Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Spatial Distribution of Vegetation in Sundarban

সুন্দরবনে উদ্ভিদ-অঞ্চল বিন্যাস

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Spatial Distribution of Vegetation in Sundarban । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সুন্দরবনে উদ্ভিদ-অঞ্চল বিন্যাস সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Spatial Distribution of Vegetation in Sundarban
সুন্দরবনে উদ্ভিদ-অঞ্চল বিন্যাস

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে সুন্দরবনের বিস্তার ছিল, পশ্চিমে গঙ্গাসাগরের হুগলি নদী থেকে পূর্বে মীরসরাইয়ের ফেণী নদী পর্যন্ত। এই সমস্ত অঞ্চল, ঘন বাদাবনে আচ্ছাদিত ছিল উনিশ শতকের মধ্যভাগেও। মূলত ইংরেজ শাসনকাল থেকে, মনুষ্য অবিচারে এই বাদাবনের ক্রমশ সঙ্কোচনের পর্ব আরম্ভ হয়। আজ সুন্দরবনের চিরাচরিত বাদাবন অঞ্চল সীমিত হয়েছে পশ্চিমে সপ্তমুখী নদী থেকে পূর্বে বালেশ্বর নদ পর্যন্ত। সুন্দরবনের বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন হল, ৫ ভাগের প্রায় ৩ ভাগ বাংলাদেশে ও বাকি ২ ভাগ ভারতে। এই প্রবন্ধে মূলত যে বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হবে, তা হল — সুন্দরবনে বাদাবনের উদ্ভিদসমূহের অঞ্চল বিভাজন বা ক্ষেত্রবিন্যাস (Spatial Distribution of Vegetation in Sundarban)। ডেভিড প্রেনের ১৯০৩ সালের উদ্ভিদ প্রজাতির গণনা অনুযায়ী, সুন্দরবনের আনুমানিক উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা হল ৩৩৪, যা ২৪৫টা গণ (Genera)-এর অন্তর্ভুক্ত, যার কোনো নড়চড় আজও হয়নি। সুন্দরবনের বাদাবনের সব গাছগাছালি, সুন্দরবনের সর্বত্র সমান ভাবে পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় — সুন্দরবনের নাম যে গাছ থেকে এসেছে, সেই সুন্দরী গাছের দুটো প্রজাতি (Species) -এর ভারতের সুন্দরবনে দুষ্প্রাপ্যতা, কিন্তু বাংলাদেশের সুন্দরবনের পূর্বাংশে খুব সহজেই পাওয়া যায়। এই ক্ষেত্রবিন্যাসের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ। এই কারণগুলোর মধ্যে যেগুলো প্রধান, তা হল —

(১) নদনদীর উৎসের পার্থক্য: ভারতের সুন্দরবনের প্রধান নদনদীগুলো হল — সপ্তমুখী, ঠাকুরাণ, পিয়ালী, মাতলা, হোগল, গোমতী, বিদ্যা, দত্তপশুর, গোসাবা, গঁরাই, ইছামতী, রায়মঙ্গ, হরিণভাঙ্গা ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশের সুন্দরবনের প্রধান নদনদীগুলো হল — রায়মঙ্গল, মালঞ্চ, খোলপেটুয়া, আরপাঙ্গাসিয়া, সেলা, রূপসা, শিবসা, বালেশ্বর ইত্যাদি। ভারতের সুন্দরবনের মধ্যে একমাত্র ইছামতী-রায়মঙ্গল নদী ব্যবস্থাই গঙ্গা-পদ্মার সাথে সরাসরি যুক্ত, বাকি সব নদনদীগুলোর জন্ম, দুই ২৪ পরগণা জেলার জলাভূমিতে। তুলনামূলক ভাবে বাংলাদেশের সুন্দরবনের পূর্বাংশের নদনদীগুলো পদ্মা বা মেঘনার সাথে বেশি ভালোভাবে যুক্ত। অর্থাৎ ভারতের সুন্দরবনের নদনদীগুলোতে বরফ গলা মিষ্টিজলের সরবরাহ খুবই কম, অন্যদিকে বাংলাদেশের সুন্দরবনের পূর্বাংশের নদনদীগুলোতে মিষ্টিজলের সরবরাহ তুলনামূলক বেশি। ফলে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে সেই সব বাদাবন প্রজাতির সংখ্যা বেশি, যারা লবণাক্ত জলে টিকে থাকতে সক্ষম। যেমন —গেঁওয়া (Excoecaria agallocha)। অন্যদিকে সুন্দরবনের পূর্বাংশে রয়েছে মিষ্টিজলের গাছ। যেমন — সুন্দরী (Heritiera fomes এবং Heritiera littoralis)। (২) সুন্দরবন তথা বাংলার ভূতাত্ত্বিক গঠনশৈলী: ভারতীয় পাতের ভূতাত্ত্বিক হালচালের ফলে, বেঙ্গল বেসিনের ঝোঁক হল পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে। ফলত উত্তর ভারত থেকে বয়ে আসা নদীগুলোর জল ক্রমশ সরছে পূর্বে বাংলাদেশের দিকে। এর ফলে যেমন মিষ্টি জলের জোগান বাংলাদেশে বেশি যাচ্ছে, ঠিক তেমনি বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত জলের ক্রমশ উত্তরগামী আগ্রাসন তুলনামূলক কম। (৩) সুন্দরবনের ভূগোল: একাধিক নদনদী, খাল-খাঁড়ি, জোয়ার-ভাঁটার ফলে স্থলভাগের একাংশের নিয়মিত নিমজ্জিত হওয়া ও ফের উন্মুক্ত হওয়া, এইসব প্রাকৃতিক কার্যপ্রক্রিয়ার ফলেও, দ্বীপাঞ্চলে গাছগাছালির ঘনত্বে আঞ্চলিকতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়েছে।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবন এবং জীবন-জীবিকা

এই কারণগুলোর ফলে দেখা যাচ্ছে — (১) সুন্দরী গাছ (Heritiera fomes) -এর ঘনত্ব বাংলাদেশের সুন্দরবনের পূর্বাংশে, মূলত চাঁদপাই রেঞ্জে বেশি। যদিও, ভারতের সুন্দরবনের অধিকাংশ দ্বীপের মধ্যবর্তী ভাগগুলো এ বিষয়ে ভালো করে অধ্যয়নের অপেক্ষায় রয়েছে। মূলত দুর্গম অঞ্চল ও ব্যাঘ্রসংকুল হওয়ার কারণে এই দ্বীপগুলোর কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলো অবহেলিত রয়েই গেছে। এই অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টির জল জমে মিষ্টিজলের হ্রদ তৈরি হয়, যার আশেপাশে হয়তো ভবিষ্যতে কোনোদিন সুন্দরীর এই প্রজাতিটি পাওয়া গেলেও যেতে পারে‌। এই উদ্ভিদ বর্তমানে IUCN দ্বারা বিপন্ন (Endangered) প্রজাতির তকমা পেয়েছে। (২) সুন্দরী গাছ (Heritiera littoralis) তুলনামূলক ভাবে বেশী লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাই ভারতীয় সুন্দরবনের পূর্বতম অংশগুলোতে, কোথাও কোথাও এই প্রজাতির সুন্দরী গাছ পাওয়া যায়, যদিও এই সংখ্যাটা খুবই কম। (৩) গোলপাতা (Nypa fruticans) বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় মধ্য সুন্দরবন (ভারতের সুন্দরবনের পূর্বাংশ ও বাংলাদেশের সুন্দরবনের পশ্চিমাংশ) ও পূর্ব সুন্দরবনে। পশ্চিম সুন্দরবনে এই প্রজাতির প্রাপ্যতা খুবই কম। (৪) লবণাক্ত অঞ্চলের গাছগাছালি, যথা — গেঁওয়া (Excoecaria agallocha), গরান (Ceriops spp.), বাইন (Avicennia spp.)-দের মতো লবণাক্ততার প্রতি সহনশীল বা চরম সহনশীল গাছের ঘনত্ব সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে বেশি। সুন্দরবনের পূর্বাংশে এদের ঘনত্ব তুলনামূলক কম।

১৯০৩ সালে ইংরেজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডেভিড প্রেন সুন্দরবনের উদ্ভিদজগৎয়ের অধ্যয়নকালে, প্রশাসনিক ভাবে, তৎকালীন অবিভক্ত সুন্দরবনকে তিনটি জীব-ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন। যথা — (১) দক্ষিণের সমুদ্র সৈকত অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাংশ, যেখানকার প্রধান উদ্ভিদ হল বাদাবনের গাছগাছালি (২) মধ্যাংশ, যেখানকার মূল উদ্ভিদ হল সুন্দরীর পূর্বোক্ত দুই প্রজাতি (৩) উত্তর-পূর্বাংশের তৃণভূমি বেষ্টিত অঞ্চল। সুন্দরবনের কর্দমাক্ত সমতলে (Mudflats) মূলত গর্জন (Rhizophora spp.) ও তার সাথে যদুপালং (Sesuvium portulacastrum)পিকলগ্রাস (Salicornia brachiata) -এর সমষ্টি দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধানিঘাস (Oryza coarctata)-ও পাওয়া যায়।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সুন্দরবনের মাছ

সুন্দরবনে উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও তার অবস্থান (Spatial Distribution of Vegetation in Sundarban) বহুলাংশে প্রভাবিত হয় সমুদ্র, নদনদী ও খাল-খাঁড়ি দ্বারা। যথা : (১) নদীপাড়ের কর্দমাক্ত তীরবর্তী অঞ্চল: প্রধানত কেওড়া ও ওড়া (Sonneratia spp.)। (২) বড় নদীগুলোর তীরবর্তী অঞ্চল: প্রধানত গর্জন (Rhizophora spp.), গড়িয়া (Kandelia candel), ঝামটি গরান (Ceriops decandra), মঠ গরান (Ceriops tagal), কাঁকড়া (Bruguiera gymnorhiza)। (৩) স্বল্পদৈর্ঘ্যের খাল বা খাঁড়ির তীরবর্তী অঞ্চল: কেওড়া (Sonneratia spp.), পেয়ারা বাইন (Avicennia alba), ধুঁধুল (Xylocarpus granatum), খলসি (Aegiceras spp.), ডাকর (Cerbera manghas), গড়িয়া (Kandelia candel), করঞ্জ (Millettia pinnata), ভোলা (Hibiscus tiliaceus), চুলিয়া কাঁটা (Dalbergia spinosa), ঝামটি গরান (Ceriops decandra), কৃপা (Lumnitzera spp.), বাজৈ (Volkameria inermis), হেঁতাল (Phoenix paludosa), হিজল (Barringtonia spp.), গড়শিঙা (Dolichandrone spp.)। এছাড়াও কালীলতা (Derris spp.) ও বাওলে লতা বা পশুরলতা (Sarcolobus spp.) -এর মতো বেশ কিছু লতা (Climbers) রয়েছে। (৪) সংকীর্ণ খাল বা খাঁড়ি তীরবর্তী অঞ্চল: প্রধানত খলসি (Aegiceras spp.) ও লতা সুন্দরী (Brownlowia spp.)। (৫) সংকীর্ণতম খাল বা খাঁড়ির তীরবর্তী অঞ্চল: প্রধানত গোলপাতা (Nypa fruticans)।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : জৈবিক বৈচিত্র্য থেকে জীববৈচিত্র্য

মধ্যাংশের সুন্দরবনে হড়গোজা (Acanthus ilicifolius) ও কেয়াগাছের (Pandanus spp.) -এর সমষ্টি দেখতে পাওয়া যায়। তুলনামূলক উঁচু জমিতে সুন্দরী গাছের অরণ্য দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে জাত বাইন (Avicennia officinalis), কালা বাইন (Avicennia marina), গেঁওয়া (Excoecaria agallocha) ও সিঙাড়া (Cynometra spp.) ইত্যাদি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। জলা জায়গায় আমুর (Aglaia cucullata) ও পশুর (Xylocarpus moluccensis) পাওয়া যায়। গেঁওয়া গাছ সাধারণত বাদাবন ও সুন্দরীর জঙ্গলের মধ্যবর্তী ‘Transitional Vegetation’ হিসাবে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের প্রধান কয়েকটা লতা (Climbers) হল — কালীলতা (Derris spp.), দুধীলতা (Finlaysonia obovata) ও সিঙাড়া (Cynometra spp.)। সুন্দরবনের তৃণভূমি অঞ্চলের প্রধান কয়েকটা তৃণজাতীয় প্রজাতি হল — উলুঘাস (Imperata cylindrica), কাশফুল (Saccharum spontaneum), জলাঘাস (Scirpus spp.) ও মূলাঘাস (Myriostachya wightiana)। সুন্দরবনের কয়েকটি পরগাছা অর্কিড (Epiphytic Orchids) হল — Bulbophyllum roxburghii ও Oberonia gammei। সুন্দরবনের প্রধান ফার্ণ হল — হোদো (Acrostichum aureum)

তবে মনুষ্যজনিত কারণে, সুন্দরবনের চিরাচরিত উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের সমষ্টি বিগত কয়েক দশকে বেশ খানিকটা বদলে গেছে‌। এই বদলে যাওয়া পরিস্থিতি কিন্তু বেশ চিন্তাজনক। কারণ বাদাবনের গোড়াই কিন্তু বাদাবনের টিকে থাকার প্রধান অস্ত্র। বাদাবনের শিকড়বাকড়ের গভীর জালিকা, কেবল সুন্দরবন নয়, পুরো বাংলার পরিত্রাণের কর্তা।

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]

লেখকঃ- পাভেল ঘোষ (দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান)
তথ্যসূত্রঃ- Mapping Long-term changes in Mangrove species composition and distribution in the Sundarbans (Manoj Kumer Ghosh, Lalit Kumar and Chandan Roy) ; Flora of the Sundribuns (David Prain, 1903) ; Studies in Botany (Volume 2)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : দক্ষিণের ডুয়ার্স – ঝালুয়ারবেড়

7 thoughts on “Spatial Distribution of Vegetation in Sundarban

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!