Past-Present-Future of Sundarban
সুন্দরবনের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Past-Present-Future of Sundarban । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সুন্দরবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

‘অবুধ নাইয়া বোলে হইল সংশয়।
বুঝিলাম আজি আর প্রাণ নাহি রয়।।
কুলে উঠিলে সে বাঘে লইয়া পালায়।
জলে পড়িলে সে বলে কুম্ভীরেই খায়।।
নিরন্তর এ পানিতে ডাকাইত ফিরে।
পাইলেন ধন-প্রাণ দুই নাশ করে।।’
এই পঙক্তিগুলি ১৫৪০-এর দশকে বৈষ্ণব কবি শ্রী বৃন্দাবন দাস ‘শ্রী চৈতন্য ভাগবত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন। ১৫১০ সালে আদিগঙ্গার তীরে ছত্রভঙ্গ বন্দর (বর্তমান মথুরাপুর) থেকে শ্রীচৈতন্য নৌকাযোগে পুরী যাবার পথে সুন্দরবনের মধ্য থেকে যাত্রা করেছিলেন মেদিনীপুরের দিকে। সুন্দরবনের যাত্রাপথে তারা এই কীর্তন গেয়েছিলেন, যার কয়েকটি পঙক্তির মধ্য দিয়ে সমগ্র সুন্দরবনের প্রকৃত চিত্র চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে।
বাঘ-কুমীর-নদী-জঙ্গল আর নোনা হাওয়া-মাটিতেই বাস সুন্দরবনের মানুষের। ২৪০০ বছর ধরে এখানে বাদাবনের আশেপাশেই মানুষের বসতি রয়েছে। এখানকার মানুষ প্রকৃতির কোলে দুঃসাহসিক জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু ব্রিটিশদের সময় থেকে প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাদাবন সাফ করে, বাঘ-হরিণ মেরে সুন্দরবন ধ্বংসের কাজ শুরু হয় ; বাদাবন সাফ করে চাষের জমি বাড়াতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারতে প্রায় ৪০,০০০ বাঘ ছিল, যার একটা বড়ো অংশই সুন্দরবনে ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা (Number of Tigers in Sundarban of India) ১০০ (বাঘ সুমারী-২০২৩)। ফলে বিপন্ন সুন্দরবনের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য। ভারতের সুন্দরবনে মোট ১০২ টি দ্বীপ রয়েছে, যার ৫৪ টিতে জনবসতি রয়েছে। সুন্দরবনের দ্বীপগুলি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে স্বল্প উঁচু বা প্রায় সমান। তাই বিগত ২৫০ বছর ধরে এই অঞ্চলে যেমনভাবে চাষের জমি ও বসতি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে নোনা জল আটকাতে নদীবাঁধ নির্মাণ। আর প্রতি বছর সাইক্লোন বা জলোচ্ছ্বাসে ভাঙছে মাটির নদীবাঁধ। ভাসছে গ্রামের পর গ্রাম এবং চাষের জমি। প্রতি বছর এখানকার মানুষ দুর্যোগের শিকার হন। আর ত্রাণ ও বাঁধ মেরামতি চলতেই থাকে, যার আজও কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হয়নি। (Past-Present-Future of Sundarban)
ভারত এবং বাংলাদেশের গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ অঞ্চলে গড়ে ওঠা সুন্দরবন হল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য (Largest Mangrove Forest of the World)। জার্নাল অফ দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ কোস্টাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (২০১৩) অনুসারে, জলভাগ সহ সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মোট আয়তন ১০,২৭৭ বর্গকিমি। যার ৪২৬০ বর্গকিমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং বাকিটা বাংলাদেশের অন্তর্গত। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে সুন্দরবনের আয়তন বিগত ২৫০ বছর ধরে ক্রমহ্রাসমান এবং আজও এই ধারা অব্যাহত। তবে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ভারতের সুন্দরবনের দুইটি অংশ রয়েছে। এক, সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ অরণ্য (Reserved Mangrove Forest), যা দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় অবস্থিত এবং দুই, সুন্দরবন বসতি অঞ্চল (Sundarban Settlement Area), যা বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ১৯ টি ব্লক নিয়ে গঠিত। সুন্দরবন বসতি অঞ্চল একদা ম্যানগ্রোভ অরণ্য কবলিত ছিল, যা ঐতিহাসিক কাল থেকে অরণ্যবিনাশের মাধ্যমে বসতি এবং কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : অধিবর্ষের ইতিকথা
সুন্দরবনের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন, যদিও এনিয়ে বিস্তারিত গবেষণার অভাব রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে সুন্দরবন অঞ্চল বন্দর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। বঙ্গদেশে আর্য আধিপত্যের সময়ও সুন্দরবন তার ব্যতিক্রম ছিল। কারণ নদী-খাল-খাঁড়ি পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্গমতা। অষ্টম শতাব্দীতে এই অঞ্চল পাল বংশের শাসনাধীন ছিল। এরপর (১০৯৫-১১৫৮) সুন্দরবন অঞ্চল সেন বংশের শাসনাধীন ছিল। সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন এক ব্রাহ্মণ বাসুদেব শর্মাকে ‘শাসন’ নামে একটি গ্রাম দান করেন, বর্তমানে যা বারুইপুরের কাছে অবস্থিত। মথুরাপুরের কঙ্কনদিঘিতে একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত শিব মন্দির ‘জটার দেউল’ (Jatar Deul) রয়েছে। মোঘল আমলে (১২০৩-১৫৩৮) স্থানীয় শাসকদের পুরো সুন্দরবন ইজারা দেওয়া হয়। বিশ্বের প্রথম ম্যানগ্রোভ অরণ্য হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে সুন্দরবন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে সুন্দরবনের ইতিহাসে বারো ভুঁইয়া এবং রাজা প্রতাপাদিত্য বিশেষ উল্লেখ্য। সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর দুটি ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে ১৬৮৮ এবং ১৭৩৭ সালে। ১৬৮৮-তে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে যায়। ১৭৩৭-তে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয় সুন্দরবন। ১৭৫৭ তে পলাশির যুদ্ধ এবং ১৭৬৫ তে দেওয়ানি লাভের পর সুন্দরবন অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আওতায় আসে। ১৭৬০ এর দশকে সুন্দরবন এলাকার প্রথম মানচিত্রায়নের কাজ শুরু হয়। ১৭৭৩ সালে জেমস রেনেলের ‘চার্ট অফ সুন্দরবনস্ রিভার্স’ হল সুন্দরবনের প্রথম বিশদ মানচিত্র। ১৮৭৫-৭৬-তে সুন্দরবনকে ‘সংরক্ষিত অরণ্য’ (Reserved Forest) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৭৯ সালে একটি বনবিভাগ তৈরি করা হয়, যার সদরদপ্তর ছিল বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা। স্বাধীনতাকালে দেশভাগের কারণে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিভক্ত হয়। ১৯৭৩ সালে ভারত সরকার বাঘ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ‘প্রজেক্ট টাইগার’ (Project Tiger) শুরু করে এবং ওই বছরই সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ (Sundarban Tiger Reserve) গড়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার সুন্দরবনকে ‘জাতীয় উদ্যান’ (National Park) রূপে ঘোষণা করে। ১৯৮৯ সালে সুন্দরবন ‘বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ’ (Biosphere Reserve)-এর মর্যাদা লাভ করে। ২০১৯ সালে ভারতের সুন্দরবন ‘রামসার সাইট’ (Ramsar Site) -এর মর্যাদা পেয়েছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ
বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) এবং জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change) -এর প্রেক্ষাপটে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজ প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি, ঘন ঘন তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ, ভূমিক্ষয়, একশ্রেণীর মানুষ কর্তৃক নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস, সমুদ্রজলের লবণতা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে আগামী কয়েক দশক পর সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিবেশবিদরা চিন্তিত। মনে রাখা দরকার, সুন্দরবন শুধুমাত্র পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ নয় — ভারতের সুন্দরবন কমবেশি ৫০ লক্ষ মানুষের জীবিকার উৎসস্থল। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশকে বাঁচানোর পাশাপাশি, সুবিশাল জনসংখ্যার জীবিকার দিকও ভাবতে হবে। (Past-Present-Future of Sundarban)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সুন্দরবনের মাছ
সুন্দরবনে নদীর বাঁধই এখানকার মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত। মাটির নদীবাঁধে মাটি চাপিয়ে প্রতি বছরই সুন্দরবনের মানুষ নিজেদের বসতবাড়ি এবং চাষের জমি রক্ষার লড়াই করে চলেছেন। প্রতি বছরই বর্ষায় আর ঘূর্ণিঝড়ে নদীবাঁধ ভেঙে এখানকার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। আর চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকে, তা রোদে শুকিয়ে গেলে বড় বিপদ। জমি লবণাক্ত হওয়ার কারণে সেসব জমিতে দুই থেকে তিন বছর চাষবাস করা যায় না। কৃষিকাজ ও মৎস্য আহরণ-ই হল এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা। এছাড়াও এখানে বহু মানুষ সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের মৌলে বলে। অত্যন্ত দরিদ্র মানুষরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদাবনে মধু সংগ্রহ করেন এবং প্রায় প্রতিবছরই বহু মানুষ বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। সুন্দরবনের মানুষ চায় সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ। পরিবেশ রক্ষায় সুন্দরবনকে যেকোনো মূল্যে বাঁচানো দরকার। কারণ এখানকার বাসিন্দাদের একটি বড়ো অংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বাদাবনের ওপর নির্ভরশীল। আর সাথে দরকার এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন (Socio-economic Development)। সেজন্য অরণ্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি যা করতে হবে, তা হল — (১) সুন্দরবনে পাকাপোক্ত দীর্ঘস্থায়ী নদীবাঁধ নির্মাণ (২) ঘূর্ণিঝড় প্রবণ সুন্দরবনে সরকারি প্রকল্পে অধিক সংখ্যায় পাকা বাড়ির ব্যবস্থা (৩) সুন্দরবনের মানুষের জীবন-জীবিকায় সরকারি সহযোগিতা ও স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুদৃঢ় পরিকল্পনা গ্রহণ। (Past-Present-Future of Sundarban)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- তামশ্রী হালদার (পশ্চিম জটা, মথুরাপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- বর্তমান পত্রিকা ; Wikipedia ; সুন্দরবন : অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ – শমীক লাহিড়ী ; Two and Half Century’s Changes of World Largest Mangrove Forest: A Geo-informatics Based Study on Sundarbans Mangrove Forest, Bangladesh, India – Nur Hussain, Rozina Khanam, Ebadullah Khan – Modern Environmental Science and Engineering (ISSN 2333-2581) June 2017 ; Geological Survey of India (GSI)
Pingback: Israel's Salt Cave Malham - ভূগোলিকা-Bhugolika
খুব সুন্দর,
শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো
ধন্যবাদ ❤️