Nature’s Beloved Sentinelese
প্রকৃতির প্রিয়জন সেন্টিনেলি
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Nature’s Beloved Sentinelese । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেন্টিনেলি উপজাতি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

রহস্যময়, রোমাঞ্চকর পৃথিবী। শুধুমাত্র প্রকৃতি নয়, শস্যশ্যামলা বসুন্ধরার সর্বোন্নত জীব প্রজাতি অর্থাৎ মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসও কম রোমাঞ্চকর নয়। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ ক্রমেই উন্নততর সভ্যতায় নিজেকে বিকশিত করেছে। আদিম যুগে গুহাবাসী অরণ্যাচারী মানুষ আজ মেগাসিটির বহুতলবাসী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে পৌঁছে গেছে চাঁদে-মঙ্গলে। কিন্তু যদি বলি, এই ধরিত্রীর বুকে এখনও এক মানব গোষ্ঠী প্রস্তরযুগে বসবাস করে! সভ্য দুনিয়ার সাথে কোনোরকম আদানপ্রদান নেই! কি চমকে গেলেন? অবাক হচ্ছেন! তাহলে আসুন পরিচয় করিয়ে দিই প্রকৃতির প্রিয়জন ‘সেন্টিনেলি’ (Nature’s Beloved Sentinelese)-দের সাথে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : রাঢ় অঞ্চলের টুসু উৎসব
আমাদের ভারতবর্ষের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জের আন্দামান গ্রুপের একটি দ্বীপ হল নর্থ সেন্টিনেল (North Sentinel)। নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬০ বর্গকিমি। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাত্র ৫০ কিমি দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত রহস্যে মোড়া দ্বীপ হল নর্থ সেন্টিনেল। যা বাইরে থেকে খুবই সুন্দর, কিন্তু তার অন্তর্ভাগ আজও রহস্যাবৃত। কারণ, এই দ্বীপে স্বাধীন ও আধুনিক সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ভাবে বসবাস করে এক উপজাতি গোষ্ঠী। হ্যাঁ, তারাই সেন্টিনেলি (Sentinelese) নামে পরিচিত। আর, তাদেরই রহস্যময়, অজানা জীবনকে জানতে ছুটে গেছে আধুনিক সভ্যতার মানুষ বহুবার, কিন্তু ফল স্বরূপ পেয়েছে শুধুই প্রতিঘাত।
কারা এই সেন্টিনেলি? জানা যায়, আদিম জনজাতি সেন্টিনেলিরা প্রত্যন্ত দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেলে ৬০ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে সবার অগোচরে বসবাস করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সেন্টিনেলিরা উৎপত্তিগত ভাবে আফ্রিকার আদিম জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, ইউরোপীয় উপনিবেশ দ্বারা বিভিন্ন জনজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের অধিবাসী সেন্টিনেলিরা। সেন্টিনেলিদের গায়ের রং কালো এবং এরা জীবন যাপন করে প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষদের মতো। শিকার এদের প্রধান জীবিকা, শিকারজাত প্রাণী, ফলমূল খেয়েই এরা জীবন ধারণ করে থাকে। বাইরের দুনিয়ার সভ্য মানুষদের প্রতি সেন্টিনেলিদের আচরণ খুবই হিংসাত্মক। মূলত তীরনিক্ষেপের মাধ্যমেই তারা সভ্য মানুষদের স্বাগত জানায়। সেন্টিনেলিদের জনসংখ্যা কত? এবিষয়ে কোনো সঠিক ও নির্দিষ্ট ধারণা নেই। আনুমানিক ভাবে বলা হয়, তাদের সংখ্যা সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ৫০-২০০ জন বলে মনে করেন। অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ২০১৬ হ্যান্ডবুক অনুসারে, সেন্টিনেলিদের সংখ্যা ১০০-১৫০।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবনের দেবী বনবিবি
এবার জানা যাক, আমাদের সভ্য সমাজের সাথে তাদের সম্পর্কটা ঠিক কী রকম! কয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি। তাতেই বোঝা যাবে বাইরের দুনিয়ার মানুষের প্রতি তাদের মনোভাব কিরূপ! (১) ১৮৯৬ সালে এক ভারতীয় আসামি সেলুলার জেল থেকে পালিয়ে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে চলে যায়। কিন্তু বিধিবাম, সে বেঁচে থাকেনি। তাকে মেরে ফেলে সেন্টিনেলিরা। এ যেন ফ্রাইং প্যান থেকে পালিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া! (২) ১৯৭৪ সালে সালের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফিল্ম ক্রু একটি ডকুমেন্টরি বানাতে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে যান। সেন্টিনেলিদের ছোঁড়া তীরে ডিরেক্টর মশাই বিদ্ধ হলে, তারা তৎক্ষণাৎ ফিরে আসেন ও সৌভাগ্যক্রমে জীবিত থাকেন। (৩) ২০০৪ সালে সুনামিতে ভারত সরকার তাদের জন্য খুবই চিন্তিত বোধ করে। গতিবিধি জানতে একটি ত্রাণ সহ হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। কিন্তু সেই হেলিকপ্টার দেখেই সেন্টিনেলিরা আগুনের গোলা সহযোগে তীর নিক্ষেপ শুরু করে। ফিরে আসে হেলিকপ্টার। (৪) ২০০৬ সালে ভারতের কাঁকড়া শিকারী এক বোটের ২ জন জেলে রাস্তা ভুল করে ওই দ্বীপে পৌঁছায়। সেন্টিনেলিরা তাদের নৃশংসভাবে মেরে ফেলে এবং মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে দেয়। (৫) ২০১৮ সালে এক আমেরিকান যুবক জন অ্যালেন চাউ কয়েকজন জেলেকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ওই দ্বীপে যান। উদ্দেশ্য খ্রিস্টধর্মের প্রচার। পরিণতি নির্মম মৃত্যু!
ব্যতিক্রম একমাত্র ত্রিলোকনাথ পন্ডিতের নেতৃত্ব এক অভিযাত্রী দল। ১৯৯১ সালে অ্যানথ্রোপলজিস্ট অর্থাৎ নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোকনাথ পন্ডিতের নেতৃত্ব এক অভিযাত্রী দল একমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে সেন্টিনেলিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাঁরা সেন্টিনেলিদের উপহার দেন, যা তারা গ্রহণ করে। ওই অভিযাত্রী দলের সদস্যরা নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সৈকতের নিকট গলা অবদি জলেতে দাঁড়িয়ে সেন্টিনেলিদের নারিকেল এবং অন্যান্য উপহার বিতরণ করেছিলেন। কিন্তু সেন্টিনেলিরা তাদের দ্বীপে নামার অনুমতি দেয়নি। ত্রিলোকনাথ পন্ডিত (Triloknath Pandit) -এর কথায়, ‘সেন্টিনেলিরা খুব লম্বাও নয়, খুব খাটোও নয়। তারা তীর ধনুক বহন করে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, কিন্তু আমরা তাদের ভাষা বুঝতে পারিনি। আমরা ইশারায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তারা তখন নারিকেল সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল’।
বারংবার, সভ্য জগৎ-এর মানুষদের প্রতি সেন্টিনেলিদের সহিংসতা এবং এক আদিম মানব গোষ্ঠী হিসেবে তাদের বিচ্ছিন্ন থাকার প্রচেষ্টা দেখে ভারত সরকার নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে সমস্ত প্রকার যোগাযোগ স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে। নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের উপকূল থেকে ৩ কিমি দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হয়। থাক না তারা তাদের মতই, তাতেই যদি খুশি তারা। নিজেদের মতো বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও রয়েছে। তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার ছোঁয়া নাই বা লাগলো তাদের জীবনে। নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা প্রকৃতির প্রিয়জন সেন্টিনেলিরা তাদের মতোই সুখে থাকুক। নর্থ সেন্টিনেলি দ্বীপ পৃথিবীর অন্যতম রহস্যেঘেরা দ্বীপ হয়েই থাক, যেখানে শুধুই প্রকৃতি ও সেন্টিনেলিদের চিত্রই ফুটে ওঠে। (Nature’s Beloved Sentinelese)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকাঃ- সোনালী দন্ডপাট (মানিকপাড়া, ঝাড়গ্রাম)
তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা ; Forbes / Everything We Know About The Isolated Sentinelese People Of North Sentinel Island / Kiona N. Smith ; Wikipedia ; বিবিসি নিউজ বাংলা
Pingback: Topic - Golden Quadrilateral Project - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Sundarban - Epicenter of Gynaecological Diseases - ভূগোলিকা-Bhugolika
ভালো, তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ।
Very Nice
Pingback: Sisal Cultivation in Tribal Development - ভূগোলিকা-Bhugolika