History of India in Geographical Context
ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে ভারতের ইতিহাস
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : History of India in Geographical Context । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

‘All history must be treated geographically and all geography must be treated historically.’
– গ্রিক পন্ডিত হেরোডটাস (৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
‘ইতিহাসের জনক’ হেরোডোটাস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে তাঁর লেখায় বলেন, ‘সমস্ত ইতিহাসকে ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে এবং সমস্ত ভৌগোলিক বিষয়কে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা উচিত’। তাঁর মতে, সমাজের সামাজিক ইতিহাস তার চারপাশে ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইতিহাস ও ভূগোলের মধ্যে এই একনিষ্ঠ মেলবন্ধন ভারতবর্ষের সভ্যতার ক্রমবিকাশে যথাযথভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারতবর্ষ একটি উপমহাদেশ (Subcontinent) রূপে বিবেচিত হয় ; যার উত্তরে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা, মধ্যভাগে নদীবিধৌত সমভূমি, পশ্চিমে মরুভূমি এবং দক্ষিণে মালভূমি তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর ভারতবর্ষের ইতিহাসও বৈচিত্র্যময়, যা বিভিন্ন সভ্যতা-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক স্বতন্ত্র সভ্যতার চয়ন করেছে। (History of India in Geographical Context)
সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শনরূপে হরপ্পা সভ্যতার বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ভৌগোলিক অবস্থান প্রধান নিয়ন্ত্রক। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা ভারতবর্ষ মূলত নদীমাতৃক। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার থেকে শুরু করে উন্নত শহরের বিকাশ এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। যেমন উত্তর ভারতে নদীর উপকূলে ষোড়শ মহাজনপদ বিস্তার লাভ করে, অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণা, গোদাবরী, কাবেরী, তুঙ্গভদ্রা নদী অববাহিকা অঞ্চলেই প্রাচীন চোল, চের, চালুক্য, পান্ড্য, পল্লব প্রভৃতি রাজ্য গড়ে উঠেছে। নদী তীরেই মানুষ প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। নদী তার উপত্যকার উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং উর্বর ভূমিতে কৃষির বিকাশ ঘটে, যা কোনো রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সহায়তা করে। তাই এই উপত্যকা দখলের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজশক্তি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। বৈদিক যুগের সূচনায় ঋগবেদে উল্লিখিত সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে ইরাবতী নদীর তীরে ‘দশরাজার যুদ্ধ’ কিংবা চতুর্দশ শতাব্দীতে রায়চুর দোয়াব দখলে বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্যের দীর্ঘ সময় ধরে চলা দ্বন্দ্ব সবই নদী অববাহিকা কেন্দ্র করে। অন্যদিকে, নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই সকল উর্বর ভূমিতে সম্পদের প্রাচুর্যতা ভারতীয় জনগণের চারিত্রিক গঠনেও প্রভাব ফেলেছে। দেশে প্রচুর কৃষি সম্পদ এবং অন্যান্য সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয়রা সহজ জীবনযাপন করেছে। ভারতীয় মাটির এই সমৃদ্ধি এবং উর্বরতা জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট হওয়ায়, শিল্প ও সাহিত্যের প্রচারে তারা মনোনিবেশ করতে পেরেছিল। বৈদিক সাহিত্য আমাদের দেশের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। চারু ও কারুশিল্পও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। মৌর্য ও গুপ্ত যুগে আমরা স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা ইত্যাদিতে শ্রেষ্ঠ নিদর্শনের সন্ধান পাই। তক্ষশীলা এবং নালন্দার দুই বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ও দেশের উত্তরাঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদেরও আকৃষ্ট করে। একপ্রকার বলা যায়, ভারতের ইতিহাসের রূপরেখা নদীর গতিপথ ধরে আবর্তিত হয়েছে।
হিমালয় পর্বতমালা ভারতবর্ষের সভ্যতার বিবর্তনের অন্যতম কান্ডারী। ঐতিহাসিক কে. এম. পানিক্কর ভারতবর্ষকে ‘হিমালয়ের দান’ (Gift of Himalaya) বলেছেন। ভারতের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে সুবিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালা প্রহরীর মতো দন্ডায়মান থেকে বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করছে। বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ভারতে তাই স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। আবার, এই হিমালয়ের সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে শক, হুণ, মোঘল, পাঠান ভারতে প্রবেশ করেছে। গোমাল পাস, খাইবার পাস ভারতবর্ষকে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করে, যার ফলে এই সকল গিরিপথ দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইন্দো-ইরানীয়, গ্রিক, পার্থিয়ান, শক, হুণ, মোঘল, পাঠান ভারতে প্রবেশ করেছে। এইসব বহিরাগত জাতি সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। উত্তর ভারতের সংমিশ্রিত সংস্কৃতির পিছনে হিমালয়ের এই সকল গিরিপথের ভূমিকা প্রধান। হিমালয় একাধারে উত্তরের শৈত্যপ্রবাহকে প্রতিরোধ করছে, আবার মৌসুমি বায়ুর গতিরোধ করে বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করছে। ফলত, এমন এক প্রীতিকর ঋতু বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে, যা সমগ্র ভারতে কৃষি, শিল্পের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছে। হিমালয়ের থেকে সৃষ্ট বরফগলা জলে পুষ্ট নদীগুলি সমগ্র উত্তর ভারতকে পৃথিবীর অন্যতম উর্বর কৃষিক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : স্ত্রীরোগের আঁতুড়ঘর সুন্দরবন
উত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটলেও, দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি বহুক্ষেত্রে স্বতন্ত্র এবং দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে উত্তর ভারতের সংস্কৃতি সাদৃশ্য প্রায় নেই। এই বৈচিত্র্যের মূল কারণ হল ভারতের মধ্যভাগে বিন্ধ্যপর্বতের অবস্থান, যা ভারতবর্ষকে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যে বিভক্ত করেছে। উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের কোনো রাজশক্তিই দুর্গম এই পর্বত পেরিয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন বা সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়নি। ফলত, ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন গড়ে ওঠেনি। তাই একই দেশে দুটি সমান্তরাল ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। বিন্ধ্য পর্বতের অবস্থান দক্ষিণ ভারতকে মধ্য এশিয়ার আক্রমণ থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন রেখেছে। কিন্তু তিনদিকে সমুদ্রবেষ্টিত দক্ষিণ ভারত দীর্ঘদিন বিদেশি আক্রমণমুক্ত ছিল না। বলা যায়, ভারতীয় উপদ্বীপের ভাগ্য পরিবর্তনে সমুদ্রের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সমুদ্র তীরে গড়ে ওঠা বন্দর থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে। হরপ্পা সভ্যতায় এই বন্দরের প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। গুজরাটের লোথাল হরপ্পা সভ্যতার প্রধান বন্দর শহর, যার মাধ্যমে সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে বাণিজ্যের নিদর্শন রয়েছে। কালিকট, মসলিপট্টম, গোয়া প্রভৃতি বন্দর থেকে আফ্রিকার ও আরবের দেশগুলির সাথে বাণিজ্য ভারতীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করে, যা পরবর্তীতে আরব বণিকদের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছায় এবং ভারতীয় পণ্যের সন্ধানে ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে। ভাস্কো-ডা-গামার পথ অনুসরণ করে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি — একাধারে সকল বিদেশি কোম্পানি ভারতের প্রবেশ করে এবং ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে।
দেশের জলবায়ুও ভারতীয় ইতিহাসের গতিপথে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। শীতল অঞ্চল থেকে বিদেশী আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে ভারতীয়দের ব্যর্থতার জন্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু ব্যাপকভাবে দায়ী। আরামপ্রদ জলবায়ু মানুষকে অলস করে তোলে। পরিবেশগত প্রতিকূলতা মানুষকে সংগ্রাম করতে শেখায়। লক্ষ্য করা যায়, উত্তর ভারতের বৃষ্টির প্রাপ্যতা সম্পদের যে প্রাচুর্যতা ঘটিয়েছে, তার ফলে ভারতীয়রা কখনো নতুন স্থান দখলের কিংবা সম্পদ আহরণের জন্য অন্য দেশ আক্রমণের চেষ্টা করেনি। অপরপক্ষে, শীতপ্রধান ইউরোপীয় দেশগুলি এবং মরুপ্রায় আরবীয় দেশের সম্পদের অভাব তাদের নতুন দেশ সন্ধানে প্রবৃত্ত করেছে। তাই ভারতের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বারবার ভারতবর্ষকে আক্রমণ করেছে, লুন্ঠন করেছে। আবার লক্ষ্য করার বিষয়, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনে। যেমন বলা যায়, দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চল মহারাষ্ট্র ও রাজপুতানার মানুষকে বলিষ্ঠ নির্ভীক করে তুলেছিল। আবার সমুদ্র সান্নিধ্যের জন্য উপকূলীয় রাজ্যগুলি নৌবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করতে পেরেছিল। এই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণকে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল এবং তারা যোদ্ধার গুণাবলী আয়ত্ত করতে পেরেছিল। তাই তারা তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার সমস্ত প্রচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করেছিল। কঙ্কন উপকূলে পশ্চিমঘাট পর্বতের বন্ধুরতায় বড়ো হয়ে ওঠা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ কিংবা মরুময় রাজপুতানার রাণা প্রতাপ সিংহ তাই গেরিলা রণকৌশল রপ্ত সেনাবাহিনী গঠন করতে পেরেছিলেন এবং দিল্লির বিদেশি শাসকদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জীবাশ্ম উদ্যান
পশ্চিমে থর মরুভূমি, যা সিন্ধু উপত্যকার সমভূমি এবং গঙ্গার মাঝখানে অবস্থিত, তা ভারতীয় ইতিহাসের গতিপথকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। যেহেতু থর মরুভূমি এই দুটি অঞ্চলকে দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত করেছে, ভারতীয় প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটি উত্তর-পশ্চিম পর্বত গিরিপথ দিয়ে ভারতে আসা বিদেশি হানাদারদের ব্যাপকভাবে উপকৃত করেছিল। সিংহভাগ অঞ্চল এই বিশাল মরুভূমি দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় উত্তর ভারতের সম্পদের রক্ষায় যথার্থ একত্রিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। মরুভূমির প্রতিকূলতা ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্তকে দুর্বল করেছে, যার ফলে মহম্মদ ঘোরী, সুলতান মামুদের মতো হানাদাররা একাধিক বার ভারতীয় সম্পদ লুণ্ঠন করেছে।
সুতরাং সার্বিক পর্যালোচনা থেকে বলা যায়, ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু ভারতবর্ষকে প্রভূত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ করেছে। উর্বর শস্য-শ্যামলা নদী অববাহিকা, ঊষর মরুভূমি, তুষারাবৃত পর্বত, খনিজ সমৃদ্ধ মালভূমি, সুদীর্ঘ বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত — একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে ওঠার সমস্ত উপাদান ভারতবর্ষে রয়েছে। তাই, সুপ্রাচীন কাল ধরে বিভিন্ন শক্তি এই দেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। গ্রিক, শক, হুণ, কুষাণ, মোঘল, পাঠান, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ ফরাসি — একাধারে সকল বিদেশি শক্তি ভারতের সম্পদকে হস্তগত করতে চেয়েছে। আর তাদের সম্পদ আহরণের প্রচেষ্টা ভারতের ইতিহাসের রূপরেখা অঙ্কন করেছে। (History of India in Geographical Context)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকাঃ- রিনি ঘোষ (নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- ভূগোল চিন্তা ও দর্শন (ড. রামকৃষ্ণ মাইতি ও ড. মৌমিতা মাইতি) ; ভারত ও আধুনিক পৃথিবী (দেবযানী গঙ্গোপাধ্যায়, কমলেন্দু বিকাশ ভট্টাচার্য ও সৈয়দ আবিদ আলি)
Pingback: Topic - Ecological Footprint - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Insectivorous Plant Sundews - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Seasonal Diversity of West Bengal - ভূগোলিকা-Bhugolika
Very Nice