Monday, July 28, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Floating Island Phumdi

ভাসমান দ্বীপ ফুমদি

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Floating Island Phumdi । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি মণিপুরের লোকটাক হ্রদের ভাসমান দ্বীপ ‘ফুমদি’ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Floating Island Phumdi
লোকটাক হ্রদে ভাসমান দ্বীপ ফুমদি

উত্তর-পূর্ব ভারতে বৃহত্তম স্বাদুজলের হ্রদ (Largest Freshwater Lake) হল মণিপুর (Manipur) রাজ্যের বিষ্ণুপুর (Bishnupur) জেলাতে অবস্থিত লোকটাক হ্রদ (Loktak Lake)। যার গড় আয়তন প্রায় ২৮৭ বর্গকিমি। লোকটাক হ্রদ একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। এই হ্রদকে ‘ভাসমান দ্বীপের হ্রদ’ (The Lake of Floating Islands) বলা হয়। স্থানীয় ভাষায় এই ভাসমান দ্বীপগুলি ‘ফুমদি’ (Phumdi) নামে পরিচিত। আর এই হ্রদের বৃহত্তম ফুমদি হল কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান (Keibul Lamjao National Park), যা বিশ্বের একমাত্র ভাসমান জাতীয় উদ্যান (World’s Only Floating National Park)। ১৯৭৭ সালে এই উদ্যানকে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হয়। কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যানের আয়তন প্রায় ৪০ বর্গকিমি, যার মধ্যে ২৬ বর্গকিমি হল ফুমদি। ১৯৯০ সালে লোকটাক হ্রদ রামসার সাইটের মর্যাদা লাভ করে। লোকটাক হ্রদের বৃহত্তম প্রাকৃতিক দ্বীপ হল থাঙ্গা (Thanga)।

লোকটাক হ্রদের ফুমদিগুলি পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান হল বিপন্ন মণিপুর এল্ডস্ হরিণ (Manipur Eld’s Deer) -এর সর্বশেষ আবাসস্থল। এই হরিণ প্রজাতি ‘The Dancing Deers of Manipur’ নামেও পরিচিত। মেইতেই ভাষায় যার নাম সাংগাই (Sangai)। ১৯৭৫ সালে সাংগাইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪, যা ২০১৬ সালে বেড়ে হয়েছে ২৬০ (সূত্র : Singh & Khare 2018)। এছাড়া এই জাতীয় উদ্যানে নাত্রিণী হরিণ (Hog Deer), বন্য শূকর (Wild Boar), ভারতীয় গন্ধগোকুল (Indian Civet), জংলি বিড়াল (Jungle Cat), সম্বর হরিণ (Sambar Deer), ফল বাদুড় (Fruit Bat) প্রভৃতি স্তন্যপায়ী প্রজাতি এবং বিভিন্ন প্রকার সাপ, পাখি ও মাছ পাওয়া যায়।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : রায়দিঘির জটার দেউল

স্থানীয় বাসিন্দারা বন্য ভোজ্য, ওষুধ, চারণ, জ্বালানি এবং হস্তশিল্পের কাঁচামালের জন্য ফুমদির উপর নির্ভরশীল। ২০০৫-০৬ সালের এক গবেষণা অধ্যয়নে, কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যানের ফুমদিতে ৮৩ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় ফুমদিগুলিতে ২৭ রকমের ভোজ্য উদ্ভিদ প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়েছে, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য প্রস্তুতির প্রধান উপকরণ। এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রধান খাদ্য হল দেশীয় আঠালো চাল (Sticky Rice), সাথে ফুমদির ভোজ্য উদ্ভিদরাজি থেকে তৈরি সবজি। এই অঞ্চলের মহিলারা ফুমদি থেকে বন্য ভোজ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মৎস্য শিকার এখানকার স্থানীয়দের প্রধান জীবিকা। লোকটাক হ্রদে ফুমদির ওপর ঘাস, দড়ি, কাঠ, ছোটো পাথর, বাঁশ দিয়ে মৎস্যজীবীরা যেসব কুটির অথবা ছাউনি নির্মাণ করেন, তা ‘ফুমশোং’ (Phumsong) বা ‘খাংপোক’ (Khangpok) নামে পরিচিত। মাছ চাষ, বিশেষ করে চিংড়ি চাষের সুবিধার্থে কৃত্রিম ভাবে বৃত্তাকার বলয়ের মতো যে ফুমদি তৈরি করা হয়, তাকে মেইতেই ভাষায় ‘আথাপুম’ (Athapum) বলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা সরাসরিভাবে লোকটাক হ্রদ তথা ভাসমান দ্বীপ ফুমদিগুলির ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয়রা লোকটাক হ্রদকে ‘লোকটাক ইমা’ (Loktak Ima) অর্থাৎ ‘মা লোকটাক’ (Mother Loktak) বলে থাকেন, যা ‘লোকটাক লাইরেম্বি’ (Loktak Lairembi) অর্থাৎ ‘লোকটাকের দেবী’ (Goddess of Loktak) নামেও পরিচিত।

ফুমদিগুলি তৈরি হয় ঘাস, লতাপাতা, মাটি, নানারকম জৈব পদার্থের জটিল সমন্বয়ে। জৈব ধ্বংসাবশেষ দিয়ে গঠিত ফুমদির বেধ কয়েক সেন্টিমিটার থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত হয়। কালচে রঙের হিউমাস গঠিত ফুমদির গ্রথন স্পঞ্জের মতো ছিদ্রযুক্ত, তাই অনায়াসে জলে ভেসে থাকতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই দ্বীপগুলির ২০% জলের ওপর ভাসমান অবস্থায় এবং ৮০% জলে নিমজ্জিত থাকে, ঠিক হিমশৈলের মতো। শুকনো ঋতুতে বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে হ্রদের জলস্তর নেমে যায় ও ফুমদিগুলি হ্রদের তলদেশে মাটির সংস্পর্শে চলে আসে মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিরস শোষণ করে। আবার বর্ষার সময় হ্রদের জলস্তর বৃদ্ধি পেলে ফুমদিগুলি হ্রদের তলদেশের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় হ্রদের ওপরে ভাসমান অবস্থায় ফিরে আসে। এই চক্রটি ঋতু অনুযায়ী চলতে থাকে, তাই ফুমদিগুলির পুষ্টিরস শোষণের ধারা অব্যাহত থাকে। (Floating Island Phumdi)

ফুমদিগুলি কয়েক শতক ধরে বিদ্যমান হলেও, ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপ এই ভাসমান দ্বীপগুলিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৭ সালে ভাসমান দ্বীপগুলির ওপর মোট ফুমশোং/খাংপোক ছিল ২০৭ টি ; যা ১৯৯৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০০টি ও জনসংখ্যা ৪০০০-এর বেশি। বর্তমানে যার সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে জনসংখ্যা কি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বর্তমানে ফুমশোং/খাংপোক এবং আথাপুম নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক দড়ি, ভারী পাথর, দস্তার প্লেট, লোহার রড। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে মাছ চাষের জন্য ব্যবহার হচ্ছে কীটনাশক, যার সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে লোকটাক হ্রদের পরিবেশে। বর্জ্য নিক্ষেপণের বিষাক্ত উপাদান এই হ্রদের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করছে। ফলে মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হচ্ছে, যা এই হ্রদে ইউট্রোফিকেশন ঘটাচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে একের পর এক ‘মৃত অঞ্চল’ (Hypolimnion Dead Zone)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবনের মাতলা নদী

১৯৮৩ সালে ইম্ফল নদী (Imphal River) ও খুগা নদী (Khuga River) – এর মিলনস্থলে ইথাই ব্যারেজ (Ithai Barrage) নির্মাণ লোকটাক হ্রদের বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করেছে এবং মণিপুর নদী ব্যবস্থা (Manipur River System) দিয়ে মাছের অভিবাসন পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলে পেংবা (Pengba), খবাক (Khabak) এবং সারেং (Sareng) -এর মতো নদীসংযোগী মাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ইথাই ব্যারেজ নির্মাণের কারণে ফুমদিগুলির প্রাকৃতিক চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইথাই ব্যারেজ নির্মাণের পরে, সর্বনিম্ন মাসিক গড় জলস্তর সমুদ্রতল থেকে ৭৬৫.৫৫ মিটার থেকে ৭৬৭.৫৮ মিটার উপরে পৌঁছেছে। শুকনো মরসুমে হ্রদের তলদেশ থেকে ফুমদিগুলি পুষ্টি অর্জন করতো। তবে জলের স্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ফুমদিগুলি সারা বছর ধরে জলের ওপরে ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং শুকনো মরসুমেও জলস্তর না কমায় তারা পুষ্টিরস শোষণে বঞ্চিত হচ্ছে। যা লোকটাক হ্রদের ভাসমান দ্বীপগুলির অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যানের পরিস্থিতিও সবচেয়ে উদ্বেগজনক। ফুমদিগুলির বেধ ক্রমশ পাতলা হওয়ার ফলে ভাসমান দ্বীপগুলি টুকরো টুকরো হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ও মূলখন্ড থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই কারণে বিরল সাংগাই হরিণের বেঁচে থাকা বর্তমানে প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। (Floating Island Phumdi)

লোকটাক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (LDA) স্থায়ী ফুমদি বাসিন্দাদের অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত ফুমশোং/খাংপোকগুলি সরিয়ে নেওয়ার এবং ফুমদিগুলি পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। অবশ্য এনিয়ে লোকটাক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয়দের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। কেননা, স্থানীয় বাসিন্দারা জীবিকা নির্বাহের জন্য ফুমদি ও আথাপুমের উপর নির্ভরশীল। ২০১১ সালে লোকটাক হ্রদ কর্তৃপক্ষ ৭০০-টিরও বেশি অপরিকল্পিত ফুমশোং/খাংপোক সরিয়ে দেয় এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সহ অনেক লোককে স্থানান্তর করে। বর্তমানে পরিস্থিতি আরও উন্নত হয়েছে এবং লোকটাক হ্রদ কর্তৃপক্ষ সাম্প্রতিক কালে হ্রদের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আরও বেশি সংখ্যক স্থানীয় বাসিন্দাকে যুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। লোকটাক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীল সম্পদ বিকাশ এবং জলজ উদ্ভিদের উন্নয়নের সাথে ইকো-ট্যুরিজম বিকাশসহ স্থানীয় অঞ্চলে জীবিকা নির্বাহের কর্মসূচি প্রচারের লক্ষ্যে কাজ করছে। (Floating Island Phumdi)

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]

লেখিকাঃ- মৌমিতা মোদক (তারকেশ্বর, হুগলি)
তথ্যসূত্রঃ- Journals of India ; Research Gazette ; Nasa Earth Observatory ; Wikipedia ; Manipur, A Tourist Paradise (E.Ishwarjit, Singh) ; World Atlas ; Hindustan Times ; Plant community structure and biomass production by phumdis in Keilbul Lamjao National Park, Manipur – Kimjalhai Kipgen, Junior Research Fellow (2005-06) ; লেখিকার নিজস্ব ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : বন্যপ্রাণ পর্যটন – কৃষ্ণসার জাতীয় উদ্যান

3 thoughts on “Floating Island Phumdi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!