Tuesday, July 29, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

History of Naming of SouthBengal’s Districts

দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : History of Naming of SouthBengal’s Districts । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

History of Naming of SouthBengal's Districts
দক্ষিণবঙ্গের মানচিত্র

যেকোনো স্থানের নাম ওই স্থান বা বৃহত্তর অঞ্চলের মানব ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে। আবার, নামের উৎপত্তি নিয়েও নানা বৈচিত্র্য রয়েছে। কখনও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কখনও স্থানীয় ঘটনা, ধর্ম-দেবতা, বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিখ্যাত জিনিসের নামেই অধিকাংশ স্থানের নামকরণ হয়েছে। তাই, নামকরণ শুধুমাত্র পরিচয়জ্ঞাপক শব্দরাজি নয়, যেকোনো স্থানের নামকরণের উৎপত্তি, সেই স্থান/অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। ভারতের পূর্বাংশে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্যে বর্তমানে ৫ টি প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্গত ২৩ টি জেলা রয়েছে। এর মধ্যে মালদা বিভাগের অন্তর্গত ১ টি জেলা, যথা : মু্র্শিদাবাদ ; বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত ৪ টি জেলা, যথা : পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম ও হুগলি ; মেদিনীপুর বিভাগের ৫ টি জেলা, যথা : পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগের ৫ টি জেলা, যথা : কলকাতা, হাওড়া, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা দক্ষিণবঙ্গের অন্তর্গত। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার দক্ষিণদিকের অংশই দক্ষিণবঙ্গ (South Bengal) নামে পরিচিত। আজকের এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণ কিভাবে হয়েছে (History of Naming of SouthBengal’s District)।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস

(১) মুর্শিদাবাদ: মুর্শিদাবাদ একটি ঐতিহাসিক শহর, যার নাম থেকেই মুর্শিদাবাদ জেলার নামকরণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, আইন-ই-আকবরী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, পূর্বে মুর্শিদাবাদ শহরের নাম ছিল মাকসুদাবাদ। ষোড়শ শতকে মাকসুদ খান নামক এক বণিক একটি সরাইখানা নির্মাণ করে মাকসুদাবাদ শহরের পত্তন করেন। ১৭০২ সালে বাংলার তৎকালীন দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ঢাকা থেকে মাকসুদাবাদে দেওয়ানি কার্যালয় স্থানান্তরিত করেন। এরপরই মুর্শিদকুলি খানের নামানুসারে মাকসুদাবাদের নতুন নাম হয় মুর্শিদাবাদ। তবে ঠিক কোন বছর ‘মুর্শিদাবাদ’ নামকরণ করা হয়েছিল এনিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। স্যার যদুনাথ সরকারের মতে ১৭০৩ সালে, ভিন্নমতে ১৭০৪ সালে মুর্শিদাবাদ নামকরণ করা হয়। উল্লেখ্য, মুর্শিদাবাদ শব্দটি আরবি শব্দ মুর্শিদ অর্থে বিচক্ষণ শিক্ষক বা পথপ্রদর্শক এবং ফার্সি শব্দ আবাদ অর্থে বাসস্থান থেকে এসেছে।

(২) পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান: ২০১৭ সালে অবিভক্ত বর্ধমান জেলা ভেঙে পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা গঠিত হয়। বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান শহরের নাম থেকেই অবিভক্ত বর্ধমান জেলার নামকরণ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, পূর্ব বর্ধমান জেলার গলসি-১ ব্লকের মল্লসারুল গ্রামে আবিষ্কৃত ষষ্ঠ শতকের একটি তাম্রপত্রে ‘বর্ধমান’ নামটির সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রশ্ন হল, বর্ধমান নামটির উৎপত্তি কিভাবে? এবিষয়ে মূলত দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। সর্বাধিক প্রচলিত মতে, জৈনধর্মের ২৪-তম তীর্থঙ্কর মহাবীরের বাল্যকালের নাম ‘বর্ধমান’ থেকেই ‘বর্ধমান’ নামটি এসেছে। জৈনধর্মের কল্পসূত্র গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বর্তমান বর্ধমানের নিকটস্থ অস্তিকগ্রামে মহাবীর কিছুসময় কাটিয়েছিলেন। বর্ধমান শহর থেকে মাত্র ২৫ কিমি দূরে অবস্থিত আঝাপুরের সাত দেউল জৈনমন্দির এবং অবিভক্ত বর্ধমান জেলার বর্ধমানের নিকট সাঁচড়া, রায়না ; কালনার নিকট বৈদ্যপুর ; আসানসোলের নিকট দোমোহানী, পাঁচড়া ; চুরুলিয়া প্রভৃতি স্থান থেকে প্রাপ্ত জৈনধর্মের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী অতীতে এই অঞ্চলে জৈনধর্মের সুস্পষ্ট উপস্থিতি তুলে ধরে এবং উপরোক্ত মতকে সমর্থন করে। অন্যমতে বলা হয়, বর্ধমান শব্দটির অর্থ হল সমৃদ্ধশালী ও বৃদ্ধিশীল। গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য সভ্যতার বিকাশের সময় বর্ধমান উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল। এ থেকেই বর্ধমান নামটির উৎপত্তি হয়েছে।

(৩) বীরভূম: ‘বীরভূম’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীনকালে বীর যোদ্ধাদের দেশ হিসেবে বীরভূমের নামডাক ছিল। ষোড়শ শতকে কবিরাম রচিত ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ গ্রন্থে বর্ণিত বীরদেশই হল বীরভূম। বর্তমান বীরভূম জেলার জেলাসদর সিউড়ি নামটি শৌর্য শব্দের অপভ্রংশ (শৌর্য > শূরী > সিউড়ি) থেকে এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। West Bengal District Gazetteers – Birbhum (১৯৭৫) এবং প্রকাশ চন্দ্র মাইতির ‘বীরভূম ইন দ্য ব্যাকড্রপ অফ প্রি-হিস্ট্রি’ থেকে জানা যায়, বীরভূমের নামকরণ নিয়ে মূলত তিনটি মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতে, বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষণ সেন দ্বাদশ শতাব্দীতে নিজের নাম অনুসারে লাক্ষনুর বা লক্ষ্ণৌর (বর্তমান রাজনগর) নামে একটি নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা পরে নাগর বা নগর নামে জনপ্রিয় হয়। সেই নগর-ই ছিল বীরভূমের রাজধানী। মুসলিম শাসকদের আধিপত্যের পূর্বে বীরভূমের ওই রাজধানীর সিংহাসনে আসীন ছিলেন বীররাজা নামে এক হিন্দু রাজা। তাঁরই নামানুসারে বীরভূম নামটি এসেছে। অন্যমতে, এই অঞ্চল ১৫০১-১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে মল্লশাসক বীর মল্ল-এর শাসনাধীন ছিল এবং তাঁর নামানুসারে বীরভূম নামটি এসেছে। আরেকটি মতে, সাঁওতালি ভাষাতে বীর শব্দের অর্থ হল অরণ্য। অরণ্য ও আদিবাসী অধ্যুষিত এই ভূমি সেই থেকেই বীরভূম নামে পরিচিত হয়েছে (History of Naming of SouthBengal’s Districts)।

(৪) হুগলি: ‘হুগলি’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে প্রধানত দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে, ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পর্তুগিজ বণিকেরা সপ্তগ্রাম থেকে সরে এসে বর্তমান হুগলি অঞ্চলে পণ্য মজুত করার জন্য গুদাম বা গোলা তৈরি করেছিল। সেই ‘গোলা’ শব্দ থেকেই ‘হুগলি’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে। তাঁর মতে, পর্তুগিজদের ভাষায় ‘ও-গোলিম’/’ও-গোলি’ কথাটিই বাঙালিদের উচ্চারণে ‘হুগলি’-তে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পর্তুগিজ আগমনের পূর্বেই, ১৪৯৫-৯৬ সালে রচিত বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসাবিজয় কাব্যগ্রন্থে ‘হুগলি’ নামটি পাওয়া যায়, যা উপরোক্ত মতকে প্রতিষ্ঠা করেনা। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মতেও, হুগলি নামটি পর্তুগিজদের দেওয়া নয়। তবে, শম্ভুচন্দ্র দে-এর মতে, ভাগীরথী (গঙ্গা) তীরবর্তী এই অঞ্চলে প্রচুর হোগলা গাছ ছিল। এই হোগলা গাছ থেকেই নদী ও এলাকার নাম হয়েছে হুগলি। হুগলি নামটিই পর্তুগিজদের বিকৃত উচ্চারণে ‘ও-গোলি’/’ও-গোলিম’/’হোয়েগলি’ ইত্যাদিতে পরিণত হয়েছিল।

(৫) পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর: ২০০২ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ভেঙে পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা গঠিত হয়। বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর শহরের নাম থেকেই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছিল। ‘মেদিনীপুর’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হল, রাজা মেদিনীকর-এর নাম থেকেই মেদিনীপুর নামটির উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাসবিদ শ্রী হরিসাধন দাস রচিত ‘মেদিনীপুর ও স্বাধীনতা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, গান্ডিচাদেশ (বর্তমান ওড়িশা) -এর সামন্তরাজা প্রাণকরের পুত্র মেদিনীকর ১২৩৮ সালে মেদিনীপুর শহর প্রতিষ্ঠা করেন। ১২০০ থেকে ১৪৩১ সাল পর্যন্ত কর বংশ মেদিনীপুরে রাজত্ব করেছিল। উল্লেখ্য, মেদিনীকর সংস্কৃত অভিধান ‘মেদিনীকোষ’ রচনা করেছিলেন। এছাড়া মেদিনীপুর নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে প্রচলিত কয়েকটি মত হল : এক, ১৫২৪ সালে মেদিনী মল্ল রায় নামে ওড়িশার এক প্রতাপশালী রাজা এই অঞ্চল জয় করেন এবং মেদিনীপুর নাম রাখেন। দুই, মেদিনীপুর শহরের পুরানো জেলখানার দেওয়ালে মেদিনীমাতার মন্দির ছিল। মেদিনীমাতা থেকেই মেদিনীপুর নামটি এসেছে। তিন, এই অঞ্চলে মেদ উপজাতির বাসস্থান থেকে মেদিনীপুর নামটির উৎপত্তি হয়েছে। চার, মেদ শব্দের অর্থ হাতি। অরণ্য অধ্যুষিত এই অঞ্চলে এক সময়ে অনেক হাতি ছিল, যা থেকেই মেদিনীপুর নামটি এসেছে।

(৬) ঝাড়গ্রাম: ২০১৭ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমাটি ‘ঝাড়গ্রাম জেলা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঝাড়গ্রাম শহরের নাম থেকেই ‘ঝাড়গ্রাম’ জেলার নামকরণ করা হয়েছে। ইতিহাস বলে, ১৫৯২ সালে রাজপুতানা থেকে আগত সর্বেশ্বর সিং ‘ঝাড়গ্রাম রাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাজধানীর নাম রাখেন ‘ঝাড়গ্রাম’। পূর্বে এই অঞ্চল জঙ্গলখন্ড ও ঝাড়িখন্ড নামে পরিচিত ছিল। ঝাড়গ্রাম শব্দটি ‘ঝাড়’ অর্থাৎ অরণ্য এবং ‘গ্রাম’ অর্থাৎ বসতি থেকে এসেছে। ঝাড়গ্রাম শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল অরণ্যকেন্দ্রিক গ্রাম, যা এই অঞ্চলে বনভূমির উপস্থিতিকে নির্দেশ করে (History of Naming of SouthBengal’s Districts)।

(৭) বাঁকুড়া: ‘বাঁকুড়া’ নামটির উৎপত্তি নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতে, কোল-মুন্ডা ভাষায় ‘বাঁকু’ অর্থাৎ সুন্দর এবং ‘ওড়া’/’ড়া’ অর্থাৎ বসতি থেকেই বাঁকুড়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। অর্থাৎ বাঁকুড়া শব্দের অর্থ হল সুন্দর বসতি। অন্যমতে, হিন্দু দেবতা ধর্মঠাকুরের স্থানীয় নাম ‘বাঁকুড়া রায়’ থেকেই বাঁকুড়া নামটির উৎপত্তি হয়েছে। এছাড়া বলা হয়, স্থানীয় শাসক ও বাঁকুড়া শহরের প্রতিষ্ঠাতা বাঁকু রায়-এর নামানুসারে বাঁকুড়া নামটি এসেছে। আরেকটি মতে, মল্লরাজা বীর হামবীরের ২২ পুত্রের অন্যতম বীর বাঁকুড়া ‘বাঁকুড়া’ শহর গড়ে তোলেন এবং তাঁর নাম থেকেই বাঁকুড়া নামটির উৎপত্তি হয়েছে।

(৮) পুরুলিয়া: ‘পুরুলিয়া’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে মূলত দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতে, দ্রাবিড় শব্দ ‘পারু’ অর্থাৎ পাথর এবং ‘লা’ অর্থাৎ বসতি থেকে পুরুলিয়া শব্দটি এসেছে। অর্থাৎ পুরুলিয়া শব্দের অর্থ হল পাথুরে অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত বসতি। অন্যমতে, ‘পুরুল্যা’ শব্দ থেকেই পুরুলিয়া নামটির উৎপত্তি হয়েছে। ‘পুরু’ অর্থাৎ শক্ত এবং ‘ইল্যা’ অর্থাৎ মাটি থেকে পুরুল্যা শব্দটি এসেছে। পুরুল্যা শব্দের অর্থ হল শক্ত মাটি। উপরোক্ত দুটি মতই পুরুলিয়া জেলার রুক্ষ ভূমিরূপকে নির্দেশ করে৷

(৯) কলকাতা: ইতিহাস বলে, ১৬৯০ সালে জব চার্নক কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতা। কলকাতা শহরের নাম থেকেই কলকাতা জেলার নামকরণ করা হয়েছে। কলকাতা নামটির উৎপত্তি নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতে, কালীক্ষেত্র (হিন্দু দেবী কালীর ক্ষেত্র) থেকে কলকাতা নামটির উৎপত্তি হয়েছে। তবে, ঐতিহাসিক পরমেশ্বর নাইয়ারের মতে, দুই বাংলা শব্দ ‘খাল’ ও ‘কাটা’ বিকৃত হয়েই কলকাতা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বর্তমান কলকাতা নামটি ‘কলিকাতা’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘কলি’ অর্থাৎ কলিচুন এবং ‘কাতা’ অর্থাৎ শামুকপোড়ার আড়ত। ১৮৫১ সালে প্রকাশিত কলকাতার সার্ভে রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তৎকালীন ‘ডিহি কলিকাতা’র ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে চুন ও চুনারীদের নামে তিনটি রাস্তা ছিল — চুনাপুকুর লেন, চুনাগলি, চুনারপাড়া লেন। এখনও কলকাতা শহরে চুনাপুকুর লেনের অস্তিত্ব রয়েছে। উল্লেখ্য, হাওড়া জেলার আমতা ১ নম্বর ব্লকের রসপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে কলিকাতা নামে একটি গ্রাম রয়েছে। দামোদর নদের তীরে অবস্থিত এই কলিকাতাও একসময় কলিচুন তৈরি এবং বিক্রির কেন্দ্র ছিল। এই দুই তথ্যই কলকাতা নামের উৎপত্তি বিষয়ে উপরোক্ত মতকে সমর্থন করে (History of Naming of SouthBengal’s Districts)।

(১০) হাওড়া: হাওড়া শহরের নাম থেকেই হাওড়া জেলার নামকরণ করা হয়েছে। ‘হাওড়া’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক প্রচলিত মত এই যে, হাওড়া শব্দটি ‘হাওড়’ অর্থাৎ জলাভূমি বা নিম্নভূমি থেকে এসেছে। হাওড়া জেলার ভূমিরূপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জলাভূমি। হাওড়া জেলার ডুমুরজলা, রাজপুর জলা, আমতা জলা প্রভৃতি উপরোক্ত মতটির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতেও, ‘হাওড়া’ শব্দটির অর্থ ‘যেখানে কেবল জল-কাদা’। তবে, বাসুদেব গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘পশ্চিমবঙ্গ পরিচয়’ (২০০০) গ্রন্থ অনুসারে, অষ্টাদশ শতাকের প্রথম ভাগে বর্তমান হাওড়া শহরের অদূরে হাড়িড়া নামে একটি গ্রাম ছিল এবং ‘হাড়িড়া’ শব্দটির অপভ্রংশ থেকে ‘হাওড়া’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মুর্শিদাবাদের পদ্মা নদীর ইলিশ

(১১) নদীয়া: ‘নদীয়া’ জেলার নামকরণ সম্পর্কে মূলত দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। এক, এই ভূখন্ডের ওপর দিয়ে ভাগীরথী, জলঙ্গী, ভৈরব, চূর্ণী, ইচ্ছামতী-সহ অসংখ্য ছোটোবড়ো নদনদী প্রবাহিত হয়েছে। ভূ-প্রকৃতির এরূপ নদী বিশিষ্টতা থেকেই ‘নদীয়া’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে। দুই, কবি নরহরি চক্রবর্তী তাঁর ‘ভক্তি রত্নাকর’ গ্রন্থে এবং দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায় তাঁর ‘ক্ষিতিশ বংশাবলী চরিত’ গ্রন্থে বলেছেন, নবদ্বীপ শব্দটি থেকেই নদীয়া নামটি এসেছে। কিংবদন্তী অনুসারে, নয়টি প্রদীপ জ্বালিয়ে এক তান্ত্রিক যে দ্বীপে সাধনা করতেন, তাই নবদ্বীপ। নয়+দিয়া (প্রদীপ) থেকেই ‘নদীয়া’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

(১২) উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা: অবিভক্ত ২৪ পরগণা জেলা ভেঙে ১৯৮৬ সালে উত্তর ২৪ পরগণা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা গঠিত হয়। ঐতিহাসিক ‘২৪ পরগণা’ অঞ্চল থেকেই এই দুই জেলার নামকরণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, ২৪ পরগণা নামটির উৎপত্তি কিভাবে? ইতিহাস বলে, পলাশীর যুদ্ধের পর, ১৭৫৭ সালের ২০ শে ডিসেম্বর বাংলার তৎকালীন নবাব মীরজাফর ২৪টি পরগণা (বা জংলীমহল)-এর জমিদারি স্বত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-কে প্রদান করেন। সেই থেকেই এই অঞ্চল ‘২৪ পরগণা’ নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য, ‘পরগণা’ একটি ফার্সি শব্দ, যার অর্থ হল কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি। সুলতানি আমলে কিছু গ্রাম নিয়ে গঠিত রাজস্ব আদায়ের একক অঞ্চল হিসেবে পরগণা শব্দটি প্রচলিত হয় (History of Naming of SouthBengal’s Districts)।

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]

লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Official Website of Murshidabad District, Government of West Bengal, India ; Jainism: Art, Architecture, Literature & Philosophy (2001) – Haripriya Rangarajan, G. Kamalakar, A. Reddy – Sharada Publishing House ; Jain Remains of Ancient Bengal (2017) – Shubha Majumder/Wisdom Library ; West Bengal District Gazetteers – Birbhum (1975) ; Birbhum in the Backdrop of Pre-history, Paschim Banga, Birbhum Special Issue – Prakash Chandra Maiti ; Wikipedia ; Encyclopedia of Britannica ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; হুগলী: নাম প্রসঙ্গ – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য – হুগলি জেলার পুরাকীর্তি, প্রত্নতত্ত্ব অধিকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, ১৯৯৩ সংস্করণ ; মেদিনীপুর ও স্বাধীনতা – শ্রী হরিসাধন দাস ; মেদিনীপুরের ইতিহাস প্রথম ভাগ (১৯২১) – যোগেশ চন্দ্র বসু ; Official Website of Jhargram District, Government of West Bengal, India ; বাঁকুড়া বার্তা ; Official Website of Bankura District, Government of West Bengal, India ; পশ্চিমবঙ্গ পরিচিতি – পুরুলিয়া – তরুনদেব ভট্টাচার্য ; Calcutta in the 17th century (1986) – P. Thankappan Nair ; Bengal District Gazetteers: Howrah (1909) – L. S. S. O’Malley ; Official Website of Nadia District, Government of West Bengal, India ; নবদ্বীপ মহিমা (১৮৮৪) – কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী ; The Sundarbans of India : A Development Analysis (2003) – Asim Kumar Mandal ; Official Website of North 24 Parganas & South 24 Parganas District, Government of West Bengal, India

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : আরাকু উপত্যকার বোরা গুহা

6 thoughts on “History of Naming of SouthBengal’s Districts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!