Jarawa Tribe of Andaman Islands
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া উপজাতি
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Jarawa Tribe of Andaman Islands । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া উপজাতি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

ভারত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ (Andaman & Nicobar Islands) হল ভারতের বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জ (Largest Archipelago of India) এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (Union Territory)। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে একাধিক প্রাচীন জনজাতি বসবাস করে, যাদের মধ্যে অন্যতম জারোয়া উপজাতি (Jarawa Tribe)। আন্দামানের ভাষা ‘আকা-বিয়া’ (Aka-bea) অনুসারে, জারোয়া শব্দের অর্থ আগন্তুক। কিন্তু জারোয়া নিজেদের ‘অং/অওং’ (Ang/Aong) বলে অভিহিত করে থাকে, যার অর্থ জনতা। ভারতের সাংবিধানিক পরিসরে, জারোয়ারা তপশিলী উপজাতি (Scheduled Tribe) শ্রেণীর অন্তর্গত। জারোয়ারা হল একটি যাযাবর উপজাতি; খাদ্য সংগ্রহ, সামাজিকীকরণ প্রভৃতি উদ্দেশ্যে তারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমন করে।
অধিকাংশ নৃতত্ত্ববিদের মতে, জারোয়ারা হল বর্তমানে বিলুপ্ত জঙ্গিল উপজাতি (Jangil Tribe) -এর উত্তরসূরী এবং অনুমান করা হয়, দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে জারোয়ারা বর্তমান রূপে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে জারোয়ারা গ্রেটার আন্দামানীদের থেকে স্বতন্ত্র। অনেক নৃতত্ত্ববিদের মতে, জারোয়া উপজাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে আফ্রিকান উপজাতি গোষ্ঠীর নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। জারোয়ারা একপ্রকার নেগ্রিটো উপজাতি (Negrito Tribe)। উনিশ শতকের আগে, জারোয়াদের বসতি দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বিস্তৃত ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসননীতি এবং বহিরাগত জনসংখ্যার পুনর্বাসনের কারনে জারোয়াদের বসতি অঞ্চলের পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে জারোয়ারা মধ্য ও দক্ষিণ আন্দামান (Middle & South Andaman) -এর পশ্চিম অংশে বসবাস করে। বসতি অঞ্চল অনুসারে, জারোয়াদের তিনটে উপবিভাগ দেখা যায় — (১) উত্তরের দল, যা জারোয়াদের নিকট ‘তানমাদ’ (Tanmad) এবং বহিরাগতদের নিকট ‘কদমতলা জারোয়া’ নামে পরিচিত; (২) মধ্যভাগের দল, যা জারোয়াদের নিকট ‘থিডন’ (Thidon) এবং বহিরাগতদের নিকট ‘আর. কে. নালা জারোয়া’ নামে পরিচিত; (৩) দক্ষিণের দল, যা জারোয়াদের নিকট ‘বৈয়াব’ (Boiab) এবং বহিরাগতদের নিকট ‘টিরুর জারোয়া’ নামে পরিচিত (Jarawa Tribe of Andaman Islands)।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবন এবং জীবন-জীবিকা
প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ সীতা ভেঙ্কটেশ্বরের ‘Development And Ethnocide : Colonial Practices In The Andaman Islands’ (২০০৪) গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯০১ সালে জারোয়া জনসংখ্যা ছিল ৪৬৮। ১৯৩১ সালে যা হ্রাস পেয়ে নেমে আসে ৭০-এ। তবে সাম্প্রতিক কালে জারোয়াদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৮ সালের এক সমীক্ষা অনুসারে, জারোয়াদের জনসংখ্যা ছিল ২৩৫। ভারতের জনগণনা ২০০১ এবং ২০১১ অনুসারে, জারোয়াদের জনসংখ্যা হল ২৪০ এবং ৩৮০। ভারতের রাজ্যসভার প্রশ্নোত্তর পর্বের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে জারোয়াদের জনসংখ্যা ৪২৭ এবং তারা ১০২৮ বর্গকিম এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। অ্যানথ্রোপলিজ্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সমীক্ষা (২০১৬) বলছে, জারোয়াদের জনসংখ্যা ৪২৯। ANI এর ডিরেক্টর অফ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার নবলেন্দ্র কুমার সিং এর মতে, ২০১৭ সালে জারোয়া জনসংখ্যা ৪৭১। বর্তমানে গড় হিসাবে, জারোয়াদের জনসংখ্যা আনুমানিক ৪৫০-৫০০।
জারোয়াদের সমাজ ব্যবস্থা তিনটি সামাজিক এককে বিভক্ত; যথা — (১) পরিবার (Family): এটি সবচেয়ে ক্ষুদ্র সামাজিক একক, যা আবার তিনপ্রকার অণু পরিবার, বালক ও বিধবাদের পরিবার, বালিকা ও বিধবাদের পরিবার। (২) স্থানীয় দল (Local Groups): অনেকগুলি পরিবার নিয়ে একটি স্থানীয় দল গঠিত হয়। সময়ে সময়ে একটি স্থানীয় দল আরও ক্ষুদ্র একাধিক দলে বিভক্ত হয়, আবার অন্য একটি স্থানীয় দলের সাথে মিলিতও হয়। (৩) আঞ্চলিক দল (Regional Groups): এটি সবচেয়ে বৃহৎ সামাজিক একক, যা অনেকগুলি স্থানীয় দল মিলে তৈরি হয়। একটি আঞ্চলিক দলের শিকার, খাদ্য সন্ধান প্রভৃতি বিষয়ে অনেক নিয়মকানুন থাকে, যা সকল সদস্য মেনে চলে।
জারোয়ারা কুঁড়েঘরে বসবাস করে, যা ‘চাড্ডা’ (Chadda) নামে পরিচিত। এই কুঁড়েঘরগুলি আবার বিভিন্ন প্রকারের হয়। জারোয়াদের সংগৃহীত খাদ্যগুলি হল — বন্য আলু, বন্য ওল, মধু, কাঁঠাল, শামুক, মাছ, শূকর, মনিটর লিজার্ড, গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া, কচ্ছপের ডিম, বিভিন্ন প্রকার বীজ প্রভৃতি। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহে জারোয়ারা তীর-ধনুক, ছুরি, বেতের ঝুড়ি, মশাল, ‘Kekad’ নামের একপ্রকার চেস্ট গার্ড প্রভৃতি ব্যবহার করে। জারোয়া সমাজে ছেলেদের কৈশোরপ্রাপ্তিতে ও মেয়েদের যৌবনে পদার্পণে অনুষ্ঠান হয়। ছেলেদের ১৮-২০ বছর বয়সে এবং মেয়েদের ১৪-১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে থাকে। জারোয়া সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলিত রয়েছে। জারোয়াদের জীবনযাত্রায় সূর্য ও চন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখে তারা দিক নির্ণয় করে। পূর্ণিমার রাত জারোয়াদের বিশেষ পছন্দের। পূর্ণিমার রাতে তারা নাচ-গান করে, আবার শিকারে যায়। জারোয়ারা সাধারণত পোশাক পরেনা। ডিম, শামুক, কচ্ছপের খোলা কিংবা ফুল, লতাপাতা প্রভৃতি দ্বারা তৈরি অলঙ্কার ব্যবহার করে। তবে বর্তমানে কেউ কেউ পোশাক ব্যবহার করে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দক্ষিণের ডুয়ার্স – ঝালুয়ারবেড়
জারোয়া উপজাতিদের সঙ্গে সভ্য মানুষদের সংস্পর্শ প্রায় নেই বললেই চলে। ১৯৯৮-তে তাদের দ্বীপের কাছে বসতি স্থাপন করা কিছু মানুষের সঙ্গে শুধু তাদের সামান্য যোগাযোগ আছে। জারোয়ারা জারোয়া ভাষা (Jarawa Language) ব্যবহার করে, যা একপ্রকার ওঙ্গান ভাষা (Ongan Language)। অ্যানথ্রোপলিজ্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত ‘পার্টিকুলারলি ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপস অফ ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, জারোয়াদের মৃতদের দেহ পোড়ানো কিংবা কবর দেওয়া হয় না। কেউ মৃতপ্রায় বুঝতে পারলেই ওই ব্যক্তিকে বাড়ির বাইরে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। বসবাস এলাকা থেকে দূরে একটি গাছের তলায় বসিয়ে রাখা হয়। মৃত্যুর পর দেহটি সেখানেই পচতে দেওয়া হয়। এরপর রয়ে যাওয়া হাড়গোড় নিয়ে যাওয়া হয়। সেগুলো তীরের মুখ তীক্ষ্ণ করতে ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে জারোয়া উপজাতি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও, আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে জারোয়া সমাজ ও সংস্কৃতি হুমকিগ্রস্ত। ১৯৭০ এর দশকে গ্রেট আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণের পর জারোয়াদের বাসভূমি, খাদ্য ও জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। একাধিক বার রোগের প্রাদুর্ভাবও ঘটেছে। রয়েছে চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্যও। পাশাপাশি পর্যটনের প্রসারে জারোয়াদের নগ্ন ছবি ও ভিডিয়ো তৈরি, জারোয়া নিগ্রহ প্রভৃতি নেতিবাচক দিকগুলি উঠে এসেছে। বহিরাগতদের ‘কু’-প্রভাবে জনজাতির বিপর্যয়ের আশঙ্কাও রয়েছে। বহিরাগতদের কাছ থেকে জারোয়ারা সহিংসতা বা যৌন শোষণের শিকার হতে পারে কিংবা এমন রোগের সম্মুখীন হতে পারে যার বিরুদ্ধে তাদের কোনো প্রতিরোধ জানা নেই। কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পর্যটক গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয়গুলির মাধ্যমে জারোয়াদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করা দরকার। তাই, জারোয়াদের সমাজ, সংস্কৃতিকে অপরিবর্তিত রূপে টিকিয়ে রাখতে আরও বেশি প্রশাসনিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- দেবিকা হালদার (জলঙ্গি, মুর্শিদাবাদ)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia; সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূগোলের রূপরেখা – অলোক পাল; এই সময়; আনন্দবাজার পত্রিকা; বিবিসি নিউজ বাংলা; Survival International; Livemint/Mint e-paper
Pingback: Edinburgh of the Seven Seas - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Topic - Women's Empowerment - ভূগোলিকা-Bhugolika
Very Good