Only Fossil Park in West Bengal
পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জীবাশ্ম উদ্যান
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Only Fossil Park in West Bengal । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জীবাশ্ম উদ্যান ‘আমখই কাষ্ঠ জীবাশ্ম উদ্যান’ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

পর্যটন তথা ভূগোল অনুরাগী মানুষের এক নতুন গন্তব্য বীরভূম জেলার ইলামবাজারের নিকট আমখই কাষ্ঠ জীবাশ্ম উদ্যান (Amkhoi Wood Fossil Park) বা আমখই প্রস্তরীভূত অরণ্য উদ্যান। ফসিল অর্থাৎ জীবাশ্ম নিয়ে আমাদের সকলেরই কম-বেশি আগ্রহ রয়েছে। কাষ্ঠ জীবাশ্ম (Wood Fossil) সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে আপনাকে একবার আসতেই হবে ইলামবাজার সন্নিকট আমখই গ্রামের এই ফসিল পার্কে। বোলপুর থেকে ইলামবাজার যাওয়ার রাস্তায় বোলপুর থেকে মাত্র ১২ কিমি এবং ইলামবাজার থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে ধল্লা বাস স্টপ। সেখান থেকে শাল জঙ্গলের বুক চিরে চলে যাওয়া লাল মাটির পথ বেয়ে প্রায় ২ কিমি গেলেই পৌঁছে যাবেন আমখই উড ফসিল পার্কে (Only Fossil Park in West Bengal)।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দপ্তরের উদ্যোগে এই ফসিল পার্ক গড়ে উঠেছে। ২০০৬ সালে আমখই গ্রামে একটি পুকুর খননের সময় মাটির তলায় ১৪ ফুট নিচে স্তরে স্তরে এই জীবাশ্মগুলি সাজানো অবস্থায় পাওয়া যায়। এগুলি সবগুলিই উদ্ভিদ জীবাশ্ম। প্রাপ্ত জীবাশ্মগুলি পরীক্ষা করার জন্য পাঠানো হয় লখনউয়ে বীরবল সাহানি ইনস্টিটিউটে। বিজ্ঞানীদের মতে, জীবাশ্মগুলির বয়স প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি বছর (১৫-২০ মিলিয়ন বছর)। এরপরই বীরভূম বন বিভাগ এগুলি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭-১৮ বর্ষে গড়ে ওঠে আমখই কাষ্ঠ জীবাশ্ম উদ্যান। প্রায় ১০ হেক্টর এলাকা জুড়ে এই ফসিল পার্কটি বিস্তৃত রয়েছে। কিংশুক সরকার ও রেশমি বাগচি নামে দুই শিল্পী এই পার্কটি সাজিয়ে তোলেন। এটিই হল পশ্চিমবঙ্গের প্রথম এবং একমাত্র জীবাশ্ম উদ্যান (First & Only Fossil Park in West Bengal)।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্প
এখন প্রশ্ন হল, জীবাশ্ম কি? জীবাশ্ম হল উদ্ভিদ বা প্রাণীর প্রস্তুরীভূত দেহ বা দেহের ছাপ। সাধারণত পাললিক শিলা সৃষ্টির সময় উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহ পলি, বালির সাথে চাপা পড়ে গিয়ে কালক্রমে চাপ ও তাপে জীবাশ্মে পরিণত হয়। এধরনের কোনো নমুনা ১০ হাজার বছরের বেশি পুরানো হলে, তবেই তাকে জীবাশ্ম বলা হয়। আমখই উড ফসিল পার্কের প্রদর্শন ফলক (Display Board) থেকে জানা যায়, আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এই কাষ্ঠ জীবাশ্মর সৃষ্টি হয়। যেমন ভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম অনুকূল তাপমাত্রা ও চাপে উদ্ভিজ্জ পদার্থ থেকে তৈরি হয়, তেমন ভাবে অশ্মীকরণের অপরিহার্য কারণে উদ্ভিদ জীবাশ্ম পলির স্তর, অক্সিজেন, প্রাণীর দ্বারা বিভিন্ন ক্ষয় থেকে চাপা পড়ে প্রস্তরীভূত হয়। ভূ-আলোড়নের ফলে উদ্ভিদের কান্ড পলির নিচে চাপা পড়ে যায়। যখন মাটির নিচের জল পলিস্তর ভেদ করে দ্রবীভূত কঠিন বস্তুর (গাছের কান্ড) সংস্পর্শে এসে সিলিকা, ক্যালসাইট, ধাতুমাক্ষিক বা উপল ও অন্যান্য অজৈব পদার্থ বা খনিজের সংগঠনকে অপরিবর্তিত রাখে, তখন এই প্রক্রিয়াকে মিনারেলাইশন বা খনিজীকরণ বলে। এই প্রক্রিয়ায় সমগ্র কান্ড বা উদ্ভিদের অংশবিশেষ প্রস্তরীভূত হয়, যা পেট্রিফায়েড উড (Petrified Wood) বা প্রস্তরীভূত কাষ্ঠ নামে পরিচিত। গ্রিক শব্দ পেট্রো কথার অর্থ হল পাথর। এই প্রক্রিয়ার ফলে উদ্ভিদের কান্ডের অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক সেলুলজ গঠনের কোন পরিবর্তন ঘটে না। এভাবে কাষ্ঠ জীবাশ্মের সৃষ্টি হয়।
প্রস্তরীভূত কাষ্ঠ প্রধানত অশ্মীভূত কাষ্ঠ, যেখানে জৈব পদার্থ খনিজ পদার্থ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এধরনের কাষ্ঠ জীবাশ্ম থেকে ওই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থা, শিলার গঠন, বয়স ও জলবায়ু সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। প্রস্তরীভূত কাষ্ঠ অনেকসময় মৃদু উজ্জ্বল ও নানা বর্ণে সজ্জিত হয়। বিভিন্ন খনিজ পদার্থ প্রস্তরীভূত কাষ্ঠের বর্ণ নির্ধারণ করে। যেমন : কোয়ার্টজের উপস্থিতিতে বর্ণহীন ; কার্বনের উপস্থিতিতে কালো ; ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ও তামার উপস্থিতিতে সবুজ/নীল ; ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতিতে কমলা/গোলাপি ; ম্যাঙ্গানিজের অক্সাইডের উপস্থিতিতে কালো/হলুদ। প্রস্তরীভূত কাষ্ঠ মূল্যবান পাথর হিসেবে, মণি ব্যবসাতে, ভাস্কর্য হিসেবে, অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানের যে শাখায় কাষ্ঠ জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা করা হয়, তা প্যালিওজাইলোলজি (Paleoxylology) নামে পরিচিত। তাই কাষ্ঠ জীবাশ্ম নিঃসন্দেহে ভূগোল চর্চার একটা মানদন্ড হতে পারে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : আদিবাসী উন্নয়নে সিসল চাষ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আমখই-তে পাওয়া জীবাশ্মগুলি সপুষ্পক উদ্ভিদ (অ্যাঞ্জিওস্পার্ম)-এর জীবাশ্ম। এদের প্রতি ঘন মিটারের ওজন তিন থেকে চার টন। আজ থেকে দেড়-দুই কোটি বছর আগেকার মায়োসিন যুগের শেষভাগে এদের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। এই অঞ্চল অতীতে যে সুবিশাল বনভূমির অংশ ছিল, এই জীবাশ্মগুলি তারই সাক্ষ্য বহন করে। এ বিষয়ে ভূতাত্ত্বিক গবেষক উর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এই জীবাশ্ম থেকে অনুমান করা যেতেই পারে যে, অতীতে এই এলাকায় সুবিশাল বনভূমি ছিল, যার অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেয় এই জীবাশ্ম’। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা ছাড়াও, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতে এধরনের কাষ্ঠ জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। অনুমান, অতীত কালে রাজমহল পাহাড় ও ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে নদীর বন্যায় ভেসে এসে রাঢ় অঞ্চলে কাদা ও বালি চাপা পড়ে প্রস্তরীভূত অরণ্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া, কিছু গাছ এই অতীত অরণ্যে ছিল, যাদের কিছু অংশ দক্ষিণবঙ্গে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন এবং বর্তমানে ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, মায়ানমার ও মালয়েশিয়ার অরণ্যে দেখা যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দিপটেরকর্তসেটা, আনকর্ডয়াসেতা, কমবরেটাসেতা ও লেগামিনোসা।
ভারতের মাত্র কয়েকটি স্থানেই এধরনের এই উড ফসিল সংরক্ষিত রয়েছে। যেমন : তামিলনাডুর থিরুকুরাই (দুই কোটি বছরের পুরানো), রাজস্থানের জয়সলমীর (১৮ কোটি বছরের পুরানো), গুজরাটের ঢোলাভিরা (১৮ কোটি ৭০ লক্ষ বছরের পুরানো)। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র কাষ্ঠ জীবাশ্ম সংরক্ষিত রয়েছে বীরভূম জেলার আমখই উড ফসিল পার্কে। আমখই উড ফসিল পার্ক বুধবার বাদে প্রতিদিন খোলা থাকে, সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৪ টা অবদি। প্রবেশ মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জনপ্রতি ১০ টাকা, ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জনপ্রতি ৫ টাকা (পাঁচ বছরের নিচে যারা, তাদের প্রবেশ মূল্য লাগেনা) এবং ছাত্রছাত্রীদের জনপ্রতি ৫ টাকা (পরিচয়পত্র আবশ্যক)। তবে, শুধু এ রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে নয়, এই ফসিল পার্ক আগামী দিনে ভূগোল চর্চার কেন্দ্র হিসেবে জায়গা করে নিক।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- সঞ্জয় দে (কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান)
তথ্যসূত্রঃ- The Telegraph ; এই সময় ; লেখক কর্তৃক আমখই উড ফসিল পার্কে সাম্প্রতিক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং আমখই উড ফসিল পার্কের প্রদর্শন ফলক
Pingback: Well of Hell of Yemen - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Topic - Ecological Footprint - ভূগোলিকা-Bhugolika
Nice
Interesting
Pingback: History of India in Geographical Context - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Hansuli Bank - Literature & Geography - ভূগোলিকা-Bhugolika