Sundarban – Epicenter of Gynaecological Diseases
স্ত্রীরোগের আঁতুড়ঘর সুন্দরবন
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Sundarban – Epicenter of Gynaecological Diseases । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সুন্দরবন অঞ্চলে স্ত্রীরোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এবং ম্যানগ্রোভ অরণ্য হল সুন্দরবন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বিস্তৃত সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যের নিরিখে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন অঞ্চলে আর্থিকভাবে অনগ্রসর, শ্রমজীবী, প্রান্তিক বিপুল সংখ্যক মানুষজন কখনো চাষবাস, কখনো জঙ্গলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আবার, নদী তীরবর্তী অঞ্চলের ভূমিহীন বাসিন্দাদের অধিকাংশই নদী-খালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখানে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও নদী থেকে মীন (বাগদা চিংড়ির বাচ্চা) ধরে জীবিকা অর্জন করেন। এদের মৎস্যজীবী হিসেবে ধরা হয়। ভারতের সুন্দরবন মূলত পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ২৯টি ব্লক নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে সাতটি ব্লকের (গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, রায়দিঘি, সন্দেশখালি ও হিঙ্গলগঞ্জ) প্রচুর সংখ্যক মহিলা নদীতে বাগদার মীন ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রকৃতির প্রিয়জন সেন্টিনেলি
সুন্দরবনের আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অসংখ্য গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের উপার্জনের একমাত্র উপায় চিংড়ির মীন। দিনের আলো ফোটার আগে নদী-খাল-খাঁড়িতে মীন ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্রামের মহিলারা। মৎস্যজীবী স্বামী যখন মাঝ দরিয়ায়, তখন সংসার সামলাতে মহিলারা যান মীন সংগ্রহের জন্য। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা দেখার জো নেই, হিসেব শুধু জোয়ার-ভাটা। ঘড়ি লাগেনা জলের শব্দেই ওরা বুঝে যান, কখন জোয়ার আর কখন ভাটা। কোমর সমান নোনা জলে জাল টেনে শরীর অবশ হয়ে আসে। কিন্তু, ছাড়লে চলবে না, ওটাই যে অন্ন সংস্থানের উপায়। সুন্দরবনের রায়মঙ্গল, বিদ্যাধরী, কালিন্দী, গৌড়েশ্বর, বড় কলাগাছি, ছোট কলাগাছি, সাহেবখালি, ডাসা, রামপুর, বেতনি, ঘটিহারা প্রভৃতি নদীতে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ, বিশেষত মহিলারা মীন ধরেন। নদীতে ভাটা লাগে, তাঁরা মীন ধরতে নেমে পড়েন দলবেঁধে। সঙ্গে বাঁশের চটার ফ্রেমে ঘন মশারির নেট লাগানো টানা জাল আর একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। ৩-৪ ঘণ্টা টানা জলে থেকে মীন সংগ্রহ করে থাকেন। জোয়ার এলে উঠে পড়েন, আবার ভাটা এলে নেমে পড়েন। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে এই ওঠানামার রোজনামচা।
এক হাজার মীন ধরতে গড়ে ৪-৫ দিন সময় লাগে। সাপের কামড়, নদীতে ফেলে দেওয়া কাঁচের বোতল ভাঙায় পা কেটে যাওয়া, স্রোত ঠেলে হেঁটে কোমর ব্যথা — সবই অগ্রাহ্য করেন জীবন চালানোর তাগিদে। সাথে জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ। এক একটা বাগদার মীন বিক্রি করে তাঁরা মাত্র ৩০-৫০ পয়সা পেয়ে থাকেন। মীন বিক্রির কোন জায়গা নেই। ব্যবসায়ীদের দেওয়া দামেই মীন বিক্রি করতে হয়। ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে দ্বিগুণ দামে বাগদার মীন চলে যায় মেছোঘেরিতে। তারপর দেশবিদেশে বাগদা চিংড়ি রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এমনিতে, সুন্দরবনের নদীতে টানা জালে মীন ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুন্দরবন এবং তার জলজ প্রাণী সম্পদকে রক্ষা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইনল্যান্ড ফিশারিজ অ্যাক্ট ১৯৮৪ অনুসারে, নদীতে বা উন্মুক্ত জলাশয়ে ১২ মিমি বা তার কম কোনও ফাঁস জাল, চট জাল ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু আইনের চেয়ে বড়ো বালাই পেটের জ্বালা। দীর্ঘ সময় নোনা জলে থাকার ফলে মীন সংগ্রহকারী মহিলাদের শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে, যা তাঁদের ভাষায় ‘নোনা ধরা’। (Sundarban – Epicenter of Gynaecological Diseases)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ্ রিসার্চ’ (DHR)-এর ২০১৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে, সুন্দরবনের ৫৩ শতাংশ মহিলাই নানা স্ত্রীরোগের শিকার। সুন্দরবনের সাতটি ব্লকের ৩৩টি দ্বীপের মহিলাদের উপরে সমীক্ষা করে ওই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। আর, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ রিসার্চ -এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় (২০২০) দেখা গেছে, সুন্দরবনের প্রায় লক্ষাধিক মহিলারা ভুগছেন স্ত্রীরোগে। এবিষয়ে গোসাবা ব্লক হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এক চিকিৎসক বলেন, প্রতিনিয়ত নোনা জলে নামার ফলে বিভিন্ন অসুখ দানা বাঁধছে। কারণ মাছ ধরার জন্য নদীতে মহিলাকে কখনো কোমর কখনো আবার গলা পর্যন্ত জলে ডুবে থাকতে হচ্ছে। যে সমস্ত মহিলারা স্ত্রীরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে সাদা স্রাব ও মূত্রনালী সমস্যার আধিক্যই বেশি। জলবাহিত জীবাণু বা দূষণের জন্য যোনিপথে সংক্রমণ হচ্ছে। তার সঙ্গে আছে পরিচ্ছন্নতার অভাব। চিকিৎসকেরা দেখেছেন, এইসব প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের অযথা রক্তক্ষরণ এবং ইন্টারকোর্সে ব্যথা, ইউরিনারি ট্র্যাকে সংক্রমণের জন্য প্রস্রাবের জ্বালা ভোগ করতে হয়। যোনি, গর্ভাশয়ে সংক্রমণ ও পিআইডির সমস্যা এই এলাকায় প্রচুর। নোনাজলে কাজ করে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের মতো রোগের প্রকোপও বাড়ছে। সুন্দরবন কার্যত স্ত্রীরোগের আঁতুড়ঘর।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শ্যামল চক্রবর্তী নিয়মিত মেডিক্যাল ক্যাম্প করেন সুন্দরবনের বানভাসি গ্রামগুলিতে। তাঁর মতে, ‘জনস্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে অনেকটাই। আমরা প্রেগনেন্ট মহিলাদের নুন কম খেতে বলি, কিন্তু লিটারে প্রায় ২০ গ্রাম নুন রয়েছে এখানকার জলে। নোনাজলে যোনিপথ স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে। গর্ভপাতের কেসও পাচ্ছি।’ স্ত্রীরোগের আঁতুড়ঘর সুন্দরবন তাই কোমর জলেই আমগ্ন! তাই, সুন্দরবনকে বাঁচানো মানে শুধুমাত্র ম্যানগ্ৰোভ রোপণ বা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নয়, সুন্দরবন উন্নয়নে এই এলাকার কিশোরী থেকে বৃদ্ধা সকল বয়সের নারীর জনস্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা দরকার।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকাঃ- তামশ্রী হালদার (পশ্চিম জটা, মথুরাপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- সংবাদ প্রতিদিন ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; DW ; এই সময় ; Wikipedia ; Sundarban Biosphere Reserve
Pingback: Only Fossil Park in West Bengal - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Well of Hell of Yemen - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: History of India in Geographical Context - ভূগোলিকা-Bhugolika
Very Nice…
Outstanding