Lonar Lake of Deccan
দাক্ষিণাত্যের লোনার হ্রদ
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Lonar Lake of Deccan । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি দাক্ষিণাত্যের লোনার হ্রদ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমি (Deccan Plateau)-তে অবস্থিত লোনার হ্রদ (Lonar Lake) হল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব্যাসল্ট শিলার হ্রদ এবং ব্যাসল্ট শিলার ওপর গঠিত বিশ্বের একমাত্র লবণাক্ত হ্রদ। প্রশাসনিক ভাবে, লোনার হ্রদ ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের বুলধানা জেলার লোনার তালুকে অবস্থিত। মুম্বাই থেকে প্রায় ৫৫০ কিমি এবং নাগপুর থেকে ৩৬০ কিমি দূরে লোনার হ্রদ একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এই হ্রদের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর বহু পর্যটক ভিড় জমান। প্রায় ৫২ হাজার বছর আগে তৈরি এই হ্রদ নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদদের মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই।
প্রসঙ্গত, লোনার হ্রদটি সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৫২ হাজার বছর আগে। প্লিস্টোসিন যুগে একটি বিশাল গ্রহাণু এই স্থানে আছড়ে পড়েছিল। যা ঘন্টায় প্রায় ৯০ হাজার কিমি বেগে পূর্বদিক থেকে ৩৫-৪০ ডিগ্রি কোণে ধেয়ে এসেছিল। সেই গ্রহাণু সংঘর্ষের ফলেই সুবিশাল গর্ত (Impact Crater) -এর উৎপত্তি ঘটে এবং কালক্রমে জল জমে হ্রদের সৃষ্টি হয়। ওই গ্রহাণু ওজন ছিল প্রায় ২ মিলিয়ন টন। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর মহাদেশীয় ভূত্বকে ব্যাসল্ট শিলার ওপর গ্রহাণুর আঘাতে গঠিত ৪ টি গর্ত (Impact Crater) আবিষ্কৃত হয়েছে। লোনার ক্রেটার তারই একটি ; বাকি তিনটি ব্রাজিলে রয়েছে।
লোনার হ্রদটির গড় ব্যাস প্রায় ১.২ কিমি (৩৯০০ ফুট) এবং গড় গভীরতা ১৩৭ মিটার (৪৪৯ ফুট)। হ্রদটির পরিধি প্রায় ১.৮ কিমি (৫৯০০ ফুট)। আগ্নেয় ব্যাসল্ট শিলাস্তরের উপর গঠিত এই হ্রদ ৭৭.৬৯ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট। ২০১৫ সালে ভারত সরকার এই হ্রদের চারপাশের প্রায় ৩.৮ বর্গকিমি এলাকাকে লোনার বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য রূপে ঘোষণা করে। এই হ্রদের আকৃতি প্রায় গোলাকার বা ডিম্বাকার। তবে হ্রদটির চারপাশে খাড়া পাহাড়ি ঢাল লক্ষ্য করা যায়। লোনার হ্রদের জলের গভীরে ১ মিটারের নিচে অক্সিজেনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়না। এই হ্রদের জল অতিরিক্ত মাত্রায় লবণাক্ত ও ক্ষারকীয়। জলের উপরিস্তরের pH মাত্রা ৭ এবং গভীরে জলের pH মাত্রা ১১। এই জন্য এই হ্রদকে অনেকে ‘সোডা হ্রদ’ (Soda Lake) বলেও উল্লেখ করেন।
২০১৭ সালে মহারাষ্ট্র রাজ্য বনদপ্তর লোনার হ্রদকে রামসার সাইটের আওতায় আনার প্রস্তাব দেয় এবং ২০২০ সালের ২২ শে জুলাই লোনার হ্রদের ৪২৭ হেক্টর অঞ্চল মহারাষ্ট্রের দ্বিতীয় রামসার সাইট (প্রথম নান্দুর মধ্যমেশ্বর পক্ষী অভয়ারণ্য) রূপে চিহ্নিত হয়। লোনার হ্রদের চারপাশে বিস্তৃত ‘লোনার বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য’ এক বিশাল জীববৈচিত্র্যের সম্ভার। এইজন্য এটিকে ১৯৭৯ সালে ‘National Geo Heritage Monument’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখানে প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখি, ৪৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এখানে এক বিশেষ প্রজাতির নেকড়ে (ধূসর নেকড়ে) দেখা যায়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : চ্যাংমারি চা বাগান
২০২০ সালের জুন মাসে এই হ্রদের জল গোলাপি রঙের হয়ে গিয়েছিল। এই বিষয়টি বৈজ্ঞানিক মহল ও সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন তৈরি করেছিল। বিশেষজ্ঞরা জানান, এর আগেও কয়েকবার লোনার হ্রদের জলের রঙে লালচে বা গোলাপি আভা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ২০২০-র জুনে রঙের আধিক্য বেশি। প্রাথমিক ভাবে বিশেষজ্ঞরা জানান, হ্রদের জলের তলায় থাকা উদ্ভিদরাজিতে পরিবর্তন বা জলের লবণাক্ততা বা ক্ষারের মাত্রা পরিবর্তনের জেরেও রংবদল হতে পারে। পরে, পুণের আঘরকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, লোনার হ্রদের জলে ‘Haloarchaea’ বা ‘Halophilic Archaea’ নামক লবণ-প্রিয় ব্যাকটেরিয়া প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, যা গোলাপি পিগমেন্ট তৈরি করে। গ্রীষ্মকালে জলের পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়ে লবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। যে কারণেই লোনার হ্রদের জল গোলাপি রঙ ধারণ করেছিল। যা বর্ষায় জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় আবার আগের অবস্থায় সবুজাভ রঙে ফিরে আসে।
বর্তমানে অনেকগুলি কারণে লোনার হ্রদে দূষণের মাত্রা বাড়ছে। যথা — (১) হ্রদের নিকটবর্তী কৃষিজমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার (২) হ্রদটিতে জলের জোগান দেওয়া নিত্যবহ দুই স্রোতস্বিনী ‘ধারা’ ও ‘সীতা নাহানি’-তে স্থানীয় বাসিন্দা কর্তৃক স্নান, পোশাক ধোওয়া এবং গবাদি পশুর স্নান প্রভৃতি কর্মকান্ড (৩) হ্রদের চারিপাশে বেআইনি ভাবে বৃক্ষচ্ছেদন এবং পশুচারণ (৪) কমলা দেবী উৎসব সহ বিভিন্ন স্থানীয় উৎসব চলাকালীন হ্রদের নিকট দোকান স্থাপন (৫) নিকটবর্তী বসতিগুলি থেকে নর্দমার জল হ্রদে সঞ্চয় প্রভৃতি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দ্রুত লোনার হ্রদের দূষণ রোধ করার কথা বলেছেন। নাহলে অচিরেই লোনার হ্রদের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- স্বর্ণশ্রী বাইন (কলকাতা)
তথ্যসূত্রঃ- The Hindu ; Official Website of Buldhana District, Maharashtra, India ; Wikipedia ; Official Website of Ramsar Site ; Hindustan Times ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; সংবাদ প্রতিদিন
দারুন একটি ভৌগোলিক প্রবন্ধ।
ধন্যবাদ ❤️
Pingback: Lakshadweep - Paradise of Tourists - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Deomali of Odisha Travel - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Bhatra - Mini Digha of Malda - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Story of Blue Planet - Our Earth - ভূগোলিকা-Bhugolika
Outstanding
ধন্যবাদ ❤️