Sisal Cultivation in Tribal Development
আদিবাসী উন্নয়নে সিসল চাষ
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Sisal Cultivation in Tribal Development । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি আদিবাসী উন্নয়নে সিসল চাষ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

আদিবাসী অর্থাৎ আদিম নিবাসী ; কোনো ভূখন্ডে প্রাচীনকাল থেকে যেসব জনগোষ্ঠী নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে বসবাস করে আসছে, তারাই হল আদিবাসী (Indigenous People)। বর্তমানে ভারতের আদিবাসীরা তপশীলি উপজাতি (Schedule Tribes) জনসমাজ নামে পরিচিত। বর্তমান ভারতে তপশীলি উপজাতিভুক্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭০৫ এবং ২০১১ জনগণনা অনুসারে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.৬% হল তপশীলি উপজাতি। ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের একটি প্রধান বসতি অঞ্চল হল মধ্য ভারতের মালভূমি। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। একথা সত্য যে, স্বাধীনতার সাত দশক পরেও ভারতের আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আশানুরূপ হয়নি। গড় শিক্ষার হারে পিছিয়ে থাকা ; মোট জনসংখ্যার এক বড়ো অংশের দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান ; কৃষিনির্ভরতা ও কৃষিতে স্বল্প উৎপাদনশীলতা প্রভৃতি হল আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুব একটা আশাব্যঞ্জক না হওয়ার মূল কারণ।
মধ্য ভারতের মালভূমি অঞ্চলের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ আদিবাসীদের অধিকাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষি। কৃষির সঙ্গে যুক্ত আদিবাসীদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক প্রকৃত কৃষক, বেশিরভাগই কৃষি-শ্রমিক। কৃষি-শ্রমই হল গ্রামীণ অঞ্চলের প্রধান কর্মসংস্থান। তাই কৃষি-উন্নয়নই পারে আদিবাসী সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে। যদিও, প্রাকৃতিক ভাবেই এই অঞ্চল কৃষির পক্ষে বিশেষ উপযোগী নয়। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অনুর্বর মৃত্তিকা, স্বল্প সেচ-সেবিত জমি, চিরাচরিত কৃষি-পদ্ধতি প্রভৃতির পাশাপাশি বর্তমানে এই অঞ্চলের কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনেরও বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ফলে, পরিবর্তিত জলবায়ুতেও উৎপাদন ও মুনাফা বৃদ্ধিকারী নতুন শস্যের চাষই আদিবাসী কৃষকসমাজের অবনতি রোধ করতে পারে। যার একটি সার্থক উদাহরণ হল সিসল চাষ (Sisal Cultivation)। সিসল এই অঞ্চলের কোনো নতুন উদ্ভিদ নয়। কয়েক শতক ধরে এই অঞ্চলের প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে সিসল বেঁচে আছে। অযত্ন ও অবহেলায় অল্প-স্বল্প সিসল চাষও হয়। কিন্তু আর্থ-সামাজিক উন্নতি ঘটাতে প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যাপক সিসল চাষ ও সিসল তন্তু উৎপাদন। (Sisal Cultivation in Tribal Development)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মুর্শিদাবাদের রেশম শিল্প
সিসল (বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাগেভে সিসলানা / Agave sisalana) হল এসপ্যারাগাছি উদ্ভিদ পরিবারভুক্ত, বহুবর্ষজীবী একটি মরু উদ্ভিদ। উষ্ণ আবহাওয়াতে, অনুর্বর বা পতিত ও ঢালু জমিতে, জলসেচ ছাড়াই সিসল চাষ করা যায়। সিসল সহজে রোগ ও কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হয়না এবং মৃত্তিকা ক্ষয় প্রতিরোধেও সাহায্য করে। একটি সিসল উদ্ভিদের আয়ুষ্কাল মোটামুটিভাবে ৭-১০ বছর। সিসল উদ্ভিদের ১.৫-২ মিটার লম্বা তলোয়ারের মতো পাতা থেকে তন্তু নিষ্কাশন করা হয়। এক-একটি ২০০-২৫০ টি পাতা উৎপাদনে সক্ষম। প্রতিটি সিসল পাতা থেকে গড়ে প্রায় ১০০০ টি তন্তু পাওয়া যায়। ভারতে সিসলের দুটি প্রধান প্রজাতি হল : এ্যাগেভে সিসলানা ও এ্যাগেভে ক্যান্টালা। ভারতে সিসল উদ্ভিদের নানা আঞ্চলিক নাম প্রচলিত রয়েছে। যেমন, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে যথাক্রমে ‘রামবাঁশ’ ও ‘কট্টালাই’ ; ওড়িশায় ‘মোরাব্বা’ বা ‘হাতিবেড়া’ ইত্যাদি। সিসল তন্তু হল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক তন্তু (Natural Fibre)। সিসল উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত তন্তু নানা পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যেমন : দড়ি এবং কুণ্ডলী তৈরিতে, কাগজ তৈরিতে, কার্পেট তৈরিতে, জিওটেক্সটাইলে, হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরিতে, ডার্টবোর্ড তৈরিতে প্রভৃতি।
সিসল চাষে ভারত এখনও প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। ভারতে সিসল চাষে নিযুক্ত জমি ও উৎপাদিত সিসল তন্তুুর পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। ভারতে আনুমানিক ২২০০-২৮০০ হেক্টর জমিতে সিসল চাষ হয় এবং উৎপাদিত তন্তুর পরিমাণ ১৪৩০-১৮২০ টন। সিসল চাষে নিযুক্ত জমি এবং উৎপাদিত সিসল তন্তুর পরিমাণে বিশ্বে ব্রাজিল প্রথম ; যেখানে উৎপাদিত সিসল তন্তুর পরিমাণ ১৫০.৬ হাজার টন। ভারতে সিসলের হেক্টর প্রতি ফলনও কম, মাত্র ৩০০ কেজি ; যেখানে সিসলের সর্বোচ্চ ফলন চিনে, ৪৭০৬ কেজি/হেক্টর। অথচ, ভারতে সিসলের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমপক্ষে ১০-১৫ হাজার টন। যা আগামী সময়ে আরও বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং বিপুল পরিমাণে সিসল তন্তু ভারত বিদেশ থেকে আমদানি করে। আর পরীক্ষা করে দেখা গেছে ভারতীয় সিসলের গুণগত মান আমদানিকৃত সিসলের থেকে ভালো। যদিও আমদানিকৃত সিসলের (১৮০ টাকা/কেজি) থেকে ভারতীয় সিসলের (৭০-৮০ টাকা/কেজি) দাম অনেক কম। তবে, বর্তমানে ভারতীয় সিসলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রকৃতির প্রিয়জন সেন্টিনেলি
মধ্য ভারতের মালভূমি অঞ্চলের সম্ভাব্য সিসল চাষের জেলাগুলি হল — ওড়িশার সুন্দরগড়, ঝাড়সুগুদা, কালাহান্ডি, সম্বলপুর, কোরাপুট, সম্বলপুর ; ঝাড়খন্ডের রাঁচি, লোহারদাগা, পশ্চিম সিংভূম, গুমলা ; ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াড়া, বস্তার, সুকমা ; পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম ; মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়া, মান্ডলা, দিন্দোরি প্রভৃতি। ভারতে সিসল চাষে সবচেয়ে অগ্রণী রাজ্য হল ওড়িশা। ওড়িশায় বেশ কয়েকটি সরকারি সিসল ফার্মের পাশাপাশি কোরাপুট সিসল বিকাশ পরিষদের মতো কিছু বেসরকারি সংস্থাও এগিয়ে এসেছে। ওড়িশার সম্বলপুরে সিসল গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সিসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে, তা — (১) কাগজের জন্য বৃক্ষচ্ছেদনের পরিমাণ কমাবে ; বনজ সম্পদের ওপর চাপ কমবে ও বনাঞ্চল সংরক্ষণে সাহায্য করবে। (২) মালভূমি অঞ্চলের ঢালু জমিতে মৃত্তিকা ক্ষয় রোধে উপযোগী হবে। (৩) সিসলকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
সুতরাং, সিসল চাষে আদিবাসী কৃষকরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি আরও একাধিক সুবিধা পাওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সিসল চাষই পারে পরিবেশগত প্রতিকূলতা কাটিয়ে আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। মধ্য ভারতের মালভূমি অঞ্চলে ব্যাপক সিসল চাষের প্রচলন করা গেলে, তা অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আদিবাসী সমাজকে আর্থিকভাবে অনেকাংশে স্বনির্ভর করে তুলবে আশা করা যায়। (Sisal Cultivation in Tribal Development)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকাঃ- তানিয়া খাতুন (চাঁপাডাঙ্গা, হুগলি)
তথ্যসূত্রঃ- আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সিসল চাষ – ডঃ সিতাংশু সরকার – যোজনা (আগস্ট, ২০১৭) ; Wikipedia ; Improved Production Technology of Sisal – S. Sarkar, C. Kar, M.K. Sinha, B.S. Mahapatra (২০১০) – ResearchGate ; FAO Statistics
Pingback: Sundarban - Epicenter of Gynaecological Diseases - ভূগোলিকা-Bhugolika
তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ
ধন্যবাদ ❤️
Pingback: Only Fossil Park in West Bengal - ভূগোলিকা-Bhugolika