ত হয়েছে, সেখানে অধিক জীববৈচিত্র্য দেখা যায়। এই সংযোগস্থলকে পরিবর্তনশীল অঞ্চল (Transition Zone) বলা হয়, যা ম্যানগ্রোভ অরণ্য নামে পরিচিত। সুতরাং, ম্যানগ্রোভ অরণ্য একপ্রকার ইকোটোন। অনুরূপ ভাবে, অরণ্য এবং মরুভূমির মধ্যে অন্তর্বর্তী স্থান হল তৃণভূমি, যা একপ্রকার ইকোটোনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৮৫৯ সালে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস সর্বপ্রথম ‘Ecotone’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘Ecotone’ শব্দটি Ecology অর্থাৎ বাস্তুবিদ্যা এবং গ্রিক শব্দ Tonos অর্থাৎ চিন্তা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ইকোটোন -এর অর্থ হল এমন একটি স্থান, যেখানে বাস্তুবিদ্যাগুলি চিন্তায় রয়েছে।
ইকোটোনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল — (১) ইকোটোন সংকীর্ণ বা বিস্তৃত প্রকৃতির হতে পারে। যেমন, তৃণভূমি ও অরণ্যের মধ্যবর্তী ইকোটোন সংকীর্ণ প্রকৃতির হয়। আবার অরণ্য ও মরুভূমির মধ্যবর্তী ইকোটোন বিস্তৃত প্রকৃতির হয়। (২) কোনো ইকোটোন অঞ্চলের বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থা ইকোটোনের উভয় পার্শ্বে অবস্থিত বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থার মধ্যবর্তী প্রকৃতির হয়। এইজন্য ইকোটোনকে ‘Zone of Tension’ বলা হয়। (৩) কোনো উন্নত ইকোটোন অঞ্চলে এমন কিছু জীবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় যে, জীবগুলি তার সন্নিহিত সম্প্রদায়ের জীবগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। (৪) ইকোটোন অঞ্চলে একটি স্বাভাবিক উদ্ভিদ পরিবর্তনশীল অঞ্চল (Vegetation Transitional Zone) থাকে, যা দুটি বাস্তুতন্ত্রকে পৃথক করে রাখে। যেমন, তৃণভূমি অঞ্চলে ঘাসের বর্ণ পরিবর্তন ইকোটোনের উপস্থিতিকে নির্দেশ করে। (৫) জলবায়ু পরিবর্তনের বা মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের প্রতি কোনো ইকোটোন খুবই সংবেদনশীল হয়। (৬) ইকোটোনগুলি বিবর্তন প্রক্রিয়ার তথ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : বাঁকুড়ার ডোকরা গ্রাম বিকনা
ইকোটোনের সাধারণ উদাহরণ হল — পুকুর বা জলাশয়ের পাড়, যেখানে স্থলজ বাস্তুতন্ত্র ও পুকুরের জলজ বাস্তুতন্ত্র পরস্পর মিলিত হয় ; উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ত জলাভূমি (Salt Marsh), যেখানে স্থলজ বাস্তুতন্ত্র ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র পরস্পর মিলিত হয় ; নদীর পাড় বা তীরবর্তী অঞ্চল (Riparian Zone), যেখানে স্থলজ বাস্তুতন্ত্র ও নদীর বাস্তুতন্ত্র পরস্পর মিলিত হয়। আবার আঞ্চলিক স্তরের একটি ইকোটোনের উদাহরণ হল — থাইল্যান্ডের ক্রা ইকোটোন (Kra Ecotone), যা থাই-মালয় উপদ্বীপকে এশিয়ার মূলভূমির সাথে সংযুক্ত করেছে। এটি উত্তরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্দ্র পর্ণমোচী অরণ্য এবং দক্ষিণে সুন্ডাল্যান্ডের আর্দ্র ক্রান্তীয় নিম্নভূমির বৃষ্টিঅরণ্যের মধ্যবর্তী একটি পরিবর্তনশীল অঞ্চল রূপে অবস্থান করছে। ইকোটোনের মধ্যে অধিক পরিমাণে জীববৈচিত্র্য দেখা যায়। কারণ — (১) দুটি বাস্তুতন্ত্রের জীবই ইকোটোন অঞ্চল ব্যবহার করতে পারে। (২) এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীলতা প্রজাতি বৈচিত্র্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। (৩) উদ্ভিদ বৈচিত্র্য বৃদ্ধির ফলে তৃণভোজী পতঙ্গ ও পক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যা শিকারি প্রাণীদেরও আকৃষ্ট করে। (৪) এই অঞ্চল এনার্জি নেট (Energy Net) হিসেবে কাজ করে। এই অঞ্চলের মৃত্তিকাতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ ও পুষ্টি দ্রব্য থাকে। (Topic – Ecotone & Edge Effect)
দুটি বাস্তুতন্ত্রের সংযোগস্থলে যে অধিক পরিমাণে জীববৈচিত্র্য এবং জীবঘনত্বের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়, তার কারণ দুটি ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের প্রান্তীয় প্রভাব বা এজ ইফেক্ট (Edge Effect)। দুটি বাস্তুতন্ত্রের সংযোগস্থলে যে প্রভাবের ফলে অধিক জীববৈচিত্র্য দেখা যায়, তাকে প্রান্তীয় প্রভাব বা এজ ইফেক্ট বলে। অন্যভাবে বলা যায়, পাশাপাশি অবস্থিত দুটি বাস্তুতন্ত্রে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ইকোটোন অঞ্চলে জীব প্রজাতির সংখ্যা এবং ঘনত্ব অধিক পরিমাণে দেখা যায়। একেই এজ ইফেক্ট বলে। যে সব প্রজাতি এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়, তাদের প্রান্তীয় প্রজাতি (Edge Species) বলে। দ্য প্রিন্সটন গাইড টু ইকোলজি (২০০৯) গ্রন্থে ইকোলজিস্ট সাইমন লেভিন বলেছেন, ‘Edge effect is changes in population or community structures that occur at the boundary of two or more habitats’। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকা অনুসারে, ‘The number of species and the population density are greater within the ecotone than in the surrounding communities, a phenomenon known as the edge effect’। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্থলজ বাস্তুতন্ত্রে পক্ষী শ্রেণীর ওপর এজ ইফেক্ট বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। ঘন অরণ্য বা মরুভূমির তুলনায় ইকোটোন বা মিশ্র বসতি অঞ্চলে অনেক বেশি সংখ্যায় পক্ষী বাস করে। ১৯৩৩ সালে আমেরিকান পরিবেশবিদ অ্যাল্ডো লিওপোল্ড তাঁর ‘গেম ম্যানেজমেন্ট’ (Game Management) গ্রন্থে সর্বপ্রথম ‘Edge Effect’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : আলফা, বিটা ও গামা বৈচিত্র্য
এজ ইফেক্টের ফলে দুটি বাস্তুতন্ত্রের সংযোগস্থলের জীবঘনত্ব বা সম্প্রদায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমেরিকান বায়োলজিস্ট ইউজেন ওডাম (১৯৭১) বলেন, ‘The tendency for increased variety and diversity at community junctions is known as the edge effect…’। যেমন, গায়ক পক্ষী (Songbirds) ঘন অরণ্যের থেকে অরণ্যের সীমানায় অধিক পরিমাণে বসবাস করে। প্রান্তীয় প্রভাব বা এজ ইফেক্ট প্রধানত ৬ প্রকারের হয় — (১) সহজাত (Inherent) প্রান্তীয় প্রভাব, অর্থাৎ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য যখন প্রান্তীয় প্রভাব স্থায়িত্ব লাভ করে। (২) আবিষ্ট (Induced) প্রান্তীয় প্রভাব, অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা মানুষের কার্যকলাপ যখন সীমান্ত অঞ্চলে প্রজাতি বৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটায়। (৩) সংকীর্ণ (Narrow) প্রান্তীয় প্রভাব, অর্থাৎ আকস্মিক ভাবে একপ্রকার বসতি শেষ হয়ে অন্যপ্রকার বসতি শুরু হলে যে প্রান্তীয় প্রভাব দেখা যায়। (৪) প্রশস্ত (Wide) প্রান্তীয় প্রভাব, অর্থাৎ ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও উদ্ভিদ সম্প্রদায়ের দুটি নির্দিষ্ট বসতি যখন প্রশস্ত অঞ্চলের মাধ্যমে পৃথক থাকে। (৫) সংবর্ত (Convoulted) প্রান্তীয় প্রভাব, অর্থাৎ যখন দুটি ভিন্ন বসতির প্রান্তীয় অঞ্চল রৈখিক প্রকৃতির নয়। (৬) ছিদ্রাল (Perforated) প্রান্তীয় প্রভাব, অর্থাৎ যখন দুটি ভিন্ন বসতির প্রান্তীয় অঞ্চলে শূন্যস্থান থাকে, যা ভিন্ন বসতি দ্বারা অধিকৃত থাকে।
অরণ্য ও তার পার্শ্ববর্তী বাস্তুতন্ত্রের মধ্যবর্তী প্রান্তীয় অঞ্চলে মানুষের কার্যকলাপে বৃক্ষচ্ছেদন ঘটে থাকে। ফলে অরণ্যে অধিক পরিমাণ সূর্যালোক, বাতাস প্রবেশ করে। সে কারণে অরণ্যের প্রান্তে বৃহৎ বৃক্ষের পরিবর্তে অন্য ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়। অরণ্যের প্রান্তীয় অঞ্চলে বাতাস, আর্দ্রতা, মৃত্তিকার আর্দ্রতা, আলোর প্রভাব, সালোকসংশ্লেষের কার্যকরী বিকিরণ (PAR) সবই পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেমন, আমাজন বৃষ্টি অরণ্যে প্রান্তীয় প্রভাব বা এজ ইফেক্টের কারণে প্রান্তীয় অঞ্চলের অরণ্য অনেকাংশে বিনষ্ট হয়ে গেছে। আমাজন বৃষ্টি অরণ্য সংলগ্ন কৃষিজমি থেকে আগুন অতি সহজেই অরণ্যের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, অধিক পরিমাণে সূর্যালোক প্রবেশ করার জন্য এই অরণ্যের প্রান্তীয় অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বায়োমাস জন্মায়, যা জ্বালানির কাজ করে এবং অরণ্যের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। এরূপ কারণের ফলে ১৯৯০ -এর দশক থেকেই আমাজন বৃষ্টি অরণ্যের প্রান্তীয় জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে এবং অরণ্যের আকার, আয়তন ও চরিত্র — সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। (Topic – Ecotone & Edge Effect)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; Encyclopaedia Britannica ; The Princeton Guide to Ecology – Simon A. Levin – Princeton University ; Encyclopedia of Biodiversity (Second Edition) ; Escuela De Organizacion Industrial ; ভূগোল শিক্ষক (একাদশ শ্রেণী) – হাজরা ও দাস ; Edge Strategy Book
অতি সুন্দর প্রবন্ধ
Pingback: Vishnu's Dashavatara & Evolutionism of Darwin - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Tusu Festival of Rarh Region - ভূগোলিকা-Bhugolika