Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Bikna – Dokra Village of Bankura

বাঁকুড়ার ডোকরা গ্রাম বিকনা

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Bikna – Dokra Village of Bankura । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বাঁকুড়ার ‘ডোকরা গ্রাম’ বিকনা সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Bikna - Dokra Village of Bankura
বিকনা গ্রামের ডোকরা শিল্প

ডোকরা (Dokra) হল ‘হারানো মোম ঢালাই’ পদ্ধতিতে তৈরি এক শিল্পকর্ম, যা প্রায় ৪৫০০ বছরের পুরানো। সিন্ধু সভ্যতার সময় মহেঞ্জোদারোতে ডোকরা শিল্পের অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন এই ধাতুজ শিল্প এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। ডোকরা শিল্পের মধ্যে বেঁচে আছে আদিম শিল্পধারা। কল্পনা, বৈচিত্র্য এবং কারিগরি — এই তিনের মিশ্রণ দেখা যায় গ্রাম বাংলার এই লোকশিল্পে। ডোকরা শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ সমাদৃত এবং বাঁকুড়া জেলার বিকনা গ্রাম হল ডোকরা শিল্পের জন্য জগৎ বিখ্যাত। বাঁকুড়া দুই নং ব্লকের অন্তর্গত বিকনা গ্রামটি বাঁকুড়া-রাণীগঞ্জ সড়কপথে (৯ নং রাজ্য সড়ক) বাঁকুড়া শহর থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে অবস্থিত। কোন সুদূর অতীতে বিকনা গ্রামে ডোকরা শিল্পের প্রচলন হয়েছিল তা বর্তমানে বিস্মৃত। কেউ কেউ বলেন ১৫০ বছর বা তারও আগে বিকনাতে প্রথম ডোকরা শিল্পের কাজ শুরু হয়। অনুমান এই যে, স্থানীয় পরিসরে বর্তমান ছত্তিশগড়ের বস্তার অঞ্চলে এই শিল্পের উদ্ভব হয়। তা প্রথমে ঝাড়খণ্ড ও বিহারে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। (Bikna – Dokra Village of Bankura)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মেদিনীপুরের গোপগড় ইকোপার্ক

বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামে কর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষেরা ডোকরা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এই কাজে যথেষ্ট কাঁচামাল ও শ্রম প্রয়োজন হয়। ডোকরা শিল্পকর্ম বানানোর প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। কিভাবে তৈরি হয় ডোকরা শিল্প সামগ্রী? প্রায় সাতটি ধাপে সম্পূর্ণভাবে শিল্পীদের হাতে তৈরি হয় ডোকরার বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী। ডোকরা শিল্পের মূল উপাদানগুলি হল : মিহি করে গুঁড়ো করা মাটি, ধুনো ও তেল মেশানো আঁটা বা মন্ড, মোম, পেতল, কাঠকয়লা ইত্যাদি। প্রথম ধাপে মাটিকে গুঁড়ো করে চালুনি দিয়ে খুব মিহি করে চেলে নেওয়া হয়। এরপর ধানের তুষ ও পরিমাণ মতো বালি মিশিয়ে মন্ড করা হয়। যে মূর্তি বা বস্তু তৈরি করা হবে ওই মাটির মন্ড দিয়ে তেমন আকৃতির আদলে একটা প্রাথমিক রূপ দেওয়া হয়। তার ওপরে গুঁড়ো মাটির সঙ্গে গোবর মিশিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয় যাতে আগুনে গরম করার সময় ফেটে না যায়। পরে সেগুলিকে ভালো ভাবে শুকনো করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে মোমকে একটি পাত্রে গরম করে গলিয়ে তার সঙ্গে কিছুটা ধূনোর গুঁড়ো ও তেল দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে চিটচিটে আঁঠার মত হলে শুকনো মূর্তির ওপর ভরাট করে প্রলেপ দেওয়া হয়। তৃতীয় ধাপে এরপর ওই গলানো মোমের কিছুটা অংশ একটু ঠান্ডা করে সরু সরু লেচি কাটার মতো কেটে বিভিন্ন মূর্তির হাত পা তৈরি হয়। আরও সরু সুতোর মত লম্বা আকৃতির টুকরো করে নানারকম সাজসজ্জা ও কারুকার্য তৈরি করা হয়। চতুর্থ ধাপে এইভাবে মূর্তিগুলির অঙ্গ প্রতঙ্গ ও সাজসজ্জা তৈরির পর পাতলা মাটি, ধানের তুষ ও বালি একসঙ্গে মেখে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে দেওয়া হয়। পঞ্চম ধাপে মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢাকার পর বড় ছুঁচ বা ছুরি দিয়ে মূর্তিগুলির গায়ে চ্যানেল তৈরি করা হয়, যার মধ্য দিয়ে গলানো পেতল প্রবেশ করানো হয়ে থাকে। ষষ্ঠ ধাপে মূর্তিগুলিকে আগুনে পোড়ানোর সময় মোমের প্রলেপ গলে বেরিয়ে গিয়ে শুন্যতার সৃষ্টি হয় এবং গলানো পেতল সেই স্থান গুলো ভরাট করে। সম্পূর্ণ রূপে ভরাট হয়ে গেলে একটি পাত্রে জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে ঠান্ডা করে যত্ন সহকারে একটু একটু করে মাটির প্রলেপ গুলো ছাড়ানো হয়। এরপর সপ্তম ধাপে চলে ফিনিশিংয়ের কাজ, যা ডোকরা শিল্পীরা নিজেদের দক্ষতা ও পারদর্শীতার সাহায্যে ফুটিয়ে তোলেন।

ডোকরা শিল্পে নির্মিত শিল্পসামগ্রী বর্তমানে বেশ বৈচিত্র্যময়। দীর্ঘ সময়ে একটু একটু করে পাল্টেছে বিকনার শিল্পীদের কাজের ধরন। এক সময় লক্ষ্মীর ভাঁড়, হাতি, ঘোড়া, চাল মাপার কুনকে, দেবদেবীর মূর্তি (গণেশ, লক্ষ্মী, নারায়ণ) তৈরির মধ্যেই ডোকরা শিল্প সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই শিল্পের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। জামাকাপড় রাখার হ্যাঙার থেকে পর্দা টাঙানোর ক্লিপ, গ্রিল থেকে শুরু করে মেয়েদের পার্সের বোতাম সবেতেই ঢুকে পড়েছে ডোকরা। বর্তমানে হাতের বালা, কানের দুল, পেনডেন্ট, পেপারওয়েট, চাবির রিং, ডোকরার গ্রিল, দরজার কড়া, সাবান কেস, আদিবাসী মূর্তি, গয়নার বাক্স, ফল রাখার ঝুড়ি, অ্যাসট্রে প্রভৃতি জিনিসও তৈরি হচ্ছে ডোকরা শিল্পে। বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামের শিল্পীদের কাজ পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানের ডোকরা শিল্পীদের কাজের থেকে আলাদা, কারণ বিকনা গ্রামের শিল্পীদের সলিড কাজের পাশাপাশি জালি বা নেটের কাজের সূক্ষ্মতাই তাঁদের শিল্পকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। ডোকরা শিল্পে মহিলাদের সাহায্য অপরিহার্য, বিকনা গ্রামেও সেই ধারাই দেখা যায়। এখানে পুরুষ শিল্পীরা নকশা তৈরি করার পর মেটাল কাস্টিং পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে মহিলারাই প্রধান ভূমিকা নেন।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : গনগনি – বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

বিকনা গ্রামেরই যুদ্ধ কর্মকার (বর্তমানে প্রয়াত) ১৯৮৮ সালে ডোকরার মনসাঝাড় তৈরি করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর হাতের কাজেই ডোকরার পরিচিতি অন্যমাত্র পায়। যুদ্ধবাবু পুরস্কার পাওয়ার পরেই বিকনার ডোকরা শিল্পের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। ধীরে ধীরে বাজারে চাহিদাও বাড়তে থাকে ডোকরার। তবে নব্বইয়ের দশকে লোকসানের মুখে পড়ে এই শিল্প। পরিস্থিতি এমনই হয় যে জীবনধারনের জন্য বহু শিল্পীই শিল্পকর্ম ছেড়ে রিকশা চালানো, দিনমজুরি শুরু করেন। যদিও ছবিটা অনেক বদলে গেছে সাম্প্রতিক কালে। তবে বর্তমানেও সমস্যা আছে ডোকরা শিল্পে। বর্ধিত দ্রব্যমূল্য, পেতলের জোগানের স্বল্পতা, আধুনিক ক্রেতাদের রুচি ও চাহিদার ক্রমপরিবর্তন প্রভৃতি সমস্যা ও চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়েই বিকনার ডোকরা শিল্পীরা এগিয়ে চলেছেন। সাম্প্রতিক কালে ডোকরা শিল্পসম্ভারের ঝুলিতে নতুন ভাবে সংযোজিত হয়েছে অনেক কিছুই। যা আকৃষ্ট করছে বিভিন্ন শ্রেণির ক্রেতাদের। রোজগার বেড়ে মুখে হাসি ফুটেছে শিল্পীদেরও। আশা রাখি, বিকনার ডোকরা শিল্প আগামী দিনে আরও উন্নতি করবে। (Bikna – Dokra Village of Bankura)

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]

লেখিকাঃ- দেবিকা হালদার (জলঙ্গি, মুর্শিদাবাদ)
তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; এই সময় ; etravelguru ; বঙ্গ দর্শন

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : মহাদেশ সংযোগকারী বসফরাস সেতু

3 thoughts on “Bikna – Dokra Village of Bankura

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!