History of Naming of NorthBengal’s Districts
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : History of Naming of NorthBengal’s Districts । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

যেকোনো স্থানের নাম ওই স্থান বা বৃহত্তর অঞ্চলের মানব ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে। আবার, নামের উৎপত্তি নিয়েও নানা বৈচিত্র্য রয়েছে। কখনও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কখনও স্থানীয় ঘটনা, ধর্ম-দেবতা, বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিখ্যাত জিনিসের নামেই অধিকাংশ স্থানের নামকরণ হয়েছে। তাই, নামকরণ শুধুমাত্র পরিচয়জ্ঞাপক শব্দরাজি নয়, যেকোনো স্থানের নামকরণের উৎপত্তি, সেই স্থান/অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। ভারতের পূর্বাংশে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্যে বর্তমানে ৫ টি প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্গত ২৩ টি জেলা রয়েছে। এর মধ্যে জলপাইগুড়ি বিভাগের অন্তর্গত ৫ টি জেলা ; যথা : জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, দার্জিলিং এবং কালিম্পং এবং মালদা বিভাগের অন্তর্গত ৩ টি জেলা ; যথা : মালদা, উত্তর দিনাজপুর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর উত্তরবঙ্গের অন্তর্গত। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার উত্তরদিকের অংশই উত্তরবঙ্গ (North Bengal) নামে পরিচিত। আজকের এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণ কিভাবে হয়েছে (History of Naming of NorthBengal’s Districts)।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির নামকরণের ইতিহাস
(১) জলপাইগুড়ি: ‘জলপাইগুড়ি’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতে, উত্তরবঙ্গের প্রভাবশালী দেবতা জল্পেশ্বর/জল্পেশের নামানুসারেই ‘জলপাইগুড়ি’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে। অন্য একটি মতে, ‘জলপাইগুড়ি’ শব্দটির উৎস তিব্বতীয় শব্দ। ৫ টি তিব্বতীয় শব্দ — ‘জে’ (অর্থাৎ বিনিময়) + ‘লে’ (অর্থাৎ কেন্দ্র) + ‘পে’ (অর্থাৎ পশম/শীতবস্ত্র) + ‘গো’ (অর্থাৎ দরজা) + ‘রি’ (অর্থাৎ কেন্দ্র) -এর সম্মিলিত রূপ ‘জেলেপেগোরি’ থেকে জলপাইগুড়ি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ হল পাহাড়ের দরজায় অবস্থিত পশম/শীতবস্ত্র বিনিময় কেন্দ্র। তবে, ‘জলপাইগুড়ি’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য মত এই যে, জলপাই বৃক্ষের নামের সাথে স্থানবাচক ‘গুড়ি’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘জলপাইগুড়ি’ নামটি এসেছে। শোনা যায়, আঠারো ও উনিশ শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক জলপাই (Olive) গাছ ছিল।
(২) আলিপুরদুয়ার: ‘আলিপুরদুয়ার’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে ব্রিটিশ সেনা আধিকারিক লেফটেন্যান্ট-কর্নেল হেদায়েত আলি খান-এর নাম থেকে। ১৮৬৫ সালে ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধের পর ডুয়ার্স অঞ্চল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসে এবং বর্তমান আলিপুরদুয়ার শহর ১৮৭৬ সালে ওই অঞ্চলের সদরদপ্তর রূপে স্থাপিত হয়। হেদায়েত আলি খান ছিলেন ডুয়ার্স অঞ্চলের প্রথম প্রশাসক। প্রথমে এটি আলিপুর (হেদায়েত আলি খানের ‘আলি’ এবং স্থানবাচক শব্দ ‘পুর’) নামে পরিচিত ছিল। পরে কলকাতার আলিপুর থেকে উত্তরবঙ্গের আলিপুরকে পৃথক করতে আলিপুরের সাথে দুয়ার শব্দটি যোগ করা হয়। দুয়ার শব্দটি ডুয়ার্স থেকে এসেছে, যার অর্থ হল প্রবেশদ্বার। ভুটান ও উত্তরবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগকারী গিরিপথগুলি ডুয়ার্স নামে পরিচিত।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারীর অধিকার
(৩) কোচবিহার: ‘কোচবিহার’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেকগুলি মত প্রচলিত রয়েছে। কারও মতে, কোচবিহার এলাকাটি সংকোশ নদীর তীরবর্তী হওয়ায়, ‘সংকোশ’-এর কোশ থেকে কোচ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ধ্রুবানন্দ মিশ্রের কুলকারিকা গ্রন্থ অনুসারে, কোচক-এর অধিবাসী থেকেই ‘কোচ’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। তবে, কোচবিহার নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক প্রচলিত মত এই যে, কোচ অর্থাৎ কোচ জাতি (একটি তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী) এবং বিহার অর্থাৎ বিচরণক্ষেত্র বা বাসভূমি থেকে কোচবিহার শব্দটি এসেছে। অর্থাৎ কোচ জাতির বাসভূমিই হল কোচবিহার। তবে, ব্রিটিশদের উচ্চারণের প্রভাবে কোচবিহারের ইংরেজি নাম ‘কুচবিহার’।
(৪) দার্জিলিং: ‘দার্জিলিং’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে তিব্বতীয় শব্দ ‘দোর্জে-লিং’ থেকে। দার্জিলিংয়ের প্রাচীন অধিবাসী লেপচারা এই নামই ব্যবহার করতেন। দোর্জে শব্দটির অর্থ বজ্রপাত (ইন্দ্রের রাজদন্ড ; ইন্দ্রদেবের অস্ত্র বজ্র) এবং লিং শব্দটির অর্থ ভূমি। অর্থাৎ দোর্জে-লিং = বজ্রপাতের দেশ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত ‘Oxford Concise Dictionary of World Place Names’ গ্রন্থও এই মতটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে, ঐতিহাসিক শংকরহাং সুব্বার মতে, চিনা-তিব্বতীয় লিম্বু ভাষার ‘তাজেংলুং’ থেকে দার্জিলিং শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। তাজেংলুং শব্দটির অর্থ ‘যেসব পাথর পরস্পর কথা বলে’।
(৫) কালিম্পং: ‘কালিম্পং’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। এবিষয়ে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতে, কালিম্পং শব্দটির অর্থ রাজার মন্ত্রীদের সমাবেশ, যা তিব্বতীয় শব্দ ‘কালোন’ অর্থাৎ রাজার মন্ত্রীগণ এবং ‘পং’ অর্থাৎ সমাবেশ থেকে এসেছে। কে. পি. তামসাং-এর মতে, লেপচা শব্দ ‘কালেংপুং’ অর্থাৎ টিলা সমাবেশ বা বিন্যাস থেকে কালিম্পং শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মুর্শিদাবাদের পদ্মা নদীর ইলিশ
(৬) মালদা: ‘মালদা’ অর্থাৎ ‘মালদহ’ শব্দটি মলদ জাতি থেকে এসেছে। অর্থাৎ মলদ জনগোষ্ঠীর বাসভূমিই মালদা বা মালদহ। এখনও মালদা জেলার নানা অংশে মলদ (মাল পাহাড়িয়া) জনগোষ্ঠী দেখা যায়। তবে ভাষা গবেষক সুজয় ঘোষের মতে, তাদের সংখ্যা এতো বেশি নয় যে, তাদের নামানুসারেই মালদা/মালদহ নামটি এসেছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে। মালদা/মালদহ জেলার নামকরণ নিয়ে সর্বাধিক প্রচলিত মত হল : আরবি শব্দ ‘মাল’ অর্থাৎ ধনসম্পদ/পণ্যদ্রব্য এবং আঞ্চলিক শব্দ ‘দহ’ অর্থাৎ হ্রদ/জলাজায়গা থেকে এসেছে। প্রাচীন কালে মালদা ব্যবসাবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং ধনসম্পদে পূর্ণ একটি স্থান ছিল। আবার, মালদা জেলার পশ্চিমাংশের ‘তাল’ এলাকাতে অনেক জলাভূমি, বিল ও অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়। যা এই নামকরণের যথার্থতা তুলে ধরে।
(৭) উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর: উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুর দুই জেলাই পূর্বতন পশ্চিম দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলার পশ্চিমাংশ ‘পশ্চিম দিনাজপুর’ জেলা রূপে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে পশ্চিম দিনাজপুর জেলা ভেঙে উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা গঠিত হয়। ‘দিনাজপুর’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে একাধিক মত প্রচলিত রয়েছে। জনশ্রুতি অনুসারে, এই অঞ্চলের জনৈক দিনাজ রাজা-এর নাম থেকেই দিনাজপুর নামটি এসেছে। তবে ভিন্নমতে, বাংলায় সুলতানি আমলে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনকালে একমাত্র হিন্দু রাজা ছিলেন গণেশ, যিনি সাময়িক ভাবে ইলিয়াস শাহী বংশের অবসান ঘটিয়ে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ (১৪১৪-১৫) করেছিলেন। তিনি ‘দনুজমর্দনদেব’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। রাজা গণেশের দনুজমর্দনদেব উপাধি থেকেই দিনাজপুর নামটির উৎপত্তি হয়েছে। (History of Naming of NorthBengal’s Districts)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Official Website of Alipurduar Municipality, Alipurduar District, West Bengal ; আজ তক বাংলা ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; মালদহ জেলার দক্ষিণ অংশের বাংলা কথ্যভাষা : ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ – গবেষক সুজয় ঘোষ – উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পি.এইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ (২০১১) ; Socio-Economic Condition of Tribal Population of Dakshin Dinajpur District, West Bengal – Thesis Submitted for the Award of Doctor of Philosophy in Geography & Applied Geography – Submitted By Anamika Ghosh – Department of Geography & Applied Geography, North Bengal University, Darjeeling, West Bengal, 2019 ; Official Website of Cooch Behar District, West Bengal ; Kalimpong Etymology – Government of West Bengal ; Wikipedia ; Darjeeling News Service
Pingback: History of Naming of SouthBengal's Districts - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: World's Largest Island Greenland - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Sundarban & Life - Livelihoods - ভূগোলিকা-Bhugolika
Khub Valo
Nice One
Excellent…