Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Gangani – Grand Canyon of Bengal

গনগনি – বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Gangani – Grand Canyon of Bengal । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নামে পরিচিত গনগনি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Gangani - Grand Canyon of Bengal
গনগনি, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার গনগনি। ছোটনাগপুর মালভূমির প্রান্তবর্তী, পশ্চিমী এই জেলায় অবস্থিত গনগনি আদতে একটি ক্ষয়িষ্ণু উষর অঞ্চল। গড়বেতা থেকে মাত্র ২.৫ কিমি দূরে, শিলাবতী (শিলাই) নদীর ডান তীরে এই উষর ভূমি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় এলাকায় এটি ‘গনগনি ডাঙ্গা’ নামে পরিচিত, যার ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ২২°৫১’৩৪” উত্তর এবং ৮৭°২০’৩০” পূর্ব। সমগ্র অঞ্চলটির আয়তন প্রায় ১ বর্গকিমি। নদী তীরবর্তী খাড়া পাড়ের একাধিক সংকীর্ণ জলনালিকা (Rill) দ্বারা সমগ্র অঞ্চলটি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই বদভূমি তৈরি করেছে। ভূগোলের ভাষায় যা ‘Badland Topography’ নামে পরিচিত। বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনের কোপাই নদী তীরস্থ ‘খোয়াই’ ছাড়া এ রাজ্যে একমাত্র গনগনিতেই এই ধরনের ভূমিরূপ প্রকৃষ্ট ভাবে দেখা যায়।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : জঙ্গলমহলের কুড়কুড়ে ছাতু

ভৌগোলিকদের মতে, আজ থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন (২০ লক্ষ) বছর থেকে ১০ হাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ের সঞ্চিত কাঁকুরে পলিস্তরের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমান্বয়ে ঋতুগত ভৌমজলস্তরের ওঠানামার ফলে আর্দ্রতা ও শুষ্কতার প্রভাবে তৈরি হয় ল্যাটেরাইট উচ্চভূমি। কোয়াটারনারি পাললিক শিলাগঠনের ওপর এই ভূমিরূপটি গড়ে উঠেছে। এখানে শিলাবতী নদীর ডান তীরের উচ্চতা ও গভীরতা বাম তীরের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। ডান তীরের খাড়া অংশের বদভূমিতেই প্রাকৃতিক নিয়মে অসাধারণ বৈচিত্র্যময় ভূ-শৈলী গড়ে উঠেছে। আর বামতীরের ভূমিরূপ বৈচিত্র্যহীন ও সমতল। বদভূমি অঞ্চলের গড় উচ্চতা ৩৫ থেকে ৬০ মিটার।

বর্ষাকালে নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পেলে, নদীপাড়ের খাড়া অংশ বরাবর সংকীর্ণ উপত্যকায় জল প্রবেশ করে এবং ক্ষয়কার্য করে থাকে। অন্য দিকে, নদীপাড়ের উচ্চভূমি থেকে একাধিক ছোটবড়ো জলধারা নামতে থাকে। এই জলধারা ক্ষয়কার্যের ফলে একাধিক অগভীর খাতের সৃষ্টি করেছে। সংকীর্ণ, লম্বা ও অগভীর খাতগুলি ‘নালি বা জলনালিকা’ (Rill), নালি বা জলনালিকার তুলনায় অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত ও গভীর খাতগুলি ‘খাত’ (Gully) নামে পরিচিতখাতের চেয়ে বৃহৎ আকারের, গভীর, সংকীর্ণ ও খাড়া পাড়যুক্ত খাতগুলি ‘র‍্যাভাইন’ (Ravine) নামে পরিচিত। গনগনিতে সাধারণত দুই ধরনের নালি (Rill) দেখা যায় – সর্পিল নালি (Sinuous Rill) এবং ঋজু নালি (Straight Rill)। এছাড়াও এখানে ছোট, মাঝারি ও বড় এই তিন ধরনের খাত (Gully)-এর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দ্বৈত নাগরিকত্বের লংওয়া গ্রাম

গনগনির এই ‘Ravineland Topography’-এর সাথে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরোডা নদীর ওপর গড়ে ওঠা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাদৃশ্য রয়েছে। তাই গনগনিকে ‘বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ (Grand Canyon of Bengal) বলা হয়। বিকেলে সূর্যাস্তের পূর্বে, লোহিত ও ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার সমন্বয়ে গঠিত কমলা-লাল রঙের মৃত্তিকার উপর পড়ন্ত সূর্যালোক পড়লে এক অসাধারণ নয়নাভিরাম ভূ-দৃশ্য ভেসে উঠে, যার সৌন্দর্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের থেকে কোন অংশে কম নয়। সেই অর্থে গনগনি যথার্থই বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। গনগনিতে নালি, খাত ও র‍্যাভাইন ছাড়াও প্রাকৃতিক গুহা (Natural Cave), প্রাকৃতিক খিলান (Natural Arch), পিনাক্যালস্ (Pinnacles), মেসা (Messa), বিউট (Butte), স্তম্ভ (Pillar) ভৃগু (Cliff), স্পার (Spur) প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুস্পষ্ট ভূমিরূপ প্রাকৃতিক নিয়মেই গড়ে উঠেছে। প্রকৃতি আপন খেয়ালে গড়ে তুলেছে অপরূপ ভাস্কর্য।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : চ্যাংমারি চা বাগান

তবে, বর্তমানে অবাধ পিকনিক, সিনেমার শুটিং, পর্যটকদের অবাধ আনাগোনা ও ফোটোশুটের কারণে গনগনিতে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া এই অঞ্চলে কখনো কখনো অতিবৃষ্টির কারণে ভূমিক্ষয় হয়ে থাকে। গনগনিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫৬ সেমি। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ ও ৩০ শে জুলাই টানা দু’দিনে দ্বিগুনেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। ভূমিরূপবিদদের মতে, এ ধরনের অতিবৃষ্টিতে ভূমিক্ষয়ের ফলে গনগনির ভূমিরূপের বাহ্যিক গঠনের পরিবর্তন ঘটতে পারে। বৃষ্টির কারণে ভূমিক্ষয় স্বাভাবিক। কিন্তু গনগনিতে উপরে কঠিন ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার স্তরের নিচে রয়েছে অপেক্ষাকৃত কোমল পলি জাতীয় লাল মৃত্তিকা। এই কোমল মৃত্তিকা স্তর দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। বর্ষাকালে নদীর জলস্তর সংকীর্ণ খাতগুলির অনেক ভিতরে প্রবেশ করে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি করছে। স্থানীয়দের মতে, নদীখাতের ডানমুখী স্থানান্তর ঘটছে। সবমিলিয়ে গনগনির অস্তিত্ব বর্তমানে অনেকটাই সংকটের মুখে, যা নিয়ে ভূমিরূপবিদরাও উদ্বিগ্ন। গনগনিকে কেন্দ্র করে বর্তমানে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা চলছে। এখন অনেকেরই উইকএন্ড ডেস্টিনেশন গনগনি। গড়বেতা ১ নং পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে পর্যটকদের জন্য গনগনিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। গড়ে তোলা হয়েছে রিসর্ট, নদী খাতে নামার জন্য সিঁড়ি। তবে স্থানীয় প্রশাসনকে পরিবেশ রক্ষা ও গনগনি রক্ষায় আরও সচেতন হতে হবে। (Gangani – Grand Canyon of Bengal)

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]

লেখকঃ- সঞ্জয় দে (কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান)

তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা ; Wikipedia ; Mandal, R., Chakrabarty, P., (2021), Badlands of Gangani in West Bengal, India: An assessment on account of geotourism development, International Journal of Geoheritage and Parks 9(2), 147-156 ; লেখক কর্তৃক সাম্প্রতিক গনগনি ভ্রমণ ; গনগনির প্রদর্শন ফলক – বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় (সৌজন্যে : প্রফেসর মলয় মুখোপাধ্যায়, ভূগোল বিভাগ, বিশ্ব ভারতী)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মেদিনীপুরের গোপগড় ইকোপার্ক

6 thoughts on “Gangani – Grand Canyon of Bengal

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!