Topic – Ecological Footprint
প্রসঙ্গ – বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Topic – Ecological Footprint । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

সুন্দর এই পৃথিবীতে আমরা সবাই অনেকদিন বাঁচতে চাই। ধনী হোক বা গরীব — বেঁচে থাকার ইচ্ছা সবার থাকে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। জ্ঞানচর্চার পরিচিত বিষয়গুলির মধ্যেও গবেষণার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে চলেছে। তারই মধ্যে বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন (Ecological Footprint) একটি জনপ্রিয় চর্চাক্ষেত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পৃথিবীর আদি ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, বায়ুমন্ডল, শিলামন্ডল ও বারিমন্ডলের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন ঘটেছে। এই ক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। (Topic – Ecological Footprint)
পদচিহ্ন বা পদাঙ্ক শব্দটি একটি পরিমাপ সাধনী (Accounting Tool) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রকৃতির চাহিদা গণনার জন্য একটি পরিমাপ সাধনী হিসেবে শব্দটি পদাঙ্ক নামে পরিচিত। মানুষ সমস্ত জীবের তুলনায় উন্নত ও বুদ্ধিমান প্রাণী। প্রতিটি জীব প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করার এবং প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলছে কিছু মানুষ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে উন্নয়নের নামে বিশ্বকে দ্রুতই বসবাসের অযোগ্য করে ফেলা হচ্ছে ; অথচ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সবুজময় ভুবন। তাই পৃথিবীরূপ বাস্তুতন্ত্র থেকে মানুষের চাহিদা পূরণ এবং সেই চাহিদা পূরণের ফলে বাস্তুতন্ত্রে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা পূরণের ক্ষমতার পরিমাপকে পরিবেশগত বা বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন বা ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট বলে। অর্থাৎ মানব সমাজের বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য যে সব প্রকৃতি সৃষ্ট জৈবিক ভাবে উৎপাদনশীল সম্পদের প্রয়োজন, যেমন : জমি, সমুদ্র, হ্রদ, নদী, পর্বত প্রভৃতি পরিমাপ করার একটি কৌশল হল বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন। ওয়াকারনাগেল (Wackernagel) এবং রিজ্ (Rees) (১৯৯৬) -এর মতে, ‘Ecological Footprint is primarily a measure of human appropriation of natural resources, and is defined as the area of land (and water) that would be required to sustain indefinitely a human population defined in terms of providing all energy/material resources consumed and absorbing all waste discharged’। অর্থাৎ, ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট হল প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের মানব গ্রাসকরণের একটি পরিমাপ এবং এটিকে স্থল (এবং জল) এলাকা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা সমস্ত ভোগ্য শক্তি/বস্তু সম্পদের প্রদান এবং নিঃসৃত সমস্ত বর্জ্য শোষণের পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা অনির্দিষ্টকালের জন্য একটি মানব জনসংখ্যাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হবে।
ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট পরিমাপ করা বাস্তুবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, কারণ পরিবেশগত স্থায়িত্ব মূল্যায়নের এটি একটি মূল পদ্ধতি। সুতরাং ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট হল মানব দ্বারা গ্রহীত সম্পদের পরিমাণ পরিমাপ ও মানব কর্তৃক উৎপন্ন বর্জ্য শোষণ করার পদ্ধতি। এটি আসলে মানুষের প্রয়োজন ও উপস্থিত সম্পদের মধ্যে তুলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ম্যাথিজ ওয়াকারনাগেল এবং উইলিয়াম রিজ্ ১৯৯০ -এর দশকের শুরুর দিকে বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন (Ecological Footprint) -এর প্রথম ধারণা ও মূল্যায়ন প্রদান করেন। প্রাথমিকভাবে তাঁরা এই ধারণাটির নাম দিয়েছিলেন ‘Appropriated Carrying Capacity’ (অর্থাৎ যথাযথ বহন ক্ষমতা)। এবিষয়ে প্রথম পুঁথিগত প্রকাশনা রচনা করেন উইলিয়াম রিজ্, ১৯৯২ সালে। পরে ধারণাটিকে আরও সুবোধ্য করতে উইলিয়াম রিজ্ একজন কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জীবাশ্ম উদ্যান
ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্টের উদ্দেশ্যগুলি হল : (১) মনুষ্য চাহিদার সাথে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের ক্ষমতার তুলনা। (২) মানুষ ও শিল্পবর্জ্য দ্বারা পরিবেশের ক্ষতির ব্যাখ্যা দেওয়া। (৩) স্থিতিশীল উন্নয়নের পন্থা বের করা। (৪) পরিকল্পনাকারীদের দূষণ রোধের উপায় নির্ধারণে সাহায্য করা। (৫) বাস্তুতন্ত্রের ধারণ ক্ষমতার ধারাবাহিক তথ্যসংগ্রহ করা। (৬) অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য সম্পদের সঠিক বণ্টনে সাহায্য করা। বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন আমাদের করে প্রভাব পরিমাপ করার একটি সহজ উপায় প্রদান করে, যা কোনও ব্যক্তি, একটি সম্প্রদায় বা একটি দেশ এই গ্রহে যে চিহ্নটি রেখে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যা ক্রমবর্ধমান একটি প্রভাব এবং আমরা শুধুমাত্র উৎপাদন এবং সংস্থান গ্রহণের উপায়গুলি দ্রুত বদলাতে পারলেই, তা পরিবর্তন করতে পারি। ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট একটি সাধারণ মেট্রিক, কিন্তু অনন্য। এটি শুধুমাত্র আমাদের গ্রহের বাস্তুতন্ত্রের উপর মানবতার চাহিদা পরিমাপ করে না, তবে এটি প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তঃসম্পর্কিত চাপ বোঝার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন বৈশ্বিক হেক্টর (gha) এবং বৈশ্বিক হেক্টর/মাথাপিছু (gha/pc) এককে পরিমাপ করা হয়। ‘বৈশ্বিক হেক্টর’ জৈব স্বক্ষমতা পরিমাপ করে এবং নির্দিষ্ট বছরে সমস্ত জৈবিকভাবে উৎপাদনশীল এলাকার গড় উৎপাদনশীলতা পরিমাপ করে। ‘বৈশ্বিক হেক্টর/মাথাপিছু’ বলতে বোঝায় জনপ্রতি জৈবিকভাবে উৎপাদনশীল জমি এবং জলের পরিমাণ ব্যয়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী (১০.৭ gha/pc), কাতার (১০.৫ ghc/pc) এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র (৮.০ ghc/pc) হল সেইসব দেশ, যাদের মাথাপিছু ভারী পরিবেশগত পদচিহ্ন রয়েছে, অর্থাৎ তারা বিশ্বব্যাপী স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। একজন জার্মানের গড় বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন ৫.১ ghc/pc, একজন ব্রাজিলিয়ানের ২.৯, একজন চীনার ২.২, একজন জাপানির ৪.৭, একজন রাশিয়ানের ৪.৪, একজন পর্তুগীজের ৪.৫, একজন ভারতীয়ের ০.৯ gha/pc। বৈশ্বিক গড় বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন হল ২.৭ ghc/pc। যদি গ্রহের সমগ্র জনসংখ্যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি জীবনধারা গ্রহণ করে, তবে আমাদের চারটি পৃথিবীর প্রয়োজন হবে ; কারণ একটি পৃথিবীর জৈব স্বক্ষমতা সেই জনসংখ্যার চাহিদা বজায় রাখার জন্য অপর্যাপ্ত।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ইয়েমেনের নরকের কূপ
ভারতে বিশ্বের তৃতীয় ভারী পরিবেশগত পদচিহ্ন রয়েছে এবং এর সম্পদের ব্যবহার তার জৈব স্বক্ষমতার দ্বিগুণ। ভারতের মোট পরিবেশগত পদচিহ্ন ভারী, কারণ এর জনসংখ্যা ১.৪ বিলিয়নেরও বেশি, যা বিশ্ব জনসংখ্যার এক ষষ্ঠাংশ। তা সত্ত্বেও, অন্যদের তুলনায় ভারত এমন একটি দেশ, যার মধ্যে একটি হালকা পরিবেশগত পদচিহ্ন রয়েছে। একজন ভারতীয়র গড় পরিবেশগত পদচিহ্ন একজন মার্কিন নাগরিকের চেয়ে নয় গুণ হালকা, বৈশ্বিক গড় পরিবেশগত পদচিহ্নের চেয়ে তিনগুণ হালকা। অন্যান্য সমাজের সাথে তুলনা দেখা যায় যে, ভারত মাথাপিছু বৈশ্বিক হেক্টরে হালকা পরিবেশগত পদচিহ্নের দেশগুলির মধ্যে একটি। এভাবে, গড় ভারতীয়দের একটি পরিবেশগত কৃতিত্ব রয়েছে, কারণ এটি বিশ্বব্যাপী স্থায়িত্বকে হুমকির জন্য খুব কম অবদান রাখে।
সরলীকরণের মাধ্যমে স্থিতিশীল উন্নয়নের ধারণাকে আরও জনপ্রিয় করার জন্য বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা জনসাধারণকে আমাদের গ্রহের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ করে৷ আজ আমরা বিশ্বব্যাপী (বৈশ্বিক), জাতীয় এবং স্থানীয় পরিবেশগত পদচিহ্নের গণনা জানি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা ছাড়াও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহণ ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক পণ্য প্রভৃতির সংস্থান করতে পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে ভাববার সময় ও সদিচ্ছা আমাদের মধ্যে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এইরূপ পরিস্থিতিতে মানুষের দূরদর্শিতাকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিগতভাবে কাজে লাগাতে হবে ; দুঃসময় ঘনিয়ে আসার আগেই মানুষ সতর্ক হতে পারে এবং পরিবেশ ও সমাজকে আশু বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্নের প্রভাব মূল্যায়নের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান। (Topic – Ecological Footprint)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- ওবাইদুর রহমান (লালগোলা, মুর্শিদাবাদ)
তথ্যসূত্রঃ- Environment Shankar IAS Academy (9th Edition) ; পরিবেশ ভূগোলের রূপরেখা (কল্যাণী পাবলিশার্স), ISC Geography (Class XII) – D.R. Khullar – Kalyani Publishers ; Wikipedia ; Encyclopedia of Ecology ; Encyclopaedia Britannica ; IOP Science Conference ; Global Footprint Network
Pingback: Seasonal Diversity of West Bengal - ভূগোলিকা-Bhugolika
Good…
Very Nice
ধন্যবাদ ❤️
Pingback: Gender Inequality & Women's Rights - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Padma River's Hilsa of Murshidabad - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Insectivorous Plant Sundews - ভূগোলিকা-Bhugolika