The Chronicle of Palash of Purulia
পুরুলিয়ার পলাশের কড়চা
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : The Chronicle of Palash of Purulia । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পুরুলিয়া জেলার পলাশ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

‘পিঁদাড়ে পলাশের বন,
পালাব পালাব মন’
— সুনীল মাহাত (পুরুলিয়ার বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক)।
মাঝারি আকারের একপ্রকার পর্ণমোচী বৃক্ষ হল পলাশ (Bastard Teak/Palash)। ফ্যাবেসি (Fabaceae) পরিবারের বিউটিয়া (Butea) গণের অন্তর্গত এই বৃক্ষের বৈজ্ঞানিক নাম বিউটিয়া মনোস্পার্মা (Butea monosperma)। ভারতীয় উপমহাদেশ সহ সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে পলাশ গাছ দেখা যায়। সংস্কৃত ভাষায় ‘কিংশুক’ নামে পরিচিত পলাশ গাছ তার ফুলের জন্যই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। মহাভারতের সভাপূর্বে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের বর্ণনাতে পলাশ বৃক্ষের উল্লেখ রয়েছে। এমনকি মহাকবি কালিদাস রচিত সংস্কৃত নাটক অভিজ্ঞান শকুন্তলমে বর্ণিত প্রমোদ উদ্যানে পলাশের উল্লেখ রয়েছে। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রেও রয়েছে পলাশ ফুলের প্রসঙ্গ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘তোমার অশোকে কিংশুকে/অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে’ (ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় – ১৯৩১)। আবার, দেবকী বসু পরিচালিত সাপুড়ে (১৯৩৯) চলচ্চিত্রে গীতিকার হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল/এনে দে, এনে দে, নইলে বাঁধব না বাঁধব না চুল’ গানটিও উল্লেখ্য।
শীতের শেষদিকে, ফাল্গুনে পলাশ গাছের পাতা ঝরে যায়। এরপরই পলাশ গাছে কুঁড়ি আসে। বসন্তে, চৈত্র মাসে পলাশ গাছে ফুল ফোটে। সাধারণত পলাশ ফুলের রঙ লালচে-কমলা, আগুনের শিখার মতো পলাশ ফুল দেখে মনে হয় — ‘আগুন লেগেছে বনে বনে’। তাই পলাশের আরেক নাম ‘Flame of The Forest’ অর্থাৎ অরণ্যের অগ্নিশিখা। কাস্তের মতো বাঁকানো পলাশ ফুল ২ থেকে ৪ সেমি লম্বা হয়, তবে থোকায় সজ্জিত পলাশের পুষ্পস্তবক ১৫ সেমি অবদি লম্বা হয়। পলাশ ফুলের পাপড়ি মখমলের নরম। ফুলের কুঁড়ি দেখতে অনেকটা বাঘের নখের মতো। পলাশের ফল দেখতে অনেকটা শিমের মতো, যা ১৫-২০ সেমি লম্বা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যানপালন দপ্তরের আধিকারিক ড. সমরেন্দ্রনাথ খাঁড়ার তথ্যমতে, পলাশ ফুল চার রঙের – লালচে-কমলা, হলুদ, সাদা ও নীল রঙের হয়। হলুদ ও সাদা পলাশ তুলনামূলক অনেক কম দেখা যায় এবং নীল রঙের পলাশ বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল।
(The Chronicle of Palash of Purulia)
বিভিন্ন অঞ্চলে পলাশ পাওয়া গেলেও, পুরুলিয়ার পলাশ এতো বিখ্যাত কেন? প্রতিবছর বসন্তে পুরুলিয়ার বনাঞ্চল লাল পলাশে সেজে ওঠে। অযোধ্যা পাহাড় থেকে বান্দোয়ান, নিতুড়িয়া থেকে কাশীপুর — পলাশের সৌন্দর্যে যেন চোখ ফেরানো যায় না। পুরুলিয়া জেলার প্রায় ২৩ লক্ষ পলাশ গাছ বসন্তে জঙ্গলমহলের এই জেলার রূপই বদলে দেয়। পুরুলিয়া জেলায় সবচেয়ে বেশি পলাশ গাছ রয়েছে পুরুলিয়া বন বিভাগে। তবে কংসাবতী উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগেও যথেষ্ট সংখ্যায় পলাশ গাছ রয়েছে। বনদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পুরুলিয়া বন বিভাগের মধ্যে বাঘমুন্ডি বনাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পলাশ গাছ রয়েছে। উল্লেখ্য, পুরুলিয়া জেলাতে চার ধরনের পলাশ দেখতে পাওয়া যায়। যথা — লালচে-কমলা পলাশ, হলুদ পলাশ, সাদা বা শ্বেতপলাশ এবং লতা পলাশ। লালচে-কমলা ও হলুদ পলাশের গোত্র, পরিবার, প্রজাতি একই। গাছের চেহারাও অভিন্ন। পার্থক্যটা শুধু ফুলের রঙে। তবে, লতা পলাশ ফ্যাবেসি পরিবারেরই একটি ভিন্ন প্রজাতি, যার বৈজ্ঞানিক নাম বিউটিয়া সুপার্বা (Butea superba)। লতা পলাশ কোনো গাছকে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠে। এদের ফুল লাল হয়। পলাশ গাছের চেয়ে এদের ফুল ও পাতা বড়ো হয়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : আন্টার্কটিকার রক্ত প্রপাত
সারা পুরুলিয়া জুড়েই কমবেশি লালচে-কমলা রঙের পলাশ দেখা যায়। তবে বাঘমুন্ডি এলাকা পলাশের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয়। এখানে মাঠা বনাঞ্চলে একটি গ্রামেরই নাম পলাশ গ্রাম (Palash Village)। হলুদ পলাশ পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর থানার বেড়ো পাহাড় এবং সাঁতুড়ি, নিতুড়িয়ার বিভিন্ন জঙ্গলে দেখা যায়। সাম্প্রতিক কালে, পুরুলিয়ার হুড়ার একটি গ্রামে খোঁজ মেলে সাদা বা শ্বেতপলাশ গাছের। বিরল শ্বেত পলাশের গাছের ইজারার দর ওঠে প্রায় ৮০ লাখ টাকা। কেন শ্বেতপলাশের এতো চাহিদা? শ্বেত পলাশের ছাল, পাতা, ফুল, বীজ ও গাছের আঠা ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ, যৌনশক্তি বর্ধক ওষুধ তৈরি হয় এই শ্বেতপলাশ থেকে। ধর্মীয় মতে, শিবঠাকুরের নাকি ভীষণ প্রিয় এই শ্বেত পলাশ। সারা ভারত জুড়ে শ্বেতপলাশ ফুল তন্ত্রসাধনার কাজে লাগানো হয়। আর লতা পলাশ দেখা যায় পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে।
(The Chronicle of Palash of Purulia)
পলাশ ফুল থেকে ভেষজ আবির তৈরি করা হয়। ২০১৭ সালে পুরুলিয়ার বলরামপুরে প্রশাসনিক উদ্যোগে পলাশ ফুল থেকে ভেষজ আবির তৈরি শুরু হয়। ২০২২ সালে বিট, নিম আর পলাশের নির্যাস দিয়ে প্রথমবার ‘বাহা সাঁদেশ’ আবির তৈরি করেছেন পুরুলিয়ার বেড়সা গ্রামের বীরহোড় জনগোষ্ঠীর মহিলারা। ২০২২ সালে পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পলাশ ফুল থেকে ভেষজ আবির তৈরি করে। শুধু ভেষজ আবিরই নয়, পলাশের আরও অনেক গুণ রয়েছে। পলাশ গাছ লাক্ষা উত্পাদনে প্রধানত ব্যবহার করা হয়। পলাশের ছাল/বাকল থেকে যে আঠা পাওয়া যায় তা ‘বেঙ্গল কিনো’ নামে প্রসিদ্ধ, যা ঔষধ শিল্পে ও কাপড় রঙ করতে ব্যবহার করা হয়। কাপড়ে রঙ করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। পলাশ বীজের গুঁড়ো কীটপতঙ্গ নাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। একজিমা, চুলকানি, র্যাশ ইত্যাদি চর্মরোগ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পলাশ বীজ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ও গাঁটের ব্যথা, অর্শ, মূত্রনালীর সংক্রমণ উপশমেও পলাশ ফুল, কুঁড়ি ও বীজ ব্যবহার করা হয়।
পলাশ পার্শ্ববর্তী ঝাড়খন্ড রাজ্যের ‘রাজ্য ফুল’ (State Flower) হলেও, পুরুলিয়াতে পলাশ নিয়ে আবেগ ও উদ্দীপনা কিছু কম নয়। বসন্তে পুরুলিয়ার স্থানে স্থানে পলাশকে কেন্দ্রে নানা উৎসব আয়োজিত হয়। পুরুলিয়ার দেউলঘাটায় প্রাচীন মন্দিরের দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে পলাশ উৎসব (Palash Festival) হয়। অযোধ্যা পাহাড়ে প্রতি বসন্তে পলাশ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দোল ও হোলি এই দু’টো দিনে অযোধ্যা পাহাড় পলাশ উৎসবে মেতে ওঠে। নিষ্পত্র সরু-সরু ডালে কালো-কালো কুঁড়ি ফাটিয়ে সিঁদুরে লাল পাপড়ির পলাশ পুরুলিয়া জেলার পর্যটনের নতুন ট্রেন্ড। পলাশ কেন্দ্রিক পর্যটন এবং পলাশের ভেষজ ও ঔষধি ব্যবহারের মাধ্যমে পুরুলিয়া জেলার গ্রামীণ অর্থনীতি এক নতুন দিশা পেতে পারে।
(The Chronicle of Palash of Purulia)
লেখিকাঃ- চৈতালী মাহাত (বিশপুরিয়া, হুড়া, পুরুলিয়া)
তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা ; প্রথম আলো ; সংবাদ প্রতিদিন ; বর্তমান পত্রিকা ; হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা ; এই সময়
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: লতা পলাশ সম্পর্কিত তথ্য ও ছবি: সুপ্রিয় সামন্ত (বাঘমুন্ডি, পুরুলিয়া)
Congratulations 🎉