Banbibi – Goddess of Sundarban
সুন্দরবনের দেবী বনবিবি
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Banbibi – Goddess of Sundarban । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সুন্দরবনের দেবী বনবিবি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

সুন্দরবনের মানুষ আজও প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের প্রকৃতি যেমন অপরূপ সৌন্দর্যের, তেমনই সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে কত বিভীষিকা। বাদাবনের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড়ো বিভীষিকা ‘বাঘ’ — রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ; সুন্দরবনের লৌকিক পরিসরে যিনি ‘দক্ষিণ রায়’ (রায়মণি) নামে পরিচিত। আর বাঘের হাত থেকে সুন্দরবনের তামাম বনজীবী মানুষদের রক্ষাকর্ত্রী হলেন ‘বনবিবি’। তিনি ভারত ও বাংলাদেশে বিস্তৃত অখন্ড সুন্দরবনের ‘গার্ডিয়ান স্পিরিট’ ; সুন্দরবনে মৌয়াল (মধু সংগ্রাহক), কাঠুরে, বাওয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের পরম আস্থার প্রতীক। বনবিবি একই সাথে সুন্দরবনের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের উপাস্য শক্তি। তিনি হিন্দুধর্মের দেবী ও ইসলাম ধর্মের পিরানি রূপে পূজিত হন। হিন্দু শাস্ত্রমতে তিনি হলেন বনের দেবী এবং বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী, বনচন্ডী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত। আবার, ইসলাম ধর্মমতে, ইব্রাহিম (মতান্তরে বেরাহিম) নামক এক সুফি ফকিরের কন্যা হলেন বনবিবি। (Banbibi – Goddess of Sundarban)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : এশিয়ার পরিষ্কারতম নদী ডাউকি
বনবিবি সম্পর্কে একাধিক কিংবদন্তী কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। একটি কাহিনী অনুসারে, ইব্রাহিম ফকিরের দ্বিতীয় স্ত্রী গুলানবিবি গর্ভবতী হলে প্রথম স্ত্রী ফুলবিবির ইচ্ছে পূরণের শর্তে গুলানবিবিকে জঙ্গলে নির্বাসিত করা হয়। সেখানেই কন্যা বনবিবি ও পুত্র শাহ জঙ্গলিকে জন্ম দিয়ে গুলানবিবি মারা যান। জঙ্গলের পশুপাখিই তাদের বড়ো করে তোলে। পরে ইব্রাহিম প্রথমে শাহ জঙ্গলি ও পরে বনবিবিকে জঙ্গল থেকে মক্কাতে নিয়ে যান। এদিকে নিষ্ঠুর দক্ষিণ রায়ের অত্যাচারে সুন্দরবনের সকল প্রাণী অতিষ্ঠ হলে, দৈবাদেশে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলি সুন্দরবনে ফিরে আসেন। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বনবিবি আর শাহ জঙ্গলির সাথে দীর্ঘযুদ্ধে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়। পরবর্তীতে, সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনকর্ত্রী হন বনবিবি আর দক্ষিণ রায় গভীর জঙ্গলের শাসক। অন্য একটি কাহিনী অনুসারে, দুই ভাই ধনাই ও মানাই মধু সংগ্রহ করে জীবন চালাতেন। একবার ধনাই গভীর জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে যেতে চাইলে মানাই তার বিরোধিতা করেন। ধনাই দুখে নামের এক গরীব ছেলেকে সাথে নেন। দুখের মা দুখে-কে জঙ্গলে কোনো সমস্যায় পড়লে বনদেবীকে স্মরণ করতে বলেন। দুখে-কে সঙ্গে নিয়ে ধনাই নৌকাপথে গভীর জঙ্গলে পৌঁছান। কিন্তু দক্ষিণ রায়কে উপহার দিতে ভুলে যাওয়ার কারণে প্রথম তিনদিন ধনাই কোনো মধু পাননি। তৃতীয় রাতে দক্ষিণ রায় স্বপ্নে ধনাই কাছে মানুষের বলিদান চান। মধুর বিনিময়ে লোভী ধনাই দুখেকে উৎসর্গ করার জন্য রাজি হন। তাই মধু সংগ্রহের পর ধনাই দুখেকে জঙ্গলে ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। বাঘের ছদ্মবেশে দক্ষিণ রায় যখন দুখেকে হত্যা করতে যাচ্ছিলেন, তখন দুখে বনদেবীকে স্মরণ করেন। দুখের প্রার্থনায় বনদেবী/বনবিবি তার ভাই শাহ জঙ্গলির সাথে এসে দুখে-কে উদ্ধার করেন এবং শাহ জঙ্গলি দক্ষিণ রায়কে পরাজিত করেন। পরাজিত দক্ষিণ রায় খান গাজীর নিকট আশ্রয় নেন। অবশেষে, খান গাজী দক্ষিণ রায়ের ক্ষতি না করার জন্য বনদেবীকে রাজি করান।
বনবিবি সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনী গুলির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে, ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস বইয়ের তথ্য অনুসারে, ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণ রায়, বণিক ধনাই ও মানাই এবং গাজীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বনবিবির কাহিনীর মতোই বনবিবির মূর্তির রূপেরও পার্থক্য রয়েছে। কোথাও শাড়ি, মুকুট পরিহিতা ত্রিশূল হাতে বনবিবির মূর্তি দেখা যায়। কোথাও আবার বিনুনী চুলে ঘাঘরা-পাজামা ও টুপি-টিকলি পরিহিতা বনবিবির মূর্তি দেখা যায়। বাঘ বা মুরগি বনবিবির বাহন হিসেবে দেখা যায়। বনবিবির প্রতিমার সঙ্গে থাকে বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলি, গাজী খান (গাজী আউলিয়া), শিশু দুখে, তার দুই চাচা ধনাই আর মানাইয়ের প্রতিমা এবং দক্ষিণ রায় তথা ব্যাঘ্রমূর্তি। মন্ত্রপাঠ, নৈবেদ্য ইত্যাদি ধর্মীয় আচারাদির পাশাপাশি প্রসাদ ও শিরনি বিতরণ করা হয়। ভোগ বা প্রসাদ নিরামিষ, তবে কখনও বনবিবির নামে মুরগি উৎসর্গ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসন্তী, সজনেখালি, গোসাবা, দোবাঁকি প্রভৃতি অঞ্চলে বনবিবির মন্দির দেখা যায়। প্রতিবছর পয়লা মাঘ বনবিবির মেলা বসে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : রাঢ় অঞ্চলের টুসু উৎসব
সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষদের জীবন-সমাজ-সংস্কৃতিতে বনবিবি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গলে প্রবেশ করার আগে অনেক সময়ই জেলে-মৌয়ালরা মন্ত্রগুণী ও পূজারী সঙ্গে নিয়ে যান। অনেক গ্রামে এমন রীতিও দেখা যায়— যতদিন স্বামী জঙ্গলে থাকেন, বাড়িতে তাঁদের স্ত্রীদের চুলে চিরুনি দেওয়া, গায়ে সাবান দেওয়া মানা, এমনকী মাছও খাওয়া যাবে না। নিয়মে কিছু ভুল হয়ে গেলে বনবিবির নাম স্মরণ করে মাফ চাইতে হয়। জঙ্গল থেকে গ্রামে নিরাপদে ফিরে আসার জন্য জঙ্গলের ঢোকার আগে জেলে-মৌয়ালরা বনবিবির মানত করা লাল সুতোর মাদুলি বা তাবিজ পরে। বনে প্রবেশের আগে কাদামাটির মূর্তি গড়ে দেবীকে পুজো করা হয়। গ্রামে না ফেরা পর্যন্ত বাড়ি-বাড়ি ‘অশৌচ’ পালিত হয়। গ্রামে ফিরে আসার পর ব্যাপক আয়োজন করে দেবীকে ভক্তিভরে পুজো করা হয়। জেলে-মৌয়ালদের নৌকার গলুইয়ের মাথায় বা অগ্রভাগে তিনকোণা ছোট্ট লাল রং করা অংশটিতে ফুলের মালা পরিয়ে, ধূপ জ্বালানো হয়। সুন্দরবনের প্রতিটি নৌকাতে গলুইয়ের মাথার এই অংশটিতে বনবিবির আশীর্বাদ থাকে বলে অতি পবিত্র মানা হয়। এখানে পা দেওয়া নিষিদ্ধ।
বনবিবি সুন্দরবন অঞ্চলের আবহমান লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহাসিক সত্যতার সঙ্গে লোককথার যতই অসংগতি থাক, সুন্দরবনজীবীদের মনে বনবিবি আজও ভক্তি, শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের প্রতীক। বাদাবনে হলুদ-কালো ডোরাকাটা শিকারীর থেকে বাঁচতে বনবিবিই ভরসা। লোকবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, ধর্ম নির্বিশেষে বনবিবি রূপে এক নারীশক্তির দৈবযাত্রা সত্যিই অনবদ্য। (Banbibi – Goddess of Sundarban)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকাঃ- সরবানী হালদার (ভুষির চক, কুলতলি, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- উইকিপিডিয়া ; প্রথম আলো ; ঢাকা টাইমস ; এই সময় ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; আজতক বাংলা
Very Nice
ধন্যবাদ ❤️
Pingback: Silk Industry of Murshidabad - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Topic - Golden Quadrilateral Project - ভূগোলিকা-Bhugolika
সুন্দর রচনাশৈলী…
ধন্যবাদ ❤️
Pingback: Nature’s Beloved Sentinelese - ভূগোলিকা-Bhugolika