Vishnu’s Dashavatara & Evolutionism of Darwin
বিষ্ণুর দশাবতার এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদ
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Vishnu’s Dashavatara & Evolutionism of Darwin । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি বিষ্ণুর দশাবতার এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদের সাদৃশ্য সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

ধর্ম এবং বিজ্ঞানের সুপ্রাচীন সংঘর্ষ আমাদের অজানা নয়। গ্যালিলিও, ব্রুনো প্রমুখ মহান বিজ্ঞানীদের ওপর ধর্মের নামে নিষ্ঠুর অত্যাচারের ইতিহাস তো আমরা জানি। তাহলে, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক কিরূপ? এবিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের একটি কালজয়ী উক্তি রয়েছে। আইনস্টাইন বলেছিলেন, “Science without Religion is lame, Religion without Science is blind”। আজকের আধুনিক যুগে, বৈজ্ঞানিক সারবত্তাহীন ধর্ম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত/গোষ্ঠীগত বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সত্যিই কি ধর্মে, ধর্মীয় বিশ্বাসে কোথাও বিজ্ঞান নেই? এ প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তারই প্রেক্ষাপটে এই প্রবন্ধ। (Vishnu’s Dashavatara & Evolutionism of Darwin)
পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম হল সনাতন ধর্ম, যা হিন্দু ধর্ম নামেও পরিচিত। ৫০০০ বছরেরও প্রাচীন এই ধর্ম ও আনুষঙ্গিক সংস্কৃতি ভারতীয় সভ্যতার ধারক ও বাহক। আর এই হিন্দু ধর্মে বিষ্ণু হলেন একটি প্রধান দেবতা, ঋগবেদেও যাঁর উল্লেখ রয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রমতে, বিষ্ণু এই জগৎ সংসারের পালনকর্তা। বিষ্ণুর দশাবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ জনপ্রিয় ধর্মীয় বিষয়। অতি সহজ কথায়, হিন্দু ধর্মে জগৎ সংসারের পালন-কর্তা ভগবান শ্রী বিষ্ণু, যুগে যুগে (সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি) বিবিধ অশুভ শক্তি ও বিপদ থেকে পৃথিবী তথা জগৎ সংসারকে রক্ষা করতে দশবার বিভিন্ন অবতার রূপে আবির্ভূত হয়েছেন (এবং হবেন)। এই দশ অবতারই, বিষ্ণুর দশাবতার (Dashavatara of Lord Vishnu) নামে পরিচিত। হিন্দু পুরাণের মধ্যে অগ্নিপুরাণ, পদ্মপুরাণ, গরুড়পুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বরাহ পুরাণ প্রভৃতিতে বিষ্ণুর দশাবতারের উল্লেখ রয়েছে। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, কলকি — এই হল সর্বাধিক প্রচলিত দশাবতার তালিকা। এর মধ্যে প্রথম ৯ অবতারই আবির্ভূত হয়েছেন, শুধুমাত্র শেষতম অবতার ‘কলকি’ যুগচক্রের শেষ যুগ ‘কলিযুগ’-এর শেষে আবির্ভূত হবেন। তবে আঞ্চলিক তারতম্যে, এই তালিকায় কখনও কখনও কৃষ্ণের পরিবর্তে বলরাম ; গৌতম বুদ্ধের পরিবর্তে জগন্নাথ বা বলরামকে তালিকাভুক্ত করা হয়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : এশিয়ার পরিষ্কারতম নদী ডাউকি
উল্লেখ্য, ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ তথা জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তাঁর ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পেসিস’ গ্রন্থে প্রাকৃতিক বিবর্তনবাদ (Natural Evolution) মতবাদ তুলে ধরেন। এবিষয়ে বিজ্ঞানী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের অবদানও উল্লেখযোগ্য। এই মতবাদে পৃথিবীর জীবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের যুগ-ক্রমিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। প্রথমদিকে এনিয়ে কমবেশি বিতর্ক থাকলেও, বর্তমানে বিবর্তনবাদ প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য। ডারউইন, তার বিশ্বব্যাপী ভ্রমণের সময়ে, বিশেষত প্রশান্ত মহাসাগরের গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের অধ্যয়ন করে প্রাণের বিবর্তনের উপর বিবর্তনবাদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতবাদ ‘ডারউইনিজম’-এর প্রবর্তন করেন। যার মূল কথা হল, যোগ্যতমের উদবর্তন অর্থাৎ যে প্রকৃতির নিয়মাবলীতে সবচেয়ে ভালোভাবে নিজেকে অভিযোজন করার ক্ষমতা রাখে, সেই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকে, বাকিরা হারিয়ে যায়। এতে প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) -এর কথাও বলা হয়েছে।
অনেক আধুনিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা হিন্দু ধর্মে উল্লিখিত, বিষ্ণুর দশাবতারের সাথে চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের তুলনা করেছেন। ১৮৭৭ সালে রাশিয়ার থিওসফিস্ট দার্শনিক হেলেনা ব্লাভাটস্কি তাঁর ‘Isis Unveiled’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম বিষ্ণুর দশাবতারের সাথে ডারউইনের প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। যথা —
(১) মৎস্য: অর্থাৎ মাছ, প্রথম পর্যায়ের মেরুদন্ডী প্রাণী, জলে উদ্ভূত, জলজ প্রাণী।
(২) কূর্ম: অর্থাৎ কচ্ছপ, জলে ও স্থলে বসবাসকারী উভচর প্রাণী।
(৩) বরাহ: অর্থাৎ শূকর, বন্য স্থলজ প্রাণী।
(৪) নরসিংহ: অর্থাৎ মানব-সিংহ, অর্ধ মানব ও অর্ধ পশুরূপী প্রাণী।
(৫) বামন: অর্থাৎ খর্বকায়, প্রাক-পরিণত মানব।
(৬) পরশুরাম: জঙ্গলে বসবাসকারী ও আদিম অস্ত্র (কুঠার) ব্যবহারকারী প্রাচীন মানব।
(৭) রাম: অর্থাৎ সমাজবদ্ধ মানব।
(৮) কৃষ্ণ: অর্থাৎ উন্নত রাজনীতিজ্ঞ মানব।
(৯) গৌতম বুদ্ধ: অর্থাৎ সন্ন্যাসী, ধর্মজ্ঞ, দিব্যজ্ঞানযুক্ত মানব।
(১০) কলকি: অর্থাৎ আধুনিক প্রচন্ড ধ্বংসক্ষমতা যুক্ত মানব।
প্রথম ভারতীয় হিন্দু হিসেবে, ব্রাহ্ম সমাজের কেশবচন্দ্র সেন ১৮৮২ সালে তাঁর এক বক্তৃতায় এই ধারনা তুলে ধরেন। ডারউইন-ওয়ালেস পদক (১৯৫৮) প্রাপ্ত জেনেটিক্স ও উদ্ভিদবিদ্যার ব্রিটিশ-ভারতীয় বিজ্ঞানী জন বার্ডন স্যান্ডারসন হ্যালডেন (J.B.S. Haldane) এই প্রসঙ্গে বলেন, হিন্দু ধর্মের বিষ্ণুর দশাবতার হল মেরুদণ্ডী বিবর্তনের এক খসড়া ধারণা (Rough Idea)। উদ্ভিদবিদ্যায় ফ্র্যাঙ্ক স্মার্ট পুরষ্কার প্রাপ্ত ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম ভারতীয় গভর্নর তথা ভারতের অর্থমন্ত্রী (১৯৫০-৫৬) চিন্তামণ দ্বারকানাথ দেশমুখ ডারউইনের প্রাকৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের সাথে বিষ্ণুর দশাবতারের চমকপ্রদ সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সংস্কৃত অধ্যাপক মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়ামস (১৮১৯-১৮৯৯) এই প্রসঙ্গে বলেছেন — “নিশ্চিতভাবে হিন্দুরা ছিলেন ডারউইনের জন্মের ও বিবর্তনবাদ তত্ত্বের উদ্ভবের বহু শতক আগের বিবর্তনবাদী ধারনার উদ্ভাবক, যা এর পূর্বে পৃথিবীর কোনো ভাষায় বিবর্তনের এইরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়নি”। (Vishnu’s Dashavatara & Evolutionism of Darwin)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – ইকোটোন এবং এজ ইফেক্ট
সত্যিই কি ডারউইনের বিবর্তনবাদের সঙ্গে বিষ্ণুর দশাবতারের সাদৃশ্য/মিল রয়েছে? বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রূপে ডারউইনের বিবর্তনবাদের সাথে সবিস্তারে মিল নেই ঠিকই, কিন্তু কিছু চমকপ্রদ সাদৃশ্য অবশ্যই রয়েছে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসারে, জলেই প্রথম জীবনের উদ্ভব। আবার বিষ্ণুর দশাবতারের প্রথম অবতারই মৎস্য অর্থাৎ মাছ, যা জলজ প্রাণী। ডারউইনের বিবর্তনবাদ মতে, জলজ জীব থেকেই উভচর ও স্থলজ জীবের উৎপত্তি ঘটে। বিষ্ণুর দশাবতারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবতার যথাক্রমে কূর্ম অর্থাৎ কচ্ছপ এবং বরাহ অর্থাৎ শূকর যথাক্রমে উভচর ও স্থলজ জীব। আবার ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম অর্থাৎ অরণ্যাচারী প্রাচীন মানবের পূর্বে চতুর্থ ও পঞ্চম অবতারে যথাক্রমে নরসিংহ ও বামন অবতার পশু থেকে মানব সৃষ্টির বিবর্তনকেই ইঙ্গিত করে। আবার সপ্তম থেকে দশম অবতার মানব সভ্যতার বিবর্তনকে রূপকার্থে তুলে ধরে, যেখানে সমাজবদ্ধ জীব থেকে বর্তমানে জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত মানুষ প্রকৃতির প্রতি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে। আর একটি তাৎপর্য্যপূর্ণ বিষয় হল, ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতোই বিষ্ণুর দশাবতারেও কোনো পশ্চাৎমুখী বিবর্তন (Reverse Evolution) নেই।
ধর্ম মানেই কুসংস্কার নয়, যদিও ধর্ম পুরোপুরি কুসংস্কারমুক্ত নয়। মুক্ত চিন্তাধারাতে আমরা যদি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাহলে হয়তো তথাকথিত অনেক ধর্মীয় বিষয়-দর্শনের মধ্যেও বিজ্ঞানের ছাপ পেতে পারি। আইনস্টাইন তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ আই সি ইট’ (১৯৩৪) গ্রন্থে বলেছেন, ‘A knowledge of the existence of something we cannot penetrate, of the manifestations of the profoundest reason and the most radiant beauty, which are only accessible to our reason in their most elementary forms — it is this knowledge and this emotion that constitute the truly religious attitude ; in this sense, and in this alone, I am a deeply religious man’। হিন্দু ধর্মের বিষ্ণুর দশাবতার কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয় ঠিকই, কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ডারউইন প্রবর্তিত বিবর্তনবাদের সাথে এই বিষয়টির অনেক লক্ষ্যণীয় সাদৃশ্য রয়েছে। না, কোনো তথাকথিত ছদ্মবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নেই, সুপ্রাচীন কালে হিন্দুধর্মের উপলব্ধিতে বিবর্তনবাদের কোনো ধারণা ছিল কি না — এ প্রশ্নেরই অবতারণাতেই এই প্রবন্ধ। পরিশেষে, ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪) -এর সেই বিখ্যাত সংলাপটা মনে আছে তো? — ‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Dasavatara – J. P. Vaswani ; The Western roots of Avataric Evolutionism in colonial India – C. Mackenzie Brown ; Handbook of Religion and the Authority of Science – James R. Lewis, Olav Hammer (eds.) ; Cover Story: Haldane: Life Of A Prodigious Mind ; Aspects of Development – C. D. Deshmukh ; Wikipedia ; The World as I See It – Albert Einstein ; Science & Religion – Albert Einstein
Pingback: Banbibi - Goddess of Sundarban - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Rama Setu - Science & Ramayana - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Silk Industry of Murshidabad - ভূগোলিকা-Bhugolika
Khub Sundar…