Sundarban & Life – Livelihoods
সুন্দরবন এবং জীবন-জীবিকা
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Sundarban & Life – Livelihoods । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সুন্দরবনের জীবন-জীবিকা সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ভারত ও বাংলাদেশের গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আয়তন ১০,২৭৭ বর্গকিমি (জলভাগ সহ), যার মধ্যে ৪২৬০ বর্গকিমি ভারতের অন্তর্গত এবং ৬০১৭ বর্গকিমি বাংলাদেশের অন্তর্গত (JISCAR-২০১৩)। অসংখ্য ছোটোবড়ো নদনদী ও খাঁড়িতে পরিপূর্ণ সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলাতে অবস্থিত ভারতীয় সুন্দরবন ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং ২০১৯ সালে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃত লাভ করেছে। তবে, সুন্দরবন শুধুমাত্র পরিবেশগত দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নয়, পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য এক বিরাট আয়ের উৎস হল সুন্দরবন। পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দারা সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল ; কারণ তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে এই সুন্দরবন (Sundarban & Life – Livelihoods)।
সুন্দরবন বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবিকার উৎস, মৎস্যজীবী এর মধ্যে অন্যতম। ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলের প্রধান নদনদী গুলি হল : মাতলা, বিদ্যাধরী, হাঁড়িভাঙ্গা, ঠাকুরান, সপ্তমুখী, গোসাবা, রায়মঙ্গল প্রভৃতি। বংশ পরম্পরায় সুন্দরবনের ছোটোবড়ো নদী-খালে জেলেরা মাছ ধরেন। ভারতের সুন্দরবনে ১৭২ প্রজাতির মাছ এবং ২০ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায় (সূত্র : ইন্ডিয়া ক্লাইমেট ডায়লগ)। সুন্দরবনের মাছ মূলত দুই ধরনের : সাদা মাছ (অর্থাৎ গলদা-বাগদা বাদে সমস্ত মাছ) এবং গলদা-বাগদা চিংড়ি। সুন্দরবনের নদী-খালে জেলেদের জালে যে মাছগুলি সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে, সেগুলি হল : গলদা, বাগদা, ইলিশ, কাইন মাগুর, রূপচাঁদা, টেকচাঁদা, দাতিনা, ট্যাংরা, তোপসে, পোয়া, ভোলা ভেটকি, পারশে, লইট্টা প্রভৃতি। সুন্দরবনের নদী-খালে মৎস্যজীবীদের একাংশ চিংড়ির মীন (চারা) ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। চৈত্র থেকে জৈষ্ঠ্য মাস মীন সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলে এবং এই কাজে গ্রামীণ মহিলাদের একটি বড়ো অংশ যুক্ত রয়েছেন। কাকদ্বীপ, সাগর, পাথরপ্রতিমা, ক্যানিং, রায়দিঘি-সহ দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় মীন সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া, সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের একাংশ কাঁকড়া (Clappa, Matuta, Scylla ইত্যাদি) ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবা, ঝড়খালি-সহ বিভিন্ন এলাকায় কাঁকড়া সংগ্রহের আড়ত রয়েছে। সুন্দরবনের কাঁকড়া বিদেশে (প্রধানত চিন, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে) রপ্তানি করা হয়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস
সুন্দরবনে কাঠুরিয়া ও গোলপাতা সংগ্রহকারীরা বাওয়ালি নামে পরিচিত। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাওয়ালিরা সুন্দরবনে অবস্থান করেন। পশ্চিমবঙ্গের বন দফতর (২০২০) সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন থেকে কাঠ কাটার জন্য কম-বেশি ৩৪০টির মতো নৌকাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকে এবং এজন্য বারো-তেরো হাজার টন কাঠ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে নির্দিষ্ট এই পরিমাণের থেকে একশো গুণ বেশি কাঠ চোরাপথে জঙ্গল থেকে কেটে নিয়ে আসছে এক ধরনের অসাধু চক্র। এই অসাধু চক্র ধ্বংস করছে বিরল প্রজাতির বিভিন্ন গাছ, যা কাটা নিষিদ্ধ। সুন্দরবন এলাকার বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, গোসাবা, স্যান্ডেলের বিল, শামসেরনগর, বাসন্তী, ঝড়খালি প্রভৃতি স্থানের হাটে গেলে দেখা যাবে, প্রচুর পরিমাণে বড় বড় গাছের গুঁড়ি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় অধিবাসীরা সুন্দরবন থেকে জ্বালানি কাঠ (গরান, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া প্রভৃতি) সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই জ্বালানি কাঠ কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, ঝড়খালি প্রভৃতি এলাকার বাজারে বিক্রি করা হয়। এছাড়া ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে। যেমন : ট্যানিন উৎপাদন, চর্মরোগের ওষুধ তৈরি প্রভৃতি কাজে লাগে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সুন্দরবনের মাছ
সুন্দরবন বনজ মধুর জন্য বিশ্ববিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস হল সুন্দরবন। সুন্দরবন অঞ্চলে মধু সংগ্রহকারীরা মৌলে বা মৌয়াল নামে পরিচিত। সুন্দরবনে অনেক ধরনের মধু পাওয়া যায়। সাধারণত চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস অবদি খলিশা ফুলের মধু পাওয়া যায়। এই মধু দেখতে সাদা রঙের, গাঢ় ও অনেক বেশি মিষ্টি। খলিশা ফুলের মধুই সুন্দরবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে দামী মধু। এছাড়া গরান ও পশুর ফুলের মধু (লালচে রঙের), কেওড়া ফুলের মধু (সাদা রঙের, স্বাদে টক-মিষ্টি), বাইন ফুলের মধু, গেঁওয়া ফুলের মধু প্রভৃতি মধু পাওয়া যায়। মধু সংগ্রহ সুন্দরবনের সবচেয়ে বিপদজনক জীবিকা, কারন এজন্য বাদাবনের অনেক ভেতরে মৌলিরা প্রবেশ করে থাকেন। যে কারণে মৌলেদের বাঘের আক্রমণের মুখে অনেক সময় পড়তে হয়। তাই সুন্দরবনের বনজ মধুকে ‘রক্ত মধু’ (Blood Honey) বলা হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক কালে কয়েকটি সমবায় সমিতির মাধ্যমে মধু চাষ শুরু হয়েছে। ২০২০-২১ এর তথ্য অনুসারে, সুন্দরবনে বনজ ও চাষকৃত মধুর মোট পরিমাণ ছিল ১১১ টন (সূত্র : The Hindu Business Line)। ২০২৪ সালে ভারত সরকারের জি.আই. মর্যাদা পেয়েছে সুন্দরবনের মধু (মৌবন : পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগম)।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস
সুন্দরবনের চিরসবুজ সৌন্দর্য, রূপ-মাধুর্য ; জীববৈচিত্র্যের সমাহারে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ ও সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভে প্রতি বছর গড়ে ১.৫-২ লক্ষ পর্যটকের সমাগম হয়। সুন্দরবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্যটনস্থল হল : ভগবৎপুর, লোথিয়ান দ্বীপ, বনি ক্যাম্প, কলস ক্যাম্প, হ্যালিডে দ্বীপ, সজনেখালি, সুধন্যখালি, দোবাঁকি, বুড়ির ডাবরি প্রভৃতি। সাধারণত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি — এই পাঁচ মাসই পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ইলিশ উৎসবকে কেন্দ্র করে বর্ষার ভরা মরসুমে রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে এসেছেন। আর এই পর্যটন শিল্পই হল সুন্দরবনের বাসিন্দাদের একটা বড়ো অংশের জীবন-জীবিকার উৎস। পর্যটনকে কেন্দ্র করে হোটেল, লজ, ট্যুরিস্ট গাইড, জলযান (লঞ্চ-নৌকা-ভুটভুটি) — বিবিধ কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। তবে, সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প এখনও অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
সুন্দরবনের প্রকৃতি-পরিবেশ এবং সুন্দরবনের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। পরিবেশবিদদের বক্তব্য, সুন্দরবন বলতে শুধু রয়্যাল বেঙ্গলের আবাস বাদাবন বা ম্যানগ্রোভ অরণ্য বোঝায় না। সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ এবং অসংখ্য গ্রামে ৪৫ লক্ষ মানুষের বসবাস। যাঁদের অধিকাংশেরই জীবন ও জীবিকা সুন্দরবনের পর্যটন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে নির্ভরশীল। তাই, সুন্দরবনের বিপদ হলে তাঁরাও মহাবিপদে পড়বেন। আবার তাঁরা জীবিকা হারালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবনও। এই পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল উন্নয়নের মাধ্যমে কিভাবে পরিবেশ-প্রকৃতির সংরক্ষণ এবং সুন্দরবনের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত করা যায়, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (Sundarban & Life – Livelihoods)।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকাঃ- সরবানী হালদার (ভুষির চক, কুলতলি, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; প্রথম আলো ; Journal of the Indian Society of Coastal Agricultural Research ; The Hindu Business Line ; India Today ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; সংবাদ প্রতিদিন ; এই সময়
Pingback: Biological Diversity to Biodiversity - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Dooars of South - Jhaluarber - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Spatial Distribution of Vegetation in Sundarban - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Jarawa Tribe of Andaman Islands - ভূগোলিকা-Bhugolika