Kawah Ijen – Blue Flame Volcano
কাওয়াহ ইজেন – নীল শিখা আগ্নেয়গিরি
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Kawah Ijen – Blue Flame Volcano । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি ইন্দোনেশিয়ার ‘নীল শিখা আগ্নেয়গিরি’ কাওয়াহ ইজেন সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

ইন্দোনেশিয়া (Indonesia) হল বিশ্বের দীর্ঘতম দ্বীপ-রাষ্ট্র (World’s Longest Island Country)। সাড়ে সতেরো হাজারেরও বেশি ছোটো-বড়ো দ্বীপ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া ভূতাত্ত্বিকভাবে আগ্নেয়গিরি অধ্যুষিত একটি দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলা (Pacific Ring of Fire)-তে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়াতে বর্তমানে ১৩০ টি সক্রিয় বা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। সেরকমই একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হল ‘কাওয়াহ ইজেন’ (Kawah Ijen), যা ‘নীল শিখা আগ্নেয়গিরি’ (Blue Flame Volcano) নামে পরিচিত। কাওয়াহ ইজেন আগ্নেয়গিরিটি ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। প্রশাসনিক ভাবে, এটি ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভা প্রদেশের বানয়ুওয়াঙ্গি এবং বোন্দোয়োসো রিজেন্সির সীমান্তে অবস্থিত।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য নীলগিরি
গঠন ও আকৃতি অনুসারে কাওয়াহ ইজেন একটি বিমিশ্র শঙ্কু বিশিষ্ট আগ্নেয়গিরি (Composite Cone Volcano)। দীর্ঘকাল ধরে ছোটো-বড়ো অগ্ন্যুৎপাতের সমন্বয়ে লাভা ও ভস্ম স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে এইপ্রকার আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয়। স্তরে স্তরে সজ্জিত হওয়ার জন্য এই প্রকার আগ্নেয়গিরি ‘স্তর আগ্নেয়গিরি’ (Strato Volcano) নামেও পরিচিত। এধরনের আগ্নেয়গিরিতে প্রধান শঙ্কু সহ একাধিক গৌণ শঙ্কু থাকে, যা কাওয়াহ ইজেন আগ্নেয়গিরিতেও রয়েছে। তাই সমগ্র অঞ্চলটিকে কাওয়াহ ইজেন আগ্নেয়গিরি চত্বর (Kawah Ijen Volcano Complex) বলা হয়। এখনও পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে শেষবার এই আগ্নেয়গিরিতে কোনোপ্রকার উদগিরণ দেখা গেছে। তবে ২০১২ সালে এই আগ্নেয়গিরিতে সক্রিয়তা লক্ষ্য করা গেছে। কাওয়াহ ইজেন আগ্নেয়গিরির উচ্চতা হল ২৭৬৯ মিটার এবং গুনুং মেরাপি হল এই আগ্নেয় চত্বরের উচ্চতম স্থান (Highest Point of Kawah Ijen Volcano Complex)। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় গুনুং মেরাপির অর্থ হল আগুনের পর্বত (Mountain of Fire)। গুনুং মেরাপির ঠিক পশ্চিমেই কাওয়াহ ইজেন সক্রিয় জ্বালামুখটি রয়েছে। এই জ্বালামুখে ১ কিমি প্রশস্ত একটি আকাশি রঙের আম্লিক হ্রদ (Acidic Lake) রয়েছে। এই হ্রদটি হল বিশ্বের বৃহত্তম অতি উচ্চ আম্লিক জ্বালামুখ হ্রদ (Largest Highly Acidic Crater Lake in the World)।
কাওয়াহ ইজেন জ্বালামুখ হ্রদটি প্রায় ২০০ মিটার গভীর এবং সালফিউরিক অ্যাসিডের ঘনীকরণ দেখা যায়, যা সক্রিয় জ্বালামুখ পার্শ্বস্থ ছিদ্রপথ দিয়ে সালফার বা গন্ধক মিশ্রিত গ্যাস-বাষ্প নির্গমনের ফলে হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, যে আগ্নেয় ছিদ্রপথ থেকে সালফার জাতীয় গ্যাস নির্গত হয়, তাকে সালফাটরা (Solfatara) বলে। ২০০৮ সালে গ্রিক-কানাডিয়ান অভিযাত্রী জর্জ কৌরৌনিস (George Kourounis) একটি রবারের বোটের সাহায্যে এই হ্রদের pH মাত্রা পরিমাপ করেন। ওই পরিমাপ অনুসারে, হ্রদটির প্রান্তদেশে ও মধ্যভাগে pH এর মাত্রা যথাক্রমে ০.৫ এবং ০.১৩। স্থানীয় বাসিন্দারা এই হ্রদ থেকে সালফার সংগ্রহ করে থাকেন। চিনামাটির পাইপের দ্বারা সালফার গ্যাসকে ঘনীভূত করে কঠিন সালফার সংগ্রহ করা হয়। প্রতিদিন প্রায় দুই শতাধিক শ্রমিক এই হ্রদ থেকে দৈনিক গড়ে ১৪ টন সালফার সংগ্রহ করেন, যা ওই হ্রদে দৈনিক সালফার সঞ্চয়ের মাত্র ২০%।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ধনিয়াখালির তাঁত শিল্প
এবার আসা যাক নীল শিখা রহস্যে! কিভাবে এখানে নীল অগ্নিশিখা সৃষ্টি হয়? এটি একেবারেই প্রাকৃতিক ঘটনা। কাওয়াহ ইজেন জ্বালামুখ সংলগ্ন অঞ্চলে আগ্নেয় সক্রিয়তার কারণে অসংখ্য ছিদ্রপথ থেকে সালফার নির্গত হয়। আর ভূগর্ভস্থ আগ্নেয় উত্তাপের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠস্থ সালফারে দহনক্রিয়া ঘটে থাকে। সালফার দহনের ফলে সালফার ডাই অক্সাইড এবং সালফার ট্রাই অক্সাইড গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাসগুলি জারিত হয়ে (বাতাসের অক্সিজেনের সাথে রাসায়নিক যুক্ত হয়ে) অতি উষ্ণ নীল অগ্নিশিখা সৃষ্টি করে। আমরা জানি যে, অতি উষ্ণ আগুন নীল রঙেরই হয়ে থাকে। কারণ অতি উষ্ণ আগুন আলোর ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অধিক মাত্রায় সক্রিয় ফোটন নির্গমন করে থাকে। ঠিক যে কারণে অধিক উষ্ণতাযুক্ত নক্ষত্রের রঙ নীলাভ হয়। সাধারণত ৩৬০ ডিগ্রি C -এর অধিক উষ্ণতায় সালফারে দহনক্রিয়া ঘটে থাকে। কিন্তু আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত সালফারের উষ্ণতা থাকে প্রায় ৬০০ ডিগ্রি C। ফলে আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত সালফার ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানো মাত্রই কম উষ্ণতা এবং চাপের কারণে দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়াতে জ্বলে ওঠে এবং নীল অগ্নিশিখা তৈরি হয়। এই নীল অগ্নিশিখার উচ্চতা প্রায় ৫ মিটার পর্যন্ত হয়।
অতি উচ্চ উষ্ণতায় কখনো কখনো গলিত সালফার আগ্নেয়গিরির পৃষ্ঠদেশে পতিত হয় এবং ঢাল বেয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। তখন নীল শিখার এই জ্বলন্ত সালফারকে নীল রঙের লাভার মতো দেখতে লাগে। তাই অনেকে একে ‘নীল লাভা’ (Blue Lava) বলে থাকেন। যদিও ভূপৃষ্ঠে কখনই প্রকৃত নীল লাভার দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ কমপক্ষে ৬০০০ ডিগ্রি C উষ্ণতা প্রয়োজন নীল রঙের লাভা তৈরি হতে এবং ভূপৃষ্ঠে কোনো লাভাই ওই পরিমাণ উষ্ণ থাকে না। তাই ভূপৃষ্ঠস্থ লাভা সবসময় লাল-কমলা রঙের হয়ে থাকে। কাওয়াহ ইজেন হল পৃথিবীর বৃহত্তম নীল শিখা অঞ্চল (Largest Blue Flame Area in the World) এবং স্থানীয় বাসিন্দারা একে ‘অপি বিরু’ (Api Biru) নামে অভিহিত করেন, যার অর্থও হল নীল আগুন। অগ্ন্যুৎপাত না ঘটলেও, সালফার জাতীয় গ্যাস নির্গমনের কারণে প্রতিনিয়ত এখানে নীল অগ্নিশিখার মায়াবী খেলা চলে, তবে নীল রঙের কারণে শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই এই নীল অগ্নিশিখা দৃশ্যমান হয়। বিভিন্ন মিডিয়াতে এই নীল শিখার আগ্নেয়গিরির কথা প্রচারিত হওয়ার পর, কাওয়াহ ইজেন আগ্নেয় চত্বরে পর্যটক সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে কাওয়াহ ইজেন আগ্নেয়গিরি সহ ইজেন জিওপার্ক (Ijen Geopark) ইউনেস্কো গ্লোবাল জিওপার্কের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মায়াবী প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর নীল শিখা দেখে হয়তো আপনিও গেয়ে উঠতে পারেন, “নীল রঙ ছিল ভীষণ প্রিয়/তাই সবকিছু নীলিয়ে দিল/মনে পড়ে কি সেদিন/ বলেছিলাম তোমায়!”…
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Deutsche Welle ; Global Volcanism Program/Smithsonian Institution National Museum of Natural History ; Wikipedia ; কালের কন্ঠ ; BBC News ; National Geographic ; The Jakarta Post