Handloom Industry of Dhaniakhali
ধনিয়াখালির তাঁত শিল্প
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Handloom Industry of Dhaniakhali । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ধনিয়াখালির তাঁত শিল্প সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

বাংলার সবচেয়ে পুরানো এবং বৃহত্তম কুটির শিল্প হল তাঁত শিল্প (Handloom Industry)। হস্তচালিত তাঁতের শাড়ি ভারত এবং বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার নিদর্শন। মসলিন, জামদানি, টাঙ্গাইল ইত্যাদি শাড়ির পাশাপাশি বাঙালি নারীদের পছন্দের তালিকায় এক অন্যতম স্থানে রয়েছে ধনিয়াখালি শাড়ি (Dhaniakhali Saree) বা ধনেখালি শাড়ি (Dhanekhali Saree)। কবির ভাষায় ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ — এই মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ — ধনিয়াখালির শাড়ি। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে ধনিয়াখালি তাঁতের শাড়ির গৌরবময় ঐতিহ্য কথা কমবেশি প্রায় সকল পশ্চিমবঙ্গবাসীর অজানা নয়। জেনে নেওয়া যাক কি পরিস্থিতিতে রয়েছে এই তাঁত শিল্প, কি বা তার ইতিহাস এবং এই শিল্পে কর্মরত শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে (Handloom Industry of Dhaniakhali)।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মাউন্ট এভারেস্ট বিজয়ের ইতিহাস
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি ব্লক হল ধনিয়াখালি। ধনিয়াখালির তাঁতের শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের এক অন্যতম বিখ্যাত কুটিরশিল্প, যা আন্তর্জাতিক বাজারে খ্যাতি সম্পন্ন এবং ভৌগোলিক নির্দেশক (Geographical Indication) -এর তকমা প্রাপ্ত। ২০১২ সালে ধনিয়াখালি শাড়ি ভৌগোলিক নির্দেশক (G.I.) শংসাপত্র লাভ করে। ১০০/১০০ বা ১০০/৮০ কাউন্টের সুতোয় বোনা, ৫.৫-৬ মিটার দৈর্ঘ্যের, ৪৮-৫০ ইঞ্চি চওড়া, ১.৫-২ ইঞ্চি পাড়যুক্ত রকমারি রঙের বাংলা তন্তুজ শৈলীতে বোনা হয় ধনিয়াখালির তাঁতের শাড়ি। এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হল ধনিয়াখালি এবং শাড়ি প্রস্তুতকারীরা হলেন হুগলির তাঁত শিল্পীরা। ঐতিহ্য মেনে শাড়ি জমিনের রং ধূসর এবং পাড়ের অংশটি তুলনায় সরু ও লাল বা কালো রংয়ের হয়। আসল ধনিয়াখালি তাঁতের শাড়ির ট্রেডমার্ক হল শাড়ির আঁচলের ওপর দক্ষতার সাথে সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা ধানের শীষের কারুকার্য।
কথিত আছে, অতীত কালে একদল তাঁত শিল্পী পথে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বিশ্রামহেতু যে স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরবর্তীতে আর না এগিয়ে সেখানেই নিজেদের বসতি গড়ে তোলেন এবং তাঁত শিল্পকর্মের বিকাশ ঘটান। তাঁত শিল্পীরা ক্লান্ত হয়ে যেখানে থেমেছিলেন, সেই স্থানে নতুন বসতির নাম হয় আলা (আলা অর্থাৎ ক্লান্ত বা পরিশ্রান্ত) এবং সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁত শিল্পের যাত্রা। বর্তমানে ধনিয়াখালির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যথা — আলা, হেরেগাদি, মির্জানগর, বোসো, আঁটপুর, মেলকি, দিনহাটা, জাঙ্গিপাড়া, গুড়াপ, সোমসপুর ইত্যাদি অঞ্চলে তাঁত বোনা হয়। সুদূর ইংরেজ আমল থেকে আজ অবদি ধনিয়াখালি মূলত বেচাকেনার বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানকার তাঁতের শাড়ি ও ধুতি বিখ্যাত। অতীতকালে সুশি ও শিক্কর নামে এক প্রকারের লুঙ্গি জাতীয় রেশমের কাপড় তৈরি হত, যা লাক্ষাদ্বীপ ও মালদ্বীপে রপ্তানি করা হত।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : বাংলার ধানের গোলা – পূর্ব বর্ধমান
একসময়, ধনিয়াখালি এবং মামুদপুর পাশাপাশি দুটি এলাকাকে কেন্দ্র করে এই তাঁত মহল্লাতে তাঁতিদের মোট চারটি সমবায় ছিল। সে সময় প্রতিটি সমবায়ের ছাতার তলায় ৩০০-৪০০ জনেরও বেশি তাঁতি কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে সবমিলিয়ে তাঁতশিল্পীর সংখ্যা ২৫০-৩৫০ -এর মতো। তাঁতিরা তাঁদের তৈরি শাড়ি সাধারণত সমবায়ের মাধ্যমে বিক্রি করেন। সমবায় থেকে তাদের ১২ টি কাপড় বোনার মতন সুতো দেওয়া হয়, তা থেকে তারা ১১ টি শাড়ি সমবায়কে বুনে দেন এবং পারিশ্রমিক পান। বাকি ১টি শাড়ি তাদের নিজেদের কাছে রাখেন, বিক্রি অথবা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। সমবায় থেকে তাঁতিদের যথাসম্ভব সহযোগিতা করা হয়। এছাড়া সমিতির সদস্যরা প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ফান্ড ইত্যাদি সুবিধাও পেয়ে থাকেন। ধনিয়াখালি এলাকায় তৈরি তাঁতের শাড়িগুলি তন্তুজ, মঞ্জুশ্রী, বঙ্গশ্রী মতো প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়।
ধনিয়াখালির তাঁতিরা নিজেদের নিপুন বুনন, রং এবং নিখুঁত কারুকার্যে তাঁতের শাড়িকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছেন। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবনের রং। সময় পাল্টেছে, বেড়েছে প্রতিযোগিতার বাজার ; সেইসঙ্গে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ী এবং তাদের নকল তাঁতের শাড়ির। তথাপি আমাদের বর্তমান দ্রুতগামী এবং ব্যস্তময় জীবনে আধুনিক নারীদের একাংশ শাড়িকে কিছুটা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন। বিবিধ কারণে ধনিয়াখালির তাঁতশিল্প তার গৌরব হারিয়ে এখন প্রায় অধঃপতনের মুখে। শিল্পে সেইভাবে কোন রদবদল আসেনি, প্রায় রোজই এই শিল্প ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন তাঁতিরা। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম, এই পেশায় নতুন মুখ আসছে না। এইভাবে সমবায়ে তাঁতির সংখ্যা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে।
তাঁতিদের কথায়, একটি শাড়ি বুনতে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগে। আগে একটি শাড়ি বুনে ২৫ টাকা মজুরি পেলেও, তাদের সংসার চালানো যেত। কিন্তু বর্তমানে একটি শাড়ি বুনে ২০০-৪০০ টাকা মজুরি পেয়েও সংসার চালানো কঠিন হচ্ছে। এজন্য তাঁত বোনার পাশাপাশি তাঁদের রাজমিস্ত্রির জোগাড়, কলকারখানার মজুর অথবা সবজি বা মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে অন্য কোনো পেশায় নিজেদের যুক্ত রাখতে হচ্ছে। তাঁতের শাড়ি বোনা যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য। খেটেও বাজারের সাপেক্ষে মজুরি পাচ্ছেন না, এটাই তাঁত শিল্পীদের হতাশা। অন্যদিকে, তাঁত সমবায়গুলির মতে, তাঁতিদের মজুরি বেশি দিলে শাড়ির দাম বাড়বে, ফলে চাহিদাতেও তার ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। নানা কারণে তাঁত সমবায়গুলিও ধুঁকছে। ধনিয়াখালি ইউনিয়ন তাঁতশিল্পী সমবায় সমিতি -এর হিসেবে অনুসারে, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ৯২ লক্ষ টাকার শাড়ি বিক্রি হয়েছিল। ২০১৫-১৬ সালে ৯১ লক্ষ টাকার এবং ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তা কমে হয় ৬৪ লক্ষ টাকার। তাঁত শিল্পীদের খেদ — করোনা মহামারী, মানুষের আর্থিক পরিস্থিতি, মেয়েদের শাড়ি পড়ার প্রবণতা কমে যাওয়া, শাড়ির নকশায় নতুনত্ব না আসা — সবকিছুই তাঁত শিল্পে কোপ বসিয়েছে। সময় পাল্টেছে, কিন্তু ধনিয়াখালির তাঁতিদের এবং শাড়ি শিল্পে সেভাবে কোনও বদল আসেনি।
ধনিয়াখালির এক তাঁতি তরুণ কুমার পাল এ বিষয়ে বলেন, “তাঁতের ডিজাইনের পরিবর্তন তো অবশ্যই করতে হবে। উন্নত ধরনের তাঁত আমাদের এখানে নেই। আর সেটা চালাতে গেলে যে প্রশিক্ষণ দরকার সেটাও নেই। সেই সঙ্গে আর্থিক অবস্থাও ভালো নয় তাঁতিদের। তাঁতের শাড়ির পর্যাপ্ত মজুরিরও ব্যবস্থা করতে হবে। পরিশ্রমের তুলনায় মজুরি অনেক কম। আমরা চাইছি এই ধনিয়াখালি তাঁতের উন্নতি হোক। কিন্তু এখানে কোনও পরিকাঠামোই নেই।”
অসাধু ব্যবসায়ী, নকল শাড়ি, প্রতিযোগিতার বাজার ইত্যাদিকে টপকে, ধনিয়াখালির শাড়িতে যদি নিজস্ব ভাবনায় অভিনবত্ব আনা যায়, তবে এই শাড়ি চাহিদার কোনো ঘাটতি থাকবে না বলেই আশা রাখা যায়। এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতে এই তাঁতের শাড়ির নিয়মিত বিপুল চাহিদা রয়েছে। তাই, তাঁত শিল্পে নতুন চিন্তা এবং প্রযুক্তিগত নতুন দিশা দরকার। আধুনিকতার ছোঁয়া ছাড়া সুদীর্ঘকালের এই ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। তবে নতুনত্বের নামে অন্য শিল্পের কারুকার্যকে নকল করে, তা ধনিয়াখালির তাঁতের সাথে জুড়ে দেওয়া যথেষ্ট নিন্দনীয় এবং এই ভাবে ধনিয়াখালির শাড়ি তার নিজস্ব বৈচিত্র্যতাও হারাচ্ছে। শাড়িতে নিজস্বতা বজায় রেখে, অভিনবত্ব এনে এই কুটির শিল্পকে নতুন রূপে দিয়ে, তার ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার আশায় নতুন প্রজন্মই এখন ভরসা।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- হৃতিপর্ণা ভট্টাচার্য (সিঙ্গুর, হুগলি)
তথ্যসূত্রঃ- The Telegraph ; Outlook Traveller ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; Wikipedia ; The Indian Express ; ETV Bharat – West Bengal ; লেখিকার নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও তথ্যসংগ্রহ
Pingback: Dampier-Hodges Line of Sundarban - ভূগোলিকা-Bhugolika