Mangoes of Malda
মালদার আম
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Mangoes of Malda । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি মালদার আম সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

বাঙালি তথা ভারতীয়দের অত্যন্ত পরিচিত ফল হল আম (Mango)। বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা (Mangifera indica)। গ্রীষ্মকালে রসনাতৃপ্তির এক অন্যতম ফল এই আমের সঙ্গে বাঙালির এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমের প্রতি প্রেম নিবেদন করে লিখেছিলেন — ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,তাহাতে কদলী দলি/সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে/হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ/পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে’ (জীবন স্মৃতি – কাব্যরচনাচর্চা)। ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর দেশ ভারতবর্ষের গ্রীষ্মকালে উৎপাদিত এই ফসল সারা বিশ্বব্যাপী সুবিখ্যাত ; স্বাদে-সুগন্ধে এবং অতুলনীয় সৌন্দর্যে। সারা পৃথিবী জুড়ে ৫০০-রও বেশি ধরনের আম পাওয়া যায়। শুধু ফল হিসেবেই নয়, আধুনিক মানুষের নানা রকম মিষ্টি, আইসক্রিম, জ্যাম, জেলি, আচার ইত্যাদি খাবারকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে এক অন্যতম উপাদান হল আম। ভারতের জাতীয় ফল আম শুধুমাত্র সুস্বাদুই নয়, পুষ্টিগুণেও ভরপুর। প্রতি ১০০ গ্রাম আমে (ভোজ্য অংশ) ১৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ০.৮ গ্রাম প্রোটিন, ০.৪ গ্রাম ফ্যাট, পটাশিয়াম ১৬৮ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি৬ প্রভৃতি খাদ্যগুণ রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম আম (ভোজ্য অংশ) থেকে ৬০-৬৫ ক্যালোরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়। ভূগোলে উদ্যানকৃষির আলোকে, প্রায় সারাবছর পাওয়া যায় এমন ফলের বাণিজ্যিক চাষকে পোমামকালচার বলে। যার বাংলা তর্জমা মরশুমি ফল। সেই অর্থে আমও পোমামকালচারের অন্তর্গত একটি ফল। আর এই আমচাষের ক্ষেত্রে সুদীর্ঘকাল ধরে অত্যন্ত শৌর্যের সাথে খ্যাতি অর্জন করে চলেছে প্রাচীন বাংলার গৌড়বঙ্গ নামে পরিচিত বর্তমান মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলা। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারতে মালদার আম (Mangoes of Malda) বিখ্যাত। মালদা জেলা পশ্চিমবঙ্গের ‘আমের জেলা’ (Mango District) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। (Mangoes of Malda)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : জঙ্গলমহলের কুড়কুড়ে ছাতু
মালদা জেলার ১৫০ থেকে ২০০ রকমের আম চাষ করা হয়। মালদা জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত আম হল ফজলি। ‘ফজলি’ নামকরণের পিছনেও একটি ইতিহাস রয়েছে — কথিত আছে, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মালদার কালেক্টর রেভেন সাহেব ঘোড়ার গাড়ি চেপে যাচ্ছিলেন। পথে তার জলতেষ্টা মেটানোর জন্য গ্রামের এক মহিলার কাছে জল চান। ফজলু বিবি নামে সেই মহিলার বাড়ির আঙিনায় বড়ো একটি আমের গাছ ছিল। ফজলু বিবি সেই আম দিয়ে ফকির-সন্ন্যাসীদের আপ্যায়ন করতেন (এইজন্য এই আমের আরেক নাম ‘ফকিরভোগ’)। ফজলু বিবি সাহেবকে জলের বদলে একটি আম খেতে দেন। সাহেব আম খেয়ে ইংরাজি আমের নাম জিজ্ঞেস করেন। ফজলু বিবি প্রশ্নটি বুঝতে না পেরে নিজের নামই বলে বসেন! সেই থেকে এই আমের নাম হয় ফজলি। ফজলি ছাড়াও মালদা জেলায় প্রাপ্ত অন্যান্য আমগুলি হল — ল্যাংড়া, গোলাপখাস, মোহনভোগ, দুধকুমার, বেগমবাহার, হিমসাগর, আশ্বিনা, গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, কিষেণভোগ, আম্রপালি, মল্লিকা প্রভৃতি। নানান রকম আমের মধ্যে, মালদা জেলাতে ফজলি আমের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। মালদা জেলার মোট উৎপাদিত আমের ৩৫-৪৫% ফজলি। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে মালদার তিনটি আম (হিমসাগর, লক্ষ্মণভোগ ও ফজলি) ভারত সরকারের জি.আই. স্বীকৃতি পেয়েছে। মালদা জেলায় বর্তমানে ৩১,৬৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়ে থাকে। সেচ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় এক দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে দু’লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হচ্ছে মালদা জেলায়। মালদা জেলাতে পশ্চিমবঙ্গের মোট আম উৎপাদনের ৪৫-৫৫% উৎপাদিত হয়। পৃথিবীর সর্বাধিক আম উৎপাদনকারী দেশ ভারতের মোট আম উৎপাদনের ২-৪% মালদা জেলাতে উৎপাদিত হয়। মালদা জেলাতে ২০২২ সালে ৩.৭০ লক্ষ মেট্রিক টন, ২০২৩ সালে ৩.৭৫ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছিল। মালদা জেলার মধ্যে ইংরেজবাজার ব্লক আম উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে। এই ব্লকে মালদা জেলার মোট আম উৎপাদনের ৩৫-৪০% উৎপাদিত হয়। এছাড়া মানিকচক, রতুয়া-১, রতুয়া-২, কালিয়াচক-১, পুরাতন মালদা, কালিয়াচক-২, চাঁচল-১ আম উৎপাদনে অগ্রণী ব্লক হিসেবে পরিচিত।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দ্বৈত নাগরিকত্বের লংওয়া গ্রাম
মালদা জেলার অর্থনীতিতে আমচাষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত এই ফসলটি বাজারজাত করে কৃষকেরা লাভের মুখ দেখেন। বর্তমানে মালদার আম বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে, আমচাষে সাম্প্রতিককালে অনেকরকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে। আমের মুকুলের সময় ঝড়বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, পোকার উৎপাত, বিকল্প সস্তা আম (বিশেষত দক্ষিণ ভারত থেকে আগত) -এর বাজার প্রতিযোগিতা, গুণগতমান হ্রাস ইত্যাদি কারণে আমচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। এছাড়া আমচাষে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার এবং কার্বাইড দ্বারা আম পাকানোর ফলে স্বাদ ও গন্ধ হারিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে চাহিদা হ্রাসও একটি বড়ো সমস্যা। তাই বাড়ছে জীবিকার সন্ধানে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। বর্তমানে সামাজিক ও গণমাধ্যমের বিশেষ সহযোগিতার দ্বারা আমচাষে নিযুক্ত কৃষকদের দুর্দশা ও সমস্যা তুলে ধরার ফলে, তা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মালদার আমচাষকে আরও উন্নত করতে ব্যবস্থা নিচ্ছে জেলা প্রশাসন। আম চাষিদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আমচাষ সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। এছাড়া, রাসায়নিক ব্যবহারে আমচাষে ক্ষতির বিষয়গুলিও তুলে ধরা হচ্ছে। আশা করা যায়, সমস্যা কাটিয়ে মালদার আমচাষের আবারও শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। (Mangoes of Malda)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- বর্ণালী মন্ডল (মুর্শিদাবাদ)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; অর্থনৈতিক ভূগোল ও সম্পদ শাস্ত্রের পরিচয় – অনীশ চ্যাটার্জী ; NDTV ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; Hindustan Times ; Shodhganga
Good
Pingback: Mama-Bhagne Hill of Birbhum - ভূগোলিকা-Bhugolika
খুব সুন্দর লেখা …
শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
অপূর্ব… খুব ভালো হয়েছে।
ধন্যবাদ ❤️
Very Nice
Very Nice
Pingback: Kurkure Chhatu of Jangalmahal//জঙ্গলমহলের কুড়কুড়ে ছাতু - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Lonar Lake of Deccan - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Lakshadweep - Paradise of Tourists - ভূগোলিকা-Bhugolika
Nice One!
ধন্যবাদ ❤️