প্রাকৃতিক বর্ষাতি ঘঙ

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Natural Raincoat – Ghong । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক বর্ষাতি ঘঙ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে ছোটোনাগপুর মালভূমির ক্ষয়িষ্ণু পূর্বাংশে লাল মাটি, জঙ্গল আর বিক্ষিপ্ত পাহাড়-ডুংরি অধ্যুষিত এলাকা জঙ্গলমহল (Jangalmahal)। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর — এই ৪ জেলাতে বিস্তৃত জঙ্গলমহলে হস্তশিল্পের বিবিধ নিদর্শন রয়েছে। কুটির শিল্পে এই অঞ্চলের ভূমিকা অগ্রগণ্য। পাহাড় ও অরণ্যে ঘেরা, আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলের হস্তশিল্প কারিগরি বিশেষ উল্লেখ্য। এ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের হস্তশিল্পের তেমনই এক নিদর্শন হল ‘ঘঙ’ (Ghong)। কোথাও কোথাও ঘোঙ (Ghong) বা ঘুঙ (Ghung) নামেও পরিচিত। ‘ঘঙ’ শব্দটি জঙ্গলমহলের মানুষের নিকট অপরিচিত নয়। ঘঙ হল পাতা দিয়ে তৈরি একপ্রকার প্রাকৃতিক বর্ষাতি (Natural Raincoat)! শহুরে সমাজের রঙবেরঙের আধুনিক বর্ষাতি নয় ; ঘঙ হল জঙ্গলমহলে প্রত্যন্ত অরণ্যসংকুল অঞ্চলের গরীব মানুষের বর্ষাকালের ভরসা। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম-পশ্চিম মেদিনীপুর — এ রাজ্যের জঙ্গলমহলের সব জেলাতেই স্থানে স্থানে দেখা যায় প্রাকৃতিক বর্ষাতি ঘঙের ব্যবহার। মূলত চিহড় পাতা দিয়ে ঘঙ তৈরি করা হয়।

জঙ্গলমহলের শালবনে শালগাছ বেয়ে ওঠা একপ্রকার বহুবর্ষজীবী লতা হল চিহড় (Chihar), যা শিয়ালি লতা (Siali Lata) নামেও পরিচিত। এই চিহড় লতার খাঁজকাটা পাতা দিয়েই তৈরি হয় ঘঙ। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে চৈত্র-বৈশাখ মাস নাগাদ চিহড় পাতা সংগ্রহ করে বাড়ির দেওয়ালে সারি বেঁধে শুকনো করা হয়। সবুজ চিহড় পাতা রোদে শুকিয়ে তামাটে রঙ ধারণ করে। তারপর জ্যৈষ্ঠের শেষে বা আষাঢ়ের শুরুতে শুকনো পাতা বৃষ্টিতে ভিজে কিছুটা নরম হলে বাড়ির মহিলারা সজারুর কাঁটা দিয়ে এই পাতা বেঁধে ঘঙ তৈরি করেন। প্রথমে একটা পাতার নিচে দুটি পাতা, তার নিচে আবার তিন-চারটি পাতাকে একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে ঘঙ বোনা হয়। মাছের আঁশের মতো ওপর থেকে নিচে সারি সারি ভাবে চিহড় পাতাগুলি সাজানো হয়। ঘঙের ওপরের অংশ কৌণিক ত্রিভুজাকার। ঘঙ মাথার ওপর চাপালে মাথা থেকে শরীরের পিছন দিকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা থাকে। বাচ্চাদের জন্য উচ্চতা অনুসারে ঘঙের মাপ ঠিক করে নিতে হয়। চড়া রোদ, প্রবল বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি — সবেতেই দারুণ কার্যকরী ঘঙ।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : জঙ্গলমহলের কুড়কুড়ে ছাতু

জঙ্গলমহলের মাহালি জনজাতি (Mahali/Mahli Tribe) ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনী-বেলপাহাড়ির অরণ্যাঞ্চলে বসবাস করে। শিকারীজীবী এই সম্প্রদায়ও চিহড় পাতা দিয়ে ঘঙ তৈরি করে। ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়ের নিকটে পাশাপাশি দুটি গ্রাম রয়েছে — বড়ো ঘুঙ (Bara Ghung) ও ছোটো ঘুঙ (Chhota Ghung) ; যা মাহালি জনজাতির পেশা নির্দেশক দুটি স্থান-নাম। জঙ্গলমহলে চিহড় লতার গুরুত্ব কম নয়। সাঁওতালদের ধর্মীয় জীবনেও চিহড় পাতার গুরুত্ব রয়েছে। ভাদ্র মাসের শুল্কা দ্বাদশী তিথিতে সাঁওতালদের ছাতা পরবে ছাতোম বোঙার থানে চিহড় পাতার ছাতা উৎসর্গ করা হয়। এ যেন লোকশিল্প ও ধর্মীয় বিশ্বাসের এক অনবদ্য মিশেল। আবার, বিরহোড় জনজাতি (Birhor Tribe) বুনো চিহড় লতা দিয়ে বুনে বাসস্থান ‘কুমভা’ (Kumbha) তৈরি করে।

মূলত বর্ষাকালেই ঘঙের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়। বর্ষাতে বৃষ্টি চলাকালীন মাথায় ঘঙ চাপিয়ে কৃষিজমিতে মই দেওয়া, বীজ বোনা সব কাজই করা যায়। সমস্যা একটাই, এক-একটি ঘঙের ওজন প্রায় তিন-চার কেজি বা তারও বেশি! এমন জিনিস মাথায় চাপিয়ে ঘোরা কিন্তু সহজ নয়। ঘঙ শুধুমাত্র জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি উপকরণ নয়। ঘঙ এই অঞ্চলের মানুষের প্রয়োজনীয়তা ও লোকশিল্পের মিশ্রণে অরণ্য-মানুষ পারস্পরিক সম্পর্কের এক খন্ডচিত্র তুলে ধরে। বর্তমানে অবশ্য চাষীদের সুবিধার্থে প্লাস্টিকের বর্ষাতির ব্যবহার দেখা যায়। প্লাস্টিকের বর্ষাতিগুলি ঘঙের তুলনায় ওজনে অনেক হালকা হওয়ার ফলে, বর্তমানে চাষিদের অনেকেই তা ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ঘঙ হস্তশিল্প তাই ক্রমশ ম্রিয়মাণ। আধুনিকতার ছোঁয়াতে হারিয়ে যাচ্ছে চিহড় পাতার পরিবেশ-বান্ধব বর্ষাতি ঘঙ ; যার সাথে মিশে রয়েছে জঙ্গলমহলের নিজস্ব লোকশিল্পের ঐতিহ্য।

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]

লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- বাংলার লোকপ্রযুক্তি : ঘোঙ – অভিনন্দন ফেসবুক পেজ ; বর্ষামঙ্গল : ঘোঙ/ঘঙ তৈরি – সমুদ্রগুপ্ত মল্লিক – পুরুলিয়ার কথা ও কাহিনী ফেসবুক পেজ ; Daily News Reel ; সংবাদ প্রতিদিন ; প্রসঙ্গ লোকশিল্প : কিছু ভাবনা – স্বাতী ভট্টাচার্য ; প্রভাতী মেদিনীপুর|ছবি সৌজন্যেঃ- PURULIA-Purulia ফেসবুক পেজ

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবনের ড্যাম্পিয়ার হজেস রেখা