Edinburgh of the Seven Seas
সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Edinburgh of the Seven Seas । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পৃথিবীর নির্জনতম স্থায়ী বসতি — ‘সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ’ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

সামাজিক জীব হিসেবে মানবগোষ্ঠী যখন কোনো স্থানে স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তোলে, তখন তাকে বসতি বলে। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই জনবসতি গড়ে তুলেছে। পাহাড়-পর্বত থেকে সমভূমি, নিবিড় অরণ্য থেকে উষ্ণ মরুভূমি কিংবা শীতল মেরুপ্রদেশ থেকে নির্জন দ্বীপ — মানব বসতির চিহ্ন চোখে পড়বেই। কিন্তু জানেন কি, পৃথিবীর নির্জনতম স্থায়ী বসতি কোনটি? পৃথিবীর নির্জনতম স্থায়ী বসতি (Most Remote Permanent Settlement on Earth) হল সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ (Edinburgh of the Seven Seas)। মহাসাগরের মাঝে সে এমনই এক দ্বীপ-বসতি, যার নিকটবর্তী কোনো বসতির দূরত্ব কয়েক হাজার কিমি। আসুন, শুরু করি আটলান্টিকের নীল-নির্জনে সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ (Edinburgh of the Seven Seas) সফর।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দক্ষিণের ডুয়ার্স – ঝালুয়ারবেড়
দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় মাঝখানে রয়েছে এক আগ্নেয় দ্বীপপুঞ্জ, নাম ত্রিস্তান দ্য কুনহা (Tristan da Cunha)। এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ও বৃহত্তম দ্বীপ ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপের উত্তর উপকূলে রয়েছে সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ ; যা সমগ্র ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র স্থায়ী বসতি এবং পৃথিবীর নির্জনতম স্থায়ী বসতি। আর সাত সমুদ্রের এডিনবার্গের অবস্থানের কারনেই ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপপুঞ্জটি পৃথিবীর নির্জনতম বসতিযুক্ত দ্বীপপুঞ্জ (Most Remote Inhabited Archipelago in the World) রূপে পরিচিত। ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপপুঞ্জটি প্রশাসনিক দিক থেকে সেন্ট হেলেনা, অ্যাসেনশন এবং ত্রিস্তান দ্য কুনহা শীর্ষক ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটোরির অন্তর্গত। সাত সমুদ্রের এডিনবার্গের নিকটতম বসতি সেন্ট হেলেনা দ্বীপ, যা প্রায় ১৫১৪ মাইল (২৪৩৭ কিমি) দূরে অবস্থিত। পৃথিবীর কোনো বসতি থেকে নিকটতম বসতির দূরত্ব এর চেয়ে বেশি নয়। তাই, সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ (Edinburgh of the Seven Seas) ‘পৃথিবীর নির্জনতম স্থায়ী বসতি’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইতিহাস বলছে, ১৫০৬ সালে পর্তুগিজ নাবিক ত্রিস্তাও দ্য কুনহা জনমানবহীন এই দ্বীপপুঞ্জকে সর্বপ্রথম সমুদ্র থেকে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর নামানুসারেই সমগ্র দ্বীপপুঞ্জ এবং প্রধান দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। ১৮১০ সালে আমেরিকার জোনাথন ল্যাম্বার্ট দুই সঙ্গী (থমাস কুরি ও উইলিয়ামস্) সহ ত্রিস্তান দ্য কুনহা-তে পৌঁছান ; যিনি ছিলেন এই দ্বীপের প্রথম স্থায়ী বাসিন্দা। ১৮১৬ সালে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপপুঞ্জ অধিগ্রহণ করে এবং ১৮১৭ সালে স্কটিশ কর্পোরাল উইলিয়াম গ্লাসের নেতৃত্বে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সামরিক দুর্গ রূপে ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপে প্রথম বসতি স্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে এখানে অসামরিক জনসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পুত্র এবং এডিনবার্গ (স্কটল্যান্ড)-এর ডিউক প্রিন্স আলফ্রেড এই দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করেন। তাঁর সম্মানে ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র বসতিটির নামকরণ করা হয় সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ। স্থানীয়ভাবে এটি সর্বদা ‘দ্য সেটেলমেন্ট’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৬১-৬২ সালে ত্রিস্তান দ্য কুনহার আগ্নেয়গিরি (রানী মেরি’র শৃঙ্গ)-এর উদগিরণের ফলে সমস্ত বাসিন্দা দ্বীপত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। অগ্ন্যুদগম সময়কালে তাঁরা হ্যাম্পশায়ারের ক্যালশট গ্রামে অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯৬৩ সালে অধিকাংশ বাসিন্দা ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপে ফিরে আসেন ও বসতিটির পুনর্নির্মাণ করা হয়। অগ্ন্যুৎপাতের সময় তাঁদের অস্থায়ী বাসস্থানের নামানুসারে সাত সমুদ্রের এডিনবার্গের একমাত্র বন্দরটির নামকরণ করা হয় ক্যালশট হারবার।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবনে উদ্ভিদ-অঞ্চল বিন্যাস
সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ জনবসতিটি ৮০০ মিটার উঁচু পাহাড়ের নীচে বালুকাময় সৈকতের তীরে মৃদু ঢালু জমিতে অবস্থিত। এই দ্বীপের স্থানীয় বিষয়গুলি দ্বীপ পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হয়। যা একটি ১৪-সদস্যের প্রশাসন, বছরে ছয়বার মিলিত হয় এবং প্রতি তিন বছর পর নির্বাচিত হয়। এই বসতির একমাত্র সড়ক হল এম-১, যা অদূরে অবস্থিত আলুর ক্ষেত এলাকাকে বসতিটির সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই বসতির একটি অ্যাম্বুলেন্স (ক্যামোগলি হাসপাতাল দ্বারা পরিচালিত একটি টয়োটা হিলাক্স), একটি ফায়ার ইঞ্জিন (একটি ছোট মই সহ একটি ল্যান্ড রোভার ডিফেন্ডার) এবং একটি পুলিশ কার (ল্যান্ড রোভার সিরিজ) রয়েছে। বসতি প্রশাসনের ব্যবহারের জন্য একটি যানও রয়েছে। সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ বসতির সমস্ত বাসিন্দাই মূল বসতি স্থাপনকারীদের উত্তরসূরী এবং বর্তমান বাসিন্দাদের মধ্যে শুধুমাত্র সাতটি পারিবারিক পদবী টিকে রয়েছে। যথা : গ্লাস (উইলিয়াম, ১৮১৬, স্কটল্যান্ড) ; সয়ান (থমাস, ১৮২৬, ইংল্যান্ড) ; গ্রিন (পিটার, ১৮৩৬, নেদারল্যান্ড) ; রজার্স (থমাস, ১৮৩৬, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র) ; হ্যাগান (অ্যান্ড্রু, ১৮৪৯, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র) ; রেপেটো (আন্দ্রেয়া, ১৮৯২, ইতালি), লাভারেলো (গায়েটানো, ১৮৯২, ইতালি)। সাত সমুদ্রের এডিনবার্গে একজন প্রশাসক এবং ডাক্তার ও তাদের পরিবার মিলে একটি ছোট প্রবাসী জনসংখ্যাও রয়েছে। পুরোহিতরা শুধুমাত্র কয়েক মাসের জন্য থাকতে পারেন এবং অন্যান্য পরিদর্শনকারী পেশাদাররা (যেমন ডেন্টিস্ট, চোখের ডাক্তার) কয়েক সপ্তাহ বা মাসখানেক থাকতে পারেন।
ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপে আর্দ্র সামুদ্রিক জলবায়ু দেখা যায় এবং শুধুমাত্র জলপথ দ্বারা এই দ্বীপে যাতায়াত করা যায়। অধিকাংশ নৌযান দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহর (ত্রিস্তান দ্য কুনহা থেকে যার দূরত্ব ২৭৮৭ কিমি) থেকে সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ পাড়ি দেয়। কেপটাউন থেকে এই সমুদ্রযাত্রা সম্পূর্ণ হতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগে। সাত সমুদ্রের এডিনবার্গ বসতির মোট জনসংখ্যা ২৪৩ জন (জুন, ২০২১ জনগণনা অনুসারে)। ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। এই দ্বীপের অর্থনীতির বড়ো উৎস হল ‘ত্রিস্তান রক লবস্টার’ নামে পরিচিত একপ্রকার ক্রফিশের রপ্তানি। এছাড়া অর্থনীতিতে পর্যটনেরও সামান্য অবদান রয়েছে। এই দ্বীপে কোন হোটেল নেই, তবে পর্যটকদের জন্য বসতি প্রশাসন হোমস্টের ব্যবস্থা করেছে। পরিশেষে বলা যায়, চমকপ্রদ ইতিহাস ও অনন্য ভৌগোলিক অবস্থানে বিশ্বের নির্জনতম স্থায়ী বসতি সাত সাগরের এডিনবার্গ এক কথায় অনবদ্য।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- রিত্তিকা দত্ত (বেহালা, পর্ণশ্রী, কলকাতা)
তথ্যসূত্রঃ- Official Website of Tristan da Cunha Government & Tristan da Cunha Association ; Wikipedia ; Insider ; Encyclopaedia Britannica
Pingback: Topic - Women's Empowerment - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Rama Setu - Science & Ramayana - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: History of Farakka Barrage - ভূগোলিকা-Bhugolika
Outstanding…