Hul Diwas in Santali Culture
সাঁওতালি সংস্কৃতিতে হুল দিবস
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Hul Diwas in Santali Culture । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সাঁওতালি সংস্কৃতিতে হুল দিবস সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

সংস্কৃতি (Culture) শব্দটির আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হল সংস্কৃতি (টেলর, ১৯৭৪)। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর একটি নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীতে স্মরণাতীত কাল থেকে প্রচলিত স্বতন্ত্র সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, বিশ্বাস, আচরণ প্রভৃতি সাঁওতালি সংস্কৃতি (Santali Culture) নামে পরিচিত। আর, সংস্কৃতির সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক নিবিড়। কেননা, সামগ্রিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে এবং কোনো জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সভ্যতা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির কথা বিশেষভাবে উঠে আসে। সাঁওতাল সমাজ-সভ্যতার প্রেক্ষাপটে ‘হুল দিবস’ (Hul Diwas) এমনই এক উদযাপন, যার ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও রয়েছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ঝাড়গ্রামের পরিবেশবান্ধব শাল পাতা
সাঁওতাল (Santal) কারা? মূলত পূর্ব ভারতের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী (Ethnic Group) হল সাঁওতাল। সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড) জনগোষ্ঠীর বংশধর এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ‘আদিবাসী’ রূপে পরিচিত জনজাতির অন্যতম প্রধান জনগোষ্ঠী। ভারতের সংবিধান অনুসারে, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী তফশিলি উপজাতি (Schedule Tribe)-এর অন্তর্গত। ধারণা করা হয়, মেদিনীপুর অঞ্চলের ‘সাওন্ত’ এলাকার অধিবাসী হিসেবে এই জনগোষ্ঠী সাঁওতাল নামে পরিচিত লাভ করে। তবে, এই জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘হড় হপন’ (Hor Hopon) অর্থাৎ ‘মানবজাতির সন্তান’ (Sons of Mankind) বলে থাকে (সমার্স, ১৯৭৯)। ভারতের ঝাড়খন্ড (সর্বাধিক সংখ্যক), পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার ও আসাম রাজ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এছাড়া বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানেও সাঁওতাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ১২ টি গোত্রে বিভক্ত ; যথা : হাঁসদা, মুর্মু, মান্ডি, কিস্কু, সরেন, হেমব্রম, টুডু, বেসরা, বাস্কে, চঁড়ে, পাউরিয়া, বেদেয়া (সূত্র : পশ্চিমবাংলা আদিবাসী মূলবাসী সমাজ)। এই জনগোষ্ঠীর ভাষা হল সাঁওতালি এবং এই সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রধানত হিন্দু ও সারনা উপজাতি ধর্মের প্রচলন দেখা যায়।
‘হুল’ শব্দটির অর্থ হল বিদ্রোহ বা সংগ্রাম। তৎকালীন ইংরেজ ও জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ১৮৫৫ সালের ৩০ শে জুন বর্তমান ঝাড়খন্ডের ভগনাডিহি গ্রামে মূলত সিধু-কানুর নেতৃত্বে ৩০-৪০ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল। একই পরিবার থেকে ছয় ভাই-বোন (সিধু মুর্মু, কানু মুর্মু, চাঁদ মুর্মু, ভৈরব মুর্মু, ফুলমণি মুর্মু ও ঝালোমণি মুর্মু) এই বিদ্রোহ-আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিলেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। এই বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে যা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ (Santal Rebellion) বা ‘সাঁওতাল হুল’ নামে পরিচিত। বস্তুত সাঁওতাল বিদ্রোহই ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। আর, ভগনাডিহি থেকে কলকাতা অভিমুখে বীর সিধু-কানুরা যে গণপদযাত্রা করেছিলেন, তা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণপদযাত্রা। হুলের প্রতীক ছিল শাল গাছ, যা অরণ্য কেন্দ্রিক আদিবাসী সমাজচিত্র এবং সাঁওতালি সমাজে শাল গাছের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তুলে ধরে।১৮৫৫ সালের ৫ ই ডিসেম্বরে সিধু এবং ১৮৫৬ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারিতে কানু ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেন (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা)। দুই বোন ফুলমণি ও ঝালোমণিকে ইংরেজরা ধর্ষণ করে হত্যা করে। হাজার হাজার সাঁওতাল প্রাণ হারান। ১৮৫৬ সালের নভেম্বরে ইংরেজদের গোলাবারুদের সামনে তীরধনুকের লড়াই স্তিমিত হয়। সাঁওতাল হুল ব্যর্থ হলেও, এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিকামী মানুষদের অনুপ্রেরিত করেছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – বিশ্ব আদিবাসী দিবস
মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মরণে প্রতি বছর ৩০ শে জুন তারিখটি ‘হুল দিবস’ বা ‘সাগুন হুল মহা’ (Sagun Hul Maha) রূপে পালন করা হয়। সিধু-কানু সহ সকল বিদ্রোহীর সংগ্রাম ও আত্মবলিদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। হুল দিবস শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্মরণ দিবস নয়, এ হল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জাত্যভিমান ও গৌরবের দিন, সামাজিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক। ১৯৮৩ সালের ৩০ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সরকারি ভাবে এই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার হুল দিবসে ছুটি ঘোষণা করেছে। এ রাজ্যে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাচ-গান, নাটকের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সগৌরবে হুল দিবস উদযাপন করা হয়। হুল দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যবাহী সাজে তীর, ধনুক, ঢোল, ধামসা, মাদল, সানাই নিয়ে বর্ণাঢ্য নৃত্য করে থাকে। কোথাও কোথাও সাঁওতালি রীতিনীতি অনুসারে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। এছাড়া পদযাত্রা, সভা, শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে হুল দিবস পালিত হয়।
কিন্তু সাঁওতালি লেখক-বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, হুল দিবস কি এবং কেন, সে নিয়ে চর্চাই হয় না। একই সঙ্গে তাঁদের অনুযোগ, নতুন প্রজন্ম এবিষয়ে তেমন একটা খোঁজ রাখে না। কিন্তু, সাঁওতাল হুলের মাহাত্ম্য ভুলে গেলে চলবেনা। কেননা, আজও বৃহত্তর ভারতীয় সমাজে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই জারি রয়েছে। তাই, মহাশ্বেতা দেবী-র সেই উক্তি যেন আজও সত্য : ‘আদিবাসীরা আজও যেখানে হকের লড়াই লড়ছে, সে লড়াই সিধু-কানু ও বিরসা মুন্ডাদের ফেলে যাওয়া লড়াই। শালবনে ফুল ফোটার যেমন শেষ নেই, আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রামের তেমন শেষ নেই’।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকাঃ- সোনালী মুর্মু (চকফতেউল্লা, ডেবরা, পশ্চিম মেদিনীপুর)
তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা ; Wikipedia ; প্রথম আলো ; সার সাগুন পত্রিকা ; নিউজ ১৮ বাংলা ; আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা – পরিমল হেমব্রম ; হড়কোরেন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃ কাথা – কলিয়ান হাড়াম ; পশ্চিমবাংলা আদিবাসী মূলবাসী সমাজ
Pingback: Madhyamik Geo Chapter-I MCQ Part-I - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Nationalized Banks in India » NIRYAS.IN
Pingback: Indian Ocean Trenches In English » NIRYAS.IN
Pingback: WBSSC GROUP-D SYLLABUS - ভূগোলিকা-Bhugolika