Majuli – Largest River Island of India
মাজুলি – ভারতের বৃহত্তম নদী দ্বীপ
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Majuli – Largest River Island of India । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি ভারতের বৃহত্তম নদী দ্বীপ মাজুলি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

মাজুলি (Majuli) ভারতের অসম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ (Brahmaputra River)-এর ওপর অবস্থিত একটি নদী দ্বীপ (River Island), যা ভারতের বৃহত্তম নদী দ্বীপ (Largest River Island of India)। ‘মাজুলি’ শব্দটি অসমীয়া শব্দ ‘মাজালি’ (Majali) থেকে এসেছে, যার অর্থ হল ‘দুটি সমান্তরাল নদীর মধ্যবর্তী ভূমি’ (Land between Two Parallel Rivers)। ভিন্ন মতে, মাজুলি শব্দটি মা অর্থে দেবী লক্ষ্মী এবং অসমীয়া শব্দ জুলী/জুলি অর্থে ভান্ডার থেকে এসেছে। এই দ্বীপ শস্য এবং মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ হওয়ার কারণে এইরূপ নামকরণ হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা ৮৪.৫ মিটার। মাজুলি নদী দ্বীপটি ভৌগোলিক বিস্তৃতি ২৬°৪৫’ উত্তর থেকে ২৭°১২’ উত্তর এবং ৯৩°৩৯’ পূর্ব থেকে ৯৪°৩৫’ পূর্ব। ২০১৬ সালের ৮ ই সেপ্টেম্বর মাজুলি অসমের একটি জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। মাজুলিই হল ভারতের প্রথম কোনো নদী-দ্বীপ, যা একটি স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা লাভ করে (First River Island District of India)। দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং উত্তরে ব্রহ্মপুত্রেরই শাখানদী (Anabranch) খেরকুটিয়া জুতি (Kherkutia Xuti) সুবনসিরি বা সোবনশিরি নদী (Subansiri River) -এর সাথে যুক্ত হয়ে মাজুলি দ্বীপটি গঠন করেছে।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস (Guinness World Records) অনুসারে (০১/০১/২০০১), ৮৮০ বর্গকিমি বা ৩৪০ বর্গমাইল আয়তনের মাজুলি হল বিশ্বের বৃহত্তম নদী-দ্বীপ (World’s Largest River Island)। তবে মাজুলির আয়তন গত ২০০ বছর ধরে ক্ষয়ের ফলে বর্তমানে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ হিসেবে ব্রাজিলের দুটি দ্বীপ উল্লেখ্য — মারাজো (Marajó) এবং বানানাল (Bananal)। তবে দুটি দ্বীপই প্রকৃত অর্থে নদী দ্বীপ কি না, তা নিয়ে ভূমিরূপবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা (Encyclopaedia Britannica) -এর অনুসারে, ব্রাজিলের অরাগুয়াইয়া নদীর ওপর গঠিত বানানাল দ্বীপ (আয়তন ১৯,১৬২ বর্গকিমি) হল পৃথিবীর বৃহত্তম অন্তর্দেশীয় নদী-দ্বীপ (World’s Largest Inland River Island)। তবে বিশ্বে মাজুলির চেয়ে আয়তনে বড়ো অনেক নদী দ্বীপ রয়েছে। তাই, বর্তমানে মাজুলিকে ভারতের বৃহত্তম নদী দ্বীপ বলা-ই যুক্তিযুক্ত হবে। (Majuli – Largest River Island of India)
মাজুলি দ্বীপটির আয়তন কত? এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ১৮৫৩ সালে মাজুলির আয়তন ছিল ২,৮২,১৬৫ একর বা ১১৪১.৮৮ বর্গকিমি (Report on Province of Assam, A. J. Mafat Mills)। IJCRT -তে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্র (২০২১) অনুসারে, ১৯৭১ সালের জনগণনা তথ্যে মাজুলি দ্বীপের আয়তন ছিল ১২৪৫.৫৯ বর্গকিমি, যা ১৯৯১ সালে হ্রাস পেয়ে ৯২৪.৬০ বর্গকিমিতে দাঁড়ায়। অসম সরকার এবং মাজুলি জেলা প্রশাসন প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ১৯৫০ সালে মাজুলি দ্বীপের আয়তন ছিল ১২৫০ বর্গকিমি, যা বর্তমানে ৮৮০ বর্গকিমি, ৮৭৫ বর্গকিমি, ৪৮৩ বর্গকিমি হিসেবে উল্লেখিত রয়েছে। ইউনেস্কোর ওয়েবসাইট মতে, মাজুলি দ্বীপের দৈর্ঘ্য ৮০ কিমি, প্রস্থ ১০-১৫ কিমি ও আয়তন ৮৭৫ বর্গকিমি । কিন্তু ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে মাজুলি দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩৫২ বর্গকিমি (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, ২০১৪)। মাজুলি দ্বীপের আশেপাশে ৩০ টিরও বেশি ক্ষুদ্র বালুচর (Sandbars) রয়েছে। এই ক্ষুদ্র বালুচর দ্বীপগুলি ‘চাপোরি’ (Chapori) নামে পরিচিত।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ইজরায়েলের লবণ গুহা মালহাম
মাজুলি জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুসারে, কমপক্ষে ত্রয়োদশ শতকের আগেই মাজুলি দ্বীপ হিসেবে গড়ে ওঠে। ড: ডি. নাথের ‘The Majuli Island, Society, Economy and Culture’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৫৬৩ সালে এই দ্বীপেই কোচ রাজা নর নারায়ণ (Koch King Nara Narayan) আহোম রাজা সুখাম্ফা (Ahom King Sukhaamphaa) -এর সাথে ‘মাজুলির সন্ধি’ (Treaty of Majuli) স্বাক্ষর করেন। ১৭৭৬ সালে আহোম রাজা লক্ষ্মী সিংহ (Lakshmi Singha) -এর এক অনুদান পত্রে মাজুলি প্রদেশের উল্লেখ রয়েছে। মাজুলি অসমীয়া নব্য-বৈষ্ণব (Neo-Vaishnavism) সংস্কৃতির পীঠস্থান। ষোড়শ শতাব্দীর সমাজ সংস্কারক, মমহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব (Srimanta Sankardev) -এর ভ্রমণ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন সময় মাজুলি অসমীয়া সভ্যতার সাংস্কৃতিক রাজধানী (Cultural Capital) ছিল। মধ্যযুগের নব্যবৈষ্ণব আন্দোলনের পথিকৃৎ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব হিন্দু ধর্মের একাত্ববাদ রূপে ‘বৈষ্ণববাদ’-এর প্রচার করেন এবং ‘সত্ৰ’ (Satra) নামে বিভিন্ন মঠ ও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। মাজুলি দ্বীপটি খুব শীঘ্রই এই সত্ৰগুলি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষ্ণববাদের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে মাজুলি দ্বীপ ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। স্বাধীনতার পর, মাজুলি অসমের জোড়হাট জেলার অংশ ছিল, যা ২০১৬ সালে পৃথক জেলা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।
মাজুলি দ্বীপকে ভৌগোলিক ভাবে ৪ ভাগে বিভক্ত করা যায় — (১) উজানী মাজুলি (২) মধ্য মাজুলি (৩) নামোনী মাজুলি এবং (৪) চাপোরি (বালুচর)। ব্রহ্মপুত্রের বুকে মাজুলি জীববৈচিত্র্যের এক আধারস্থল। ২০১৭ সালে অসম সরকার ‘মাজুলি জীববৈচিত্র্য হেরিটেজ সাইট’ গঠন করে। মাজুলি দ্বীপের প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি গুলি হল — শিশু, জারুল, শিমূল, কালোজাম, বান্দরহোলা, জল কদম, হিজল, ডুমুর, বৈশাখী, বড়-কুকুরচিতা ইত্যাদি। এছাড়া নল, উলুখাগড়া, বেত প্রভৃতি জলাভূমির উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন প্রকার ঘাস দেখা যায়। মাজুলি দ্বীপের প্রধান প্রাণী প্রজাতি গুলি হল — হাতি, বন্য মহিষ, মায়া হরিণ, নাত্রিণী হরিণ, শিয়াল, জংলি বিড়াল, মেছো বিড়াল, প্যাঙ্গোলিন ইত্যাদি। এছাড়া কখনো কখনো বাঘ ও গন্ডার দেখা যায়। এই দ্বীপের নিকটস্থ জলভাগে গাঙ্গেয় ডলফিন দেখা যায়। উল্লেখ্য, মাজুলি দ্বীপে ১৫০ টিরও বেশি জলাভূমি রয়েছে, যেগুলি স্থানীয়ভাবে বিল/ডুবি (Beel/Dubi) নামে পরিচিত। রিপোর্ট অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড বায়োরিসোর্স অফ মাজুলি আইল্যান্ড (২০১০) অনুসারে, মাজুলি দ্বীপের বিলগুলিতে ১০৬ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। মাজুল দ্বীপ একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষী এলাকা (Important Bird Area) এবং এই দ্বীপে ২২৫ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। তবে, মাজুলি দ্বীপে অব্যাহত ভাঙন ও বন্যা এই দ্বীপটিকে তার মূল আয়তনের অর্ধেক করে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে অত্যধিক পলিস্রাবের (Sediment Discharge) ফলে দ্বীপটি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে অধিক বরফ গলন ও আকস্মিক অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদে সৃষ্ট বন্যাতে মাজুলি দ্বীপের আয়তন ক্রমহ্রাসমান। সাম্প্রতিক সময়ে, মাজুলি দ্বীপের মিসামারা, শামাগুড়ি, কমলাবাড়ি, সালমোরা ইত্যাদি এলাকাগুলিতে ব্যাপক ক্ষয় ও ভাঙন দেখা গেছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : উত্তর-পূর্ব ভারতের লোকনৃত্য
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মাজুলির জনসংখ্যা প্রায় ১.৬৭ লক্ষ এবং জনঘনত্ব ৩০০ জন/বর্গকিমি। এই দ্বীপে প্রধানত মিসিং (Missing), দেওরি (Deori), সোনোয়াল কাছাড়ি (Sonowal Kachari) ইত্যাদি উপজাতি এবং কোচ (Koch), কালিতা (Kalita), অহোম (Ahom) ইত্যাদি অ-উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। মাজুলিতে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন মিসিং সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা কয়েক শতক পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ থেকে মাজুলিতে এসেছিলেন। বর্তমানে মাজুলি দ্বীপে ২৪৩ টি গ্রাম রয়েছে। এই দ্বীপে ব্যবহৃত প্রধান ভাষাগুলি হল মিসিং, দেওরি ও অসমীয়া। জীববৈচিত্র্যের সাথে সাথে এই দ্বীপ একটি বিশেষ দিক থেকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, তা হল সংস্কৃতি। প্রত্যেক বছর নভেম্বর মাসে তিনদিন ব্যাপী বিরাট ‘রাস লীলা’ অনুষ্ঠিত হয়। এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হল হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব ধারার সত্র (আশ্রম ও মঠ)। বর্তমানে এখানে ২২টি সত্র রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — কমলাবাড়ি সত্র (সাহিত্য, শাস্ত্র অধ্যয়ন করা হয়) ঔনিয়তি সত্র (অপ্সরা ও পালনাম নৃত্যের জন্য বিখ্যাত) দক্ষিণপত সত্র, শামাগুড়ি সত্র ইত্যাদি।
মাজুলি দ্বীপের একটি বিশেষ আকর্ষণ হল মুখোশ কারুশিল্প (Mask Craft)। এই দ্বীপে বাঁশ, বেত, কাদামাটি দিয়ে তৈরি মুখোশ ‘মাজুলি মুখোশ’ (Majuli Mask) নামে পরিচিত। এখানে ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী ও লোককাহিনীর বিভিন্ন দেব-দেবী, অসুর ও অন্যান্য জাগতিক চরিত্রগুলির মুখোশ তৈরি হয়। এখানে তৈরি মুখোশগুলি মূলত তিন রকমের হয় — (১) মুর মুখ (Mur Mukha), অর্থাৎ শুধুমাত্র মুখ ঢাকা মুখোশ (২) বড় মুখ বা সু মুখ (Bor Mukha/Su Mukha), অর্থাৎ পুরো শরীর ঢাকা মুখোশ (৩) লুতুকোরি মুখ (Lutukori Mukha), অর্থাৎ বড় মুখ বা সু মুখ থেকে তুলনামূলক ছোটো মুখোশ। এইসব মুখোশগুলি রাসলীলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় ব্যবহার করা হয়। ২০২৪ সালে মাজুলি মুখোশ ভৌগোলিক নির্দেশক (G.I.) তকমা লাভ করেছে। এছাড়া মাজুলি দ্বীপের অন্যান্য আকর্ষণগুলি হল — শীতের মরশুমে পরিযায়ী পাখি, নদী তীরে মিসিং উপজাতির বাঁশের কুঁড়েঘর, তোরা পাতায় রান্না করা চাল ও কলা পাতায় রান্না করা মাছ (পামনাম), দশেরা ও দীপাবলির সময় আদিবাসী নৃত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায় যে, পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে মাজুলি নদী দ্বীপকে ক্ষয় ও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। কারণ শুধুমাত্র একটি নদী দ্বীপ নয়, মাজুলি দ্বীপ হল জীববৈচিত্র্যের সম্ভার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এক অমূল্য সম্পদ। (Majuli – Largest River Island of India)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- ময়ূরী দাস (কলকাতা)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; Times of India ; India Times ; Incredible India ; Hindustan Times ; Tribune India ; Official Website of Majuli District, Assam ; Report on Biodiversity and Bioresources of Majuli Island (2010) – Prosanta Hazarika, B.K. Pandey, Yogesh Chandra Tripathi – Rain Forest Research Institute ; A Study of Biodiversity and Its Conservation in Majuli – Tulashi Rajkhowa – International Journal of Creative Research Thoughts (IJCRT), Volume 9, Issue 10 Oct 2021
Pingback: Topic - Fish of Sundarban - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Tourism - Jatar Deul of Raidighi - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: UNESCO World Heritage Sites of India - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: WBBSE Madhyamik Geography Syllabus - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: WBPSC ASSISTANT MASTER/MISTRESS GEOGRAPHY SYLLABUS - ভূগোলিকা-Bhugolika