Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

PurbaBardhaman – Rice Bowl of Bengal

বাংলার ধানের গোলা – পূর্ব বর্ধমান

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : PurbaBardhaman – Rice Bowl of Bengal । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বাংলার ধানের গোলা রূপে পরিচিত পূর্ব বর্ধমান জেলার ধান চাষ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

PurbaBardhaman - Rice Bowl of Bengal
পূর্ব বর্ধমান : বাংলার ধানের গোলা

ভারতে কৃষিজ ফসলের মধ্যে সর্বপ্রধান হল ধান। ভারত ধান উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। আর ভারতে ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান অধিকার করে। ২০২২-২৩ সালে, পশ্চিমবঙ্গে ধান উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৫৬.৩১ লক্ষ মেট্রিক টন, যা ভারতের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ১২%। তবে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র সমান পরিমাণে ধান উৎপাদন হয় না। জেলা হিসেবে অবিভক্ত বর্ধমান জেলাতে সর্বাধিক পরিমাণ ধান চাষ হত বলে, অবিভক্ত বর্ধমান জেলা ‘বাংলার ধানের গোলা’ (Rice Bowl of Bengal) নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ৭ এপ্রিল, ২০১৭ -তে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে বর্ধমান জেলা দ্বিবিভক্ত (পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান) হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের নবীনতম জেলা হিসেবে পশ্চিম বর্ধমান আত্মপ্রকাশ করে। মূলত খনি ও শিল্পাঞ্চল নিয়ে পশ্চিম বর্ধমান এবং কৃষি অঞ্চল নিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলা গঠিত হয়। তাই আক্ষরিক অর্থে বর্তমানে ‘বাংলার ধানের গোলা’ হল পূর্ব বর্ধমান জেলা। (PurbaBardhaman – Rice Bowl of Bengal)

ভূ-প্রকৃতিগত দিক থেকে পূর্ব বর্ধমান রাঢ় সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত। প্রাকৃতিক দিক থেকে পূর্ব বর্ধমান জেলাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা — (১) উত্তরের কাঁকসা-কেতুগ্রাম সমভূমি অঞ্চল, যা অজয় নদের অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত (২) মধ্যাংশের বর্ধমান সমভূমি অঞ্চল (৩) দক্ষিণের খন্ডঘোষ সমভূমি অঞ্চল, যা দামোদর নদের অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত। আবার, প্রশাসনিক দিক থেকে পূর্ব বর্ধমান ৪ টি মহকুমায় বিভক্ত – (১) বর্ধমান সদর উত্তর: ৭ টি ব্লক (আউশগ্রাম-১, আউশগ্রাম-২, ভাতার, গলসি-১, গলসি-২, বর্ধমান-১, বর্ধমান-২) নিয়ে গঠিত। (২) বর্ধমান সদর দক্ষিণ: ৬ টি ব্লক (মেমারি-১, মেমারি-২, জামালপুর, রায়না-১, রায়না-২, খন্ডঘোষ) নিয়ে গঠিত। (৩) কালনা: ৫ টি ব্লক (পূর্বস্থলী-১, পূর্বস্থলী-২, কালনা-১, কালনা-২, মন্তেশ্বর) নিয়ে গঠিত। (৪) কাটোয়া: ৫ টি ব্লক (মঙ্গলকোট, কাটোয়া-১, কাটোয়া-২, কেতুগ্রাম-১, কেতুগ্রাম-২) নিয়ে গঠিত। পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রধান কৃষিজ ফসল হল ধান এবং ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিটি মহকুমাই গুরুত্বপূর্ণ।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পশ্চিমবঙ্গের ঋতু বৈচিত্র্য

ধানচাষের জন্য যেরূপ অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন হয়, তা পূর্ব বর্ধমান জেলাতে রয়েছে। সেগুলি হল — (১) বৃষ্টিপাত: ধানচাষের প্রথম পর্যায়ে ১০০-২০০ সেমি বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়। মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালে এই জেলাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। পূর্ব বর্ধমান জেলার গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫০ সেমি। (২) তাপমাত্রা: পূর্ব বর্ধমানে গড় তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ধান চাষের জন্য আদর্শ। (৩) জমির প্রকৃতি: ধান গাছের গোড়ায় জল জমে থাকা ধানগাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। তাই পূর্ব বর্ধমান জেলার নিচু সমতল ভূমি-তে ব্যাপক ধানচাষ হয়। (৪) মৃত্তিকা: অজয় ও দামোদর নদ বাহিত উর্বর পলিযুক্ত দোঁয়াশ মৃত্তিকা পূর্ব বর্ধমানে ধান উৎপাদনে আদর্শ পরিবেশ গড়ে তুলেছে। (৫) জলের জোগান: বিশেষত বোরো ধানের চাষের ক্ষেত্রে সেচের জন্য অজয় ও দামোদর নদের জল ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সুলভ ও দক্ষ পরিশ্রমী শ্রমিক, মূলধন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার, কীটনাশক ও সারের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব বর্ধমানে ব্যাপকভাবে ধানচাষ হয়।

২০১৭-১৮ সালে পূর্ব বর্ধমান জেলায় ধান চাষকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৫২০.৬ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আউশ, আমন ও বোরো যথাক্রমে ১৪.৬, ৩৫৬.৯, ১৪৯.১ হাজার হেক্টর। ওই বছরে, পূর্ব বর্ধমান জেলার বার্ষিক ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৫৯৭.৪ হাজার টন। এর মধ্যে আউশ, আমন, বোরো যথাক্রমে ৪৪.২, ১০২১.৪, ৫৩১.৮ হাজার টন। ২০১৭-১৮ সালে পূর্ব বর্ধমান জেলায় ধানের ফলন ছিল ৩০৬৮ কেজি/হেক্টর। আউশ, আমন, বোরো যথাক্রমে ৩০২৮, ২৮৬২, ৩৫৬৬ কেজি/হেক্টর [সূত্র: District Statistical Handbook, Purba Bardhaman, ২০১৯]। পূর্ব বর্ধমান জেলার মধ্যে বর্ধমান সদর উত্তর মহকুমাতে ধান উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। এই মহকুমার সর্বাধিক ধান উৎপাদক ব্লকগুলি হল – ভাতার, বর্ধমান-১, গলসি-২ ব্লক ধান উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কাটোয়া মহকুমা। এই মহকুমার সর্বাধিক ধান উৎপাদক ব্লকগুলি হল মঙ্গলকোট, কাটোয়া-২, কেতুগ্রাম-১। এছাড়া বর্ধমান সদর দক্ষিণ মহকুমার রায়না-১, মেমারি-২, খন্ডঘোষ ব্লক ; কালনা মহকুমার মন্তেশ্বরে, কালনা-১, পূর্বস্থলী ১ ব্লক ধান উৎপাদনে অগ্রণী।

পূর্ব বর্ধমান জেলাতে, সময়ের নিরিখে আউশ, আমন, বোরো — ৩ প্রকার ধানের চাষই লক্ষ্য করা যায়। তবে, আমন ধান (যা বর্ষার শুরুতে অর্থাৎ জুন-জুলাই মাসে বপন করা হয় ও অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কাটা হয়) -এর উৎপাদন সর্বাধিক। বোরো ধান অর্থাৎ শীতকালীন ধান যা প্রধানত সেচনির্ভর, উৎপাদনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এই ধান নভেম্বর-ডিসেম্বরে রোপণ করে, ফেব্রুয়ারি-মার্চে তোলা হয়। আউশ ধান অর্থাৎ যা মার্চ-এপ্রিলে রোপণ করে মে-জুন মাসে কাটা হয়, এর উৎপাদন সবচেয়ে কম। গ্রীষ্মকালীন এই ধান চাষের প্রধান সমস্যা জলের সমবন্টনের অভাব। তবে উর্বর মৃত্তিকা হওয়ায়, বেশিরভাগ জমিই দো-ফসলি বা বহুফসলি অর্থাৎ একই জমিতে দুই বা তিনপ্রকার ধানেরই চাষ হয়ে থাকে। পূর্ব বর্ধমান জেলাতে বিভিন্ন উচ্চফলনশীলের ধানের উৎপাদন লক্ষ্য করা যায়। যেমন — সোনাম, বাঁশকাঠি, মিনিকিট, রত্না, জয়া, আদিত্য ইত্যাদি, এমনকি লালস্বর্ণের চাষও হয়ে থাকে। উল্লেখ্য ২০১৭ সালে পূর্ব বর্ধমানের সুগন্ধি গোবিন্দভোগ ধান জি.আই. স্বীকৃতি পেয়েছে।

পূর্ব বর্ধমান জেলাতে সাধারণত দুই পদ্ধতিতে (রোপণ ও বপন) ধানচাষ হয়ে থাকে। রোপণ পদ্ধতিতে অল্প খানিকটা জমিতে ধানের বীজ ছড়িয়ে প্রথমে বীজতলা করা হয়। ১৫-২০ দিন পর বীজতলা থেকে চারা তুলে এনে মূল জমিতে সারিবদ্ধভাবে সমদূরত্বে রোপণ করা হয়। অন্যদিকে বপন পদ্ধতিতে আগে থেকে তৈরি করা জমিতে বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং সেখানেই চারা ও গাছ উৎপন্ন হয়। পূর্ব বর্ধমান জেলাতে রোপণ পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ধান উৎপন্ন হয়। শুধুমাত্র ধান উৎপাদন নয়, ধানের ওপর ভিত্তি করে পূর্ব বর্ধমান জেলাতে কৃষিভিত্তিক শিল্প রূপে অসংখ্য রাইস মিল গড়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, এই জেলাতে ২০০ টির বেশি রাইস মিল রয়েছে। যেমন : লক্ষ্মীনারায়ণ রাইস মিল, রামকৃষ্ণ রাইস মিল প্রভৃতি। এগুলি প্রধানত কৃষিজমির কাছাকাছি স্থানে গড়ে ওঠে, যা কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।

‘বাংলার ধানের গোলা’ রূপে পরিচিত হলেও, জলবায়ুর প্রতিকূলতা, প্রয়োজন মতো জলের অভাব, নিম্ন বাজারদরের কারনে পূর্ব বর্ধমান জেলার ধানচাষীরা বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং কৃষক আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। এ সমস্যা সমাধানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচী ‘আমার ফসল, আমার গোলা’ প্রান্তিক চাষীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে চলেছে। এই কর্মসূচীতে ফসলের গোলা তৈরির জন্য সরকারি ভর্তুকি পাওয়া যায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্প এবং ভারত সরকারের কিষাণ সম্মান নিধি যোজনা-তে পূর্ব বর্ধমানের ধানচাষীরাও উপকৃত হচ্ছেন। তাই আশা করি, সমস্যা কাটিয়ে ধান চাষে পূর্ব বর্ধমান জেলা আরও এগিয়ে যাবে। (PurbaBardhaman – Rice Bowl of Bengal)

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]

লেখিকাঃ- সূচনা ব্যানার্জী (মসাগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান)

তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia, ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল – কার্তিকচন্দ্র মন্ডল, বর্ধমান সহায়িকা ২০১৬-১৭, District Statistical Handbook, Purba Bardhaman, ২০১৯

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : আরাকু উপত্যকার বোরা গুহা

3 thoughts on “PurbaBardhaman – Rice Bowl of Bengal

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!