Mudmen of Papua New Guinea
পাপুয়া নিউ গিনির ‘কাদা-মানব’
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Mudmen of Papua New Guinea । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পাপুয়া নিউ গিনির ‘কাদা-মানব’ তথা অসারো উপজাতি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।
আমরা মানুষেরা সেই প্রাচীনকাল থেকে নিজেদের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে সুদূর পথ অতিক্রম করে বর্তমানের তথাকথিত সভ্য, আধুনিক ও উন্নত মানুষে পরিণত হয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর সকল জনগোষ্ঠী একই পথে হাঁটেনি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রকৃতির কোলে এমন অনেক উপজাতি গোষ্ঠী (Tribal Group) রয়েছে, যাদের স্বতন্ত্র আদিম জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি এখনও প্রবহমান। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ওশিয়ানিয়া (Oceania) -এর অন্তর্গত পাপুয়া নিউ গিনি (Papua New Guinea) দ্বীপরাষ্ট্র হল নৃজাতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অনন্য ভূমি। পাপুয়া নিউগিনিতে হাজারো জনজাতি গোষ্ঠী রয়েছে। তারই একটি হল অসারো উপজাতি (Asaro Tribe)। এই জনগোষ্ঠী আবার ‘হোলোসা’ (Holosa) নামেও পরিচিত, যার অর্থ হল ভূত। কাদার তৈরি মুখোশ ব্যবহার করে থাকে বলে, এরা ‘পাপুয়া নিউগিনির কাদা-মানব’ (Mudmen of Papua New Guinea) রূপে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।
অসারো উপজাতির মানুষেরা মূলত পাপুয়া নিউ গিনির পূর্ব পার্বত্য প্রদেশ (Eastern Highlands Province) -এর গোরোকা (Goroka) ও ডাউলো (Daulo) জেলাতে বসবাস করে। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অসারোদের জনসংখ্যা মোটামুটিভাবে ৩০ হাজার কিংবা তার কিছু বেশি। অসারো জনগোষ্ঠীর ভাষা হল দানো (Dano), যা কাইনান্টু-গোরোকা (Kainantu-Goroka) নামক পাপুয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। অসারোরা মূলত কৃষিকাজ ও পশুপালনের মাধ্যমে জীবনযাপন করে। নিজস্ব সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রেখে এই উপজাতি আধুনিক, সভ্য জগৎ-এর সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। এই উপজাতির মানুষেরা বিশেষ জনপ্রিয়, কারণ এরা মাটির তৈরি এক অদ্ভুত রকম সুন্দর ও ভয়ঙ্কর মুখোশ (Mud Mask) ব্যবহার করে এবং এরা শান্ত স্বভাবের ও সভ্য মানুষদের সাদরে গ্রহণ করে থাকে।
অসারোদের কোনো লিখিত ইতিহাস (Written History) নেই। তাই ঠিক কবে তারা মুখোশের ব্যবহার শুরু করে, তা জানা যায়না। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই রীতি প্রচলিত, যা কমপক্ষে বেশ কয়েকশো বছরের পুরানো। তবে কিভাবে এই মুখোশের প্রচলন হল, তা নিয়ে অনেক কাহিনী রয়েছে। সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনী হল, একবার শত্রুপক্ষের প্রবল আক্রমণে অসারোরা রাত্রিবেলা প্রাণ বাঁচাতে অসারো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভোরবেলা নদীর কাদামাটি মাখা অসারোদের চেহারা দেখে ভূত ভেবে শত্রুপক্ষ ভয়ে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে অসারোরা শত্রুপক্ষের হাত থেকে বাঁচতে কাদামাটির মুখোশ তৈরি করে ব্যবহার করতে শুরু করে। আবার অন্যমতে, প্রাচীনকালে শত্রুপক্ষ এসে অসারোদের বসতিতে লুটপাট চালাতো। শক্তিশালী শত্রুদের সাথে লড়াইতে মোকাবিলা করতে না পেরে, অসারোরা বুদ্ধি করে শত্রুপক্ষকে ভয় দেখাতে এই ভুতুড়ে মুখোশ ব্যবহার শুরু করে।
মুখোশ প্রচলন নিয়ে আরেকটি কাহিনী হল, পোশাকের অভাবে এক অসারো এক বিয়ের অনুষ্ঠানে কাদামাটির এক ভুতুড়ে মুখোশ পরে যায়। যা দেখে ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়। পরে এই মুখোশকে শত্রুপক্ষকে ভীত করতে ব্যবহার করা শুরু হয়। অসারোরা নদীর কাদামাটি দিয়ে দানব মুখাকৃতির ভয়ঙ্কর মুখোশ তৈরি করে। লম্বা কান, শিং, ভয়াল চোখ-মুখ সহযোগে তৈরি মুখোশগুলি হঠাৎ দেখলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া অসারোরা কচি বাঁশ দিয়ে লম্বা বড়ো আঙুল ও নখ বানায় এবং গোটা দেহে সাদা কাদার প্রলেপ দিয়ে অলৌকিক সাজে শত্রুপক্ষের সামনে নিজেদের তুলে ধরে। এই মুখোশের সৌজন্যে, অসারোরা বিনা যুদ্ধে অজস্রবার বাজিমাত করেছে। পাপুয়া নিউ গিনির সকল জনগোষ্ঠীই আত্মা ও ভূতে প্রবল বিশ্বাসী। দুষ্ট আত্মা ও ভূত নিয়ে তাদের যথেষ্ট ভীতি রয়েছে। এই ভীতিই অসারোরদের হাতিয়ার। তাই তারা কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে কাদামাটির মুখোশ ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে থাকে। আর এজন্যই অসারোরা ‘কাদা-মানব’ (Mud-Men) নামে পরিচিত। অসারো উপজাতি বর্তমানে আধুনিক দুনিয়ার মানুষের সাথে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ এবং তাদের সাংস্কৃতিক রীতি ও ঐতিহ্য বহির্জগৎ-এর সামনে তুলে ধরে থাকে। ২০১৬ সালে অসারো উপজাতির ৪ জন সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়ামে এক প্রদর্শনীতে অংশ নেয় এবং নিজেদের মুখোশ নির্মাণ কৌশল তুলে ধরে। অসারোদের এই মুখোশ-সংস্কৃতি (Mask-Culture) -এর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটক অসারো গ্রামগুলিতে ভ্রমণ করে থাকেন।
লেখিকাঃ- তানিয়া খাতুন (চাঁপাডাঙ্গা, হুগলি)
তথ্যসূত্রঃ- BBC News ; Wikipedia ; Geographic Expedition ; Asaro Mudman Tribe from Papua New Guinea – Georgi Bonev ; The Asaro Mudmen : Local Property, Public Culture? – Ton Otto and Robert J. Verloop
Pingback: Flysch and Molasse - ভূগোলিকা-Bhugolika