Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Matla River of Sundarban

সুন্দরবনের মাতলা নদী

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Matla River of Sundarban । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সুন্দরবনে মাতলা নদী সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Matla River of Sundarban
মাতলা নদী, ক্যানিং, দক্ষিণ ২৪ পরগণা

‘মাতলা নদীর মাঝি আমি,
জীবন তরী বেয়ে,
প্রভাত কালে ভাটার টানে,
যাই সাগরে ধেয়ে’
– অচিন্ত্য কুমার ধাড়া (মাতলা নদীর মাঝি – নবপ্রভাত, ৬১তম সংখ্যা)।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে অবস্থিত সুন্দরবন (Sundarban) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ (Ganges Delta) অঞ্চলের অন্তর্গত সুন্দরবনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল নদীমাতৃকতা। সুন্দরবনে জোয়ারের জলে পুষ্ট অসংখ্য নদী-নালা-খাঁড়ি রয়েছে ; মাতলা নদী (Matla River) হল তেমনই একটি নদী। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা (South 24 Parganas) জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মাতলা নদী হল জলপ্রবাহ অনুসারে, ভারতের সুন্দরবনের বৃহত্তম নদী (Largest River of Sundarban in India by Discharge Volume of Water)। ভারতীয় সুন্দরবন অঞ্চলের মধ্যবর্তী অংশে বিস্তৃত মাতলা নদীটি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ৪ টি ব্লকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ; যথা : ডানতীরে ক্যানিং-১ (Canning-I), ক্যানিং-২ (Canning-II)কুলতলি (Kultali) এবং বামতীরে বাসন্তী (Basanti)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : থাঞ্জাভুর – দক্ষিণ ভারতের শস্যভান্ডার

মাতলা নদীর উৎস কোথায়? ড. সুভাষ মিস্ত্রী রচিত ‘নদীমাতৃক সুন্দরবন’ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ক্যানিং (Canning) -এর নিকট বিদ্যাধরী, করতোয়া, আঠারো বাঁকী ও রামপুরা খাল মিলে মাতলা নদীর উৎপত্তি। আবার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ডিস্ট্রিক্ট সার্ভে রিপোর্ট অফ মাইনর মিনারেল অফ সাউথ ২৪ পরগণা ডিস্ট্রিক্ট (২০১৮)’ অনুসারে, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার দহরানি (Daharani) হল মাতলা নদীর উৎসস্থল এবং মোট দৈর্ঘ্য ৮৫.৮২ কিমি। সাধারণ অর্থে ক্যানিংয়ের উত্তর থেকেই মাতলা নদীর মূল প্রবাহ শুরু হয়েছে, যা এঁকেবেঁকে ক্রমশ দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর পুরন্দর (Purandar) -এর নিকট মাতলা নদী দুটি শাখাতে বিভক্ত হয়েছে। একটি শাখা পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বে প্রবাহিত হয়ে বাসন্তী (Basanti), পাঠানখালি (Pathankhali), মসজিদবাটি (Masjidbati) হয়ে গোসাবা (Gosaba) -এর পশ্চিমে বিদ্যাধরী নদী (Bidyadhari River) -তে মিলিত হয়েছে। অন্য শাখাটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে কুলতলি (Kultali), গরানবোস (Garanbose), কৈখালি (Kaikhali), ঝড়খালি (Jharkhali) হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মাতলার প্রধান উপনদী হল পিয়ালী নদী (Piyali River), যা কুলতলির নিকট মাতলার সাথে মিলিত হয়েছে। ঝড়খালির পর থেকে মাতলা নদী একাধিক বার বিভিন্ন খাল-শাখার মাধ্যমে পূর্বে প্রায় সমান্তরালে প্রবাহিত বিদ্যাধরী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। সুন্দরবনের লট নং ১২৪ (Lot No 124) -এর দক্ষিণে মাতলা পুনরায় দুটি শাখাতে বিভক্ত হয়েছে। একটি শাখা পূর্বদিকে বিদ্যাধরী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। অন্য শাখাটি আজমলমারি (Ajmalmari) ও ঢুলিভাসানি (Dhulibhasani) সংরক্ষিত অরণ্যের মধ্য দিয়ে কৈকালমারি (Kaikalmari) নামে প্রবাহিত হয়ে হ্যালিডে দ্বীপ (Halliday Island) -এর নিকট মাতলা-বিদ্যাধরী মিলিত প্রবাহের সাথে মিশেছে। অবশেষে মাতলা-বিদ্যাধরী মিলিত প্রবাহ পশ্চিমে কলস দ্বীপ (Kalas Island) ও পূর্বে মায়া দ্বীপ (Maya Island) -এর মধ্যবর্তী অংশে বঙ্গোপসাগর (Bay of Bengal) -এ মিলিত হয়েছে।

শুষ্ক ঋতুতে মাতলা নদী শীর্ণকায় হলেও, বর্ষাতে মাতলা নদীর ভয়াল মত্ত রূপ দেখা যায়। মত্ততা থেকেই মাতলা নামটির উৎপত্তি হয়েছে। মাতলা নদী ব্যবস্থার পশ্চিম ও পূর্ব উভয় দিকেই পার্শ্ববর্তী সংযোগ হিসেবে একাধিক নদী ও খাল রয়েছে। পশ্চিম দিকে রয়েছে সুইয়া গাং (Suia Gang), ঢুলিভাসানি গাং (Dhulibhasani Gang), চুলকাঠি গাং (Chulkathi Gang), গোখালতলি গাং (Gokhaltali Gang) প্রভৃতি। পূর্ব দিকে গোসাবা ও রায়মঙ্গল নদী ব্যবস্থার সাথে যুক্ত নদী ও খালগুলি এক জটিল নদী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। পূর্ব দিকে রয়েছে রূপখালি খাল (Rupkhali Channel), পাঠানখালি নদী (Pathankhali River), পীরখালি নদী (Pirkhali River), গাজীখালি খাল (Gazikhali Channel), পাঁচমুখানি খাল (Panchmukhani Channel), মায়াদ্বীপ নদী (Mayadwip River), ভাঙ্গাদুনি নদী (Bhangaduni River) প্রভৃতি। মাতলা নদীর ওপর প্রধান সেতু হল ক্যানিং শহর (Canning Town) -এর নিকট ৬৪৪ মিটার দীর্ঘ মাতলা সেতু (Matla Bridge)। ২০১১ সালে চালু হওয়া এই সেতুটি ক্যানিং এবং বাসন্তীকে যুক্ত করেছে। মাতলার তীরে অবস্থিত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হল ক্যানিং (Canning)। লর্ড ক্যানিংয়ের নাম অনুসারেই ক্যানিং নামটি এসেছে। লর্ড ক্যানিং সিঙ্গাপুর বন্দরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং কলকাতা বন্দরের বিকল্প হিসেবে ক্যানিংয়ে বন্দর গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবায়িত হয়নি। উল্লেখ্য, ক্যানিং সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার (Gateway of Sundarban) নামেও পরিচিত। ভারতীয় রেল ২০২২ সালে ক্যানিং থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চাঁদখালি হল্ট স্টেশনের নামকরণ করে মাতলা হল্ট (Matla Halt)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পর্যটন – বাঁকুড়ার বিহারীনাথ পাহাড়

বর্ষাকালে মাতলা নদীতে জল প্রবাহ অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যায়। এই সময় মাতলার দুই তীরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। বর্ষাকাল ছাড়াও প্রতি বছর ভরা কোটাল বা ঘূর্ণিঝড়ের দাপটেও মাতলা তীরবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়। এ কারণেই মাতলা নদীকে ‘সুন্দরবনের আতঙ্ক’ বা ‘সুন্দরবনের ত্রাস’ (Fear of Sundarban) বলা হয়। মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ শীর্ষক গল্পে আমরা ঝড়বৃষ্টিতে মাতলা নদীর জলপ্লাবনের পরিচয় পাই। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান (২০২০) -এর জেরে ক্যানিংয়ের মধুখালি গ্রামে মাতলা নদীর প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার নদীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বহু জায়গায় নদীবাঁধ ভাঙনের ফলে প্লাবিত হয়েছিল একের পর এক গ্রাম। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস (২০২১) -এর জেরে কংক্রিটের বাঁধ ভেঙে মাতলার জলে প্লাবিত হয়েছিল কুলতলির বিস্তীর্ণ এলাকা। ২০২২ সালের মে মাসে ভরা কোটালে মাতলার নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কুলতলি।

সুন্দরবনের যেকোনো নদীর মতো মাতলা নদীও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ। মাতলা নদীতে কই ভোলা, কান মাগুর, পোয়া ভোলা, খয়রা, পার্শে প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। মাতলা নদীতে ইলিশ মাছও পাওয়া যায়। এছাড়া বাগদার মীন, ফুল চিংড়ি পাওয়া যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ক্যানিংয়ে মাতলা নদীতে একটি কই ভোলা মাছ (Koi Bhola Fish) ধরা পড়ে, যার ওজন ছিল ৭৪ কেজি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যানিংয়ে মাতলা নদীর চর থেকে একটি গাঙ্গেয় ডলফিন (Gangetic Dolphin) -এর দেহ উদ্ধার হয়। ২০২২ সালের জুন মাসে ক্যানিংয়ে মাতলা নদীতে মৎস্যজীবীদের জালে ধরা পড়ে ১১ কেজি ওজনের বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ (Sea Turtle)। তবে, ক্যানিং-সহ মাতলা নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ম্যানগ্রোভ কেটে মাছের ভেড়ি তৈরি হচ্ছে। ফলে সংকটে নদীবাঁধ ও জীববৈচিত্র্য। এছাড়া অত্যধিক মাছ ধরা, নদী মজে যাওয়ার কারণে মাতলা-সহ সুন্দরবনের সকল নদী, খাঁড়িতে কমেছে বাগদার মীন। ফলে অর্থনৈতিক সমস্যার মুখে মৎস্যজীবীরা। বঙ্গোপসাগরের নিকটে মাতলা নদীর মুখে প্রায় ৬ বর্গকিমি বনাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছে হ্যালিডে দ্বীপ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য (Halliday Island Wildlife Sanctuary), যা সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অন্তর্গত। ১৯৭৬ সালে এটি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য রূপে ঘোষিত হয়। এই অভয়ারণ্যে চিতল হরিণ, বন্য শূকর, লাল বাঁদর, নোনাজলের কুমীর দেখা যায়। কখনো কখনো বাঘও দেখা যায়।

সুন্দরবনের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার উৎস মাতলা নদী। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও মানুষের স্বার্থান্বেষী কর্মকান্ডে মাতলা নদী কার্যত বিপর্যস্ত। চাই টেকসই নদীবাঁধ নির্মাণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। স্থিতিশীল উন্নয়নের আলোকে পরিবেশ-প্রকৃতি বাঁচানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকা অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা দরকার — ‘নদী বাঁচলে, বাঁচবে মানুষ’। (Matla River of Sundarban)

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]

লেখিকাঃ- তাহামিনা হোসেন (বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- নদীমাতৃক সুন্দরবন – ড. সুভাষ মিস্ত্রী – সৃষ্টি সন্ধান ; District Environmental Plan, South 24 Parganas, West Bengal (2022) ; District Disaster Management Plan-2015, South 24 Parganas ; District Survey Report of Minor Mineral of South 24 Parganas District ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; বর্তমান পত্রিকা ; এইসময় ; সংবাদ প্রতিদিন ; প্রতিদিন 24×7 ; হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা ; Observed changes in water mass properties in the Indian Sundarbans (northwestern Bay of Bengal) during 1980-2007 – Abhijit Mitra, Avijit Gangopadhyay, Anumeha Dube, Kakoli Banerjee (2009) ; জি ২৪ ঘন্টা ; নিউজ ১৮ বাংলা ; Mandal, Asim Kumar (2003). The Sundarbans of India: a development analysis By Asim Kumar Mandal. ISBN 9788173871436

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পর্যটন – রায়দিঘির জটার দেউল

4 thoughts on “Matla River of Sundarban

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!