Thanjavur – Granary of South India
থাঞ্জাভুর – দক্ষিণ ভারতের শস্যভান্ডার
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Thanjavur – Granary of South India । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি ‘দক্ষিণ ভারতের শস্যভান্ডার’ রূপে পরিচিত তামিলনাড়ুর ‘থাঞ্জাভুর জেলা’ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ভারতবর্ষের কয়েকটি নদীবিধৌত সমভূমি অঞ্চল কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতির জন্য ‘শস্যভান্ডার’ (Granary) রূপে পরিচিত। সেইরূপ, দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু (Tamil Nadu) রাজ্যের থাঞ্জাভুর জেলা (Thanjavur District) কৃষিজ উৎপাদনে অগ্রণী হওয়ার কারণে ‘দক্ষিণ ভারতের শস্যভান্ডার’ (Granary of South India) নামে পরিচিত। কাবেরী নদীর বদ্বীপ (Kaveri River’s Delta) অঞ্চলে অবস্থিত থাঞ্জাভুর জেলা ‘তামিলনাড়ুর ধানের গোলা’ (Rice Bowl Of Tamil Nadu) নামেও পরিচিত। মধ্য তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর জেলার অক্ষাংশগত বিস্তৃতি হল ০৯°৫০′ উত্তর থেকে ১১°২৫′ উত্তর এবং দ্রাঘিমাগত বিস্তৃতি হল ৭০°২৩′ পূর্ব থেকে ৭৮°৪৩′ পূর্ব (সূত্র: Official Website of Thanjavur District)। থাঞ্জাভুর জেলার আয়তন ৩৩৯৬.৫৭ বর্গকিমি, যা তামিলনাড়ুর মোট আয়তনের মাত্র ২.৬%। এই জেলা প্রশাসনিকভাবে ৩ টি মহকুমাতে ও ১৪ টি ব্লকে বিভক্ত এবং জেলাসদর হল থাঞ্জাভুর শহর (Thanjavur City)।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মুর্শিদাবাদের আহিরণ বিল
থাঞ্জাভুর জেলা ভূপ্রকৃতিগত ভাবে কাবেরী নদী (Kaveri River) -এর বদ্বীপ সমভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। কাবেরী এবং বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা (গ্র্যান্ড অ্যানিকাট ক্যানাল, কোল্লিদাম নদী, কোদামূর্তি নদী, ভেন্নার নদী, ভেত্তার নদী, আরসলার নদী প্রভৃতি) -এর দ্বারা অঞ্চলে পলি সঞ্চিত হয়ে উর্বর সমভূমি গড়ে তুলেছে। এই জেলার জলবায়ু আর্দ্র ক্রান্তীয় (Moist Tropical) প্রকৃতির। থাঞ্জাভুর জেলার গড় বার্ষিক সর্বোচ্চ উষ্ণতা ২৭-৩৭ ডিগ্রি C, গড় বার্ষিক সর্বনিম্ন উষ্ণতা ২২-২৭ ডিগ্রি C এবং গড় বার্ষিক স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭৬৩-১১৭৯ মিমি। এই জেলাতে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু (অক্টোবর-ডিসেম্বর) -এর দ্বারা বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে। থাঞ্জাভুর জেলাতে মূলত বাদামী পলি মৃত্তিকা (Brown Alluvial Soil), লোহিত মৃত্তিকা (Red Soil) ও কৃষ্ণ মৃত্তিকা (Black Soil) দেখা যায়। সমতল ভূপ্রকৃতি, উর্বর মৃত্তিকা, অনুকূল জলবায়ু, জলসেচের সু্বিধা প্রভৃতি কারনেই এই জেলা কৃষিকাজে বিশেষ অগ্রগতি লাভ করেছে। থাঞ্জাভুর জেলার ভূমি ব্যবহারের প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জেলার মোট আয়তনের ৫৬.৫% কৃষিকাজ (Net Sown Area) -এর অন্তর্গত ; যা থেকে এই জেলার নিবিড় কৃষিকাজ সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মাজুলি – ভারতের বৃহত্তম নদী দ্বীপ
থাঞ্জাভুর জেলাতে উৎপাদিত প্রধান কৃষিজ ফসলগুলি হল — ধান, মাসকলাই ডাল, আখ, চিনাবাদাম, তিল প্রভৃতি। তামিলনাড়ুর কৃষি দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জানা যায়, ২০১৭-১৮ সালে থাঞ্জাভুর জেলাতে ৬.৬৮ লক্ষ টন ধান উৎপাদিত হয়েছিল, যা তামিলনাড়ুর মোট ধান উৎপাদনের ১০%। একই ভাবে, ওই কৃষিবর্ষে এই জেলাতে উৎপাদিত মোট ডালশস্যের পরিমাণ ছিল ৩১,৯৩১ টন, যা তামিলনাড়ুর মোট ডালশস্য উৎপাদনের ৫.৭%। এছাড়া ওই কৃষিবর্ষে থাঞ্জাভুর জেলাতে তামিলনাড়ুর মোট চিনাবাদাম উৎপাদনের ৩.২৫%, মোট তিল উৎপাদনের ৪.৮%, মোট আখ উৎপাদনের ২.৮% উৎপাদিত হয়েছিল। উদ্যান কৃষির প্রেক্ষাপটে, ২০১৭-১৮ কৃষিবর্ষে এই জেলাতে ২,৪৫,৩০৮ টন কলা, ২২৬৯ টন বেগুন, ৫০৫ টন ঢ্যাঁড়শ, ১৩,২৮২ টন আম, ১২৫১ টন কাঁঠাল, ৬২৩ টন পেয়ারা, ৫৩২ টন পেঁয়াজ, ৩৪২ টন কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়েছিল।
বর্তমান থাঞ্জাভুর জেলার কৃষিজ উৎপাদনের পরিসংখ্যান সর্বাংশে এই জেলাকে ‘দক্ষিণ ভারতের শস্যভান্ডার’ রূপে প্রতিভাত করেনা। কারন ৩ দশক আগে, ১৯৯১ সালে তৎকালীন থাঞ্জাভুর জেলা ভেঙে নাগাপট্টিনাম জেলা গঠন করা হয়। আবার, ১৯৯৭ সালে নাগাপট্টিনাম জেলা ভেঙে থিরুভারুর জেলা গঠন করা হয়। সর্বশেষ, ২০২০ সালে নাগাপট্টিনাম জেলা ভেঙে মায়িলাদুথুরাই জেলা গঠন করা হয়। কাবেরী নদী বদ্বীপ সমভূমিতে অবস্থিত এই ৩ জেলা — নাগাপট্টিনাম জেলা (আয়তন ১৩৯৭ বর্গকিমি), থিরুভারুর (আয়তন ২১৬১ বর্গকিমি) ও মায়িলাদুথুরাই (আয়তন ১১৭২ বর্গকিমি) পূর্বে থাঞ্জাভুর জেলা-এর অন্তর্গত ছিল। এই অধুনালুপ্ত, অবিভক্ত পূর্বতন থাঞ্জাভুর জেলা-ই হল প্রকৃতপক্ষে ‘দক্ষিণ ভারতের শস্যভান্ডার’। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৭-১৮ কৃষিবর্ষে বর্তমান থাঞ্জাভুর, মায়িলাদুথুরাই সহ নাগাপট্টিনাম ও থিরুভারুর জেলার মোট ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৮.১৫ লক্ষ টন, যা তামিলনাড়ুর মোট ধান উৎপাদনের ২৭.৩%। ২০১৭-১৮ কৃষিবর্ষে বর্তমান থাঞ্জাভুর, মায়িলাদুথুরাই সহ নাগাপট্টিনাম ও থিরুভারুর জেলাতে তামিলনাড়ুর মোট ডালশস্য উৎপাদনের ১৭.২% উৎপাদিত হয়েছিল।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সুন্দরবনের মাছ
থাঞ্জাভুর জেলা সহ সমগ্র কাবেরী নদী বদ্বীপ অঞ্চল উন্নত কৃষিকাজের জন্য সুপরিচিত হলেও, এই অঞ্চলে কৃষিকাজের প্রধান সমস্যাগুলি হল — কৃষিজ পণ্যের পর্যাপ্ত সংরক্ষণের অভাব ; অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ; অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টিপাত প্রভৃতি। এছাড়া সাম্প্রতিক কালে থাঞ্জাভুর সহ তামিলনাড়ুর কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চলের জেলাগুলিতে কৃষক আত্মহত্যার একাধিক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (NADP), প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনা (PMKSY) প্রভৃতি কর্মসূচী ও প্রকল্প কৃষি-উন্নয়নের বিশেষ সহায়ক হয়েছে। ২০২০ সালে তামিলনাড়ু সরকার থাঞ্জাভুর সহ সমগ্র কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চলকে ‘স্পেশাল প্রোটেকটেড অ্যাগ্রিকালচারাল জোন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর দ্বারা এই অঞ্চলে কোনো হাইড্রো-কার্বন প্রকল্পকে অনুমতি দেওয়া হবেনা। শুধুমাত্র চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে উৎসাহ দেওয়া হবে। পরিশেষে, জৈন সন্ন্যাসী ইলাঙ্গো আদিগল রচিত তামিল মহাকাব্য ‘সিলাপ্পাথিকরম’-এর একটি পঙক্তি তুলে ধরলাম —
‘ভালি অভন্তন ভালানাটু/মাকাভায় ভালারক্কুম তায়াকি/উলি উইক্কুম পেরুতাভি/ওলিয়াই ভালি কাবেরী’। অর্থাৎ — দীর্ঘজীবী হোক এই উর্বর দেশ! দীর্ঘজীবী হোক কাবেরী, যা মায়ের মতো এই দেশকে লালনপালন করে।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Thanjavur District/ENVIS ; National Agricultural Development Programme/Thanjavur District ; Thanjavur District/NICRA-ICAR ; SAIDP/Tamil Nadu ; Government of Tamil Nadu, India ; District Official Website/Thanjavur District ; Wikipedia ; Land Use & Land Cover Using Remote Sensing & GIS Techniques – A Case Study of Thanjavur District, Tamil Nadu, India – J Punithavathi & Rajagopalan Baskaran ; Hindustan Times ; Down To Earth
Pingback: Tourism - Biharinath Hill of Bankura - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Matla River of Sundarban - ভূগোলিকা-Bhugolika