Geographical Indication – Mangoes of Malda
ভৌগোলিক নির্দেশক – মালদার আম
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Geographical Indication – Mangoes of Malda । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি ভৌগোলিক নির্দেশক প্রাপ্ত মালদার আম সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

আম ক্রান্তীয় গ্রীষ্মকালীন ফল, ভারতের জাতীয় ফল (National Fruit of India)। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবাসী আমের স্বাদের সাথে পরিচিত। জীবাশ্ম থেকে পাওয়া প্রমাণ থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ২৫-৩০ মিলিয়ন বছর পূর্বেও উত্তর-পূর্ব ভারতে ছিল আমের অস্তিত্ব। প্রাচীন যুগে আম পরিচিত ছিল আম্র ফল হিসাবে। বেদ উপনিষদেও রয়েছে এই নামের উল্লেখ। দক্ষিণ ভারতে এই ফল তামিল ভাষায় ‘মান কায়/মান গায়’ নামে উচ্চারিত হতে শুরু করে, সেখান থেকে লোকমুখে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে এই ফল মাঙ্গা নামে পরিচিত হতে শুরু করে। পর্তুগীজদের এই ফল বিশেষ পছন্দ ছিল, তারা যখন কেরালাতে আসে তাদের মাধ্যমেই এই ফল ‘ম্যাঙ্গো’ (Mango) নামে পরিচিত হয়।
ভারতবর্ষের যে সকল রাজ্যে এই ফল উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গের আম উৎপাদক জেলাগুলির মধ্যে মালদা জেলা অগ্রণী। এই জেলার মাটি ও জলবায়ু আম ফলনের সহায়ক হওয়ায়, বর্তমানে প্রায় ৩১,৬৫০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়ে থাকে। এই জেলার আম তার স্বাদ, গন্ধ, বর্ণের জন্য বিশ্বদরবারে সমাদৃত। মালদার আমের উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। আবার চৈনিক ভূ-পর্যটক হিউয়েন সাঙের লেখাতেও রয়েছে গৌড়ের আমের সুখ্যাতি। ধর্মপালের তাম্রলিপিতেও রয়েছে বরেন্দ্রভূমির বিস্তৃত আম বাগানের প্রসঙ্গ। হুমায়ুন গৌড়ের আমের প্রতি প্রসন্ন হয়ে এর নামকরণ করেন ‘জন্নতাবাদ’। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ তার জন্য নির্ধারিত আমগাছগুলিকে রক্ষনাবেক্ষনের জন্য প্রতি বছর অস্ত্রধারী সৈন্য পাঠাতেন। এই জেলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই ফল এবং জায়গা করে নিয়েছে মালদার লোকগান ‘গম্ভীরা’-তেও।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সোলার ম্যাক্সিমাম ও সোলার মিনিমাম
স্বাদের পাশাপাশি আমের একাধিক উপকারিতাও রয়েছে। যেমন — (১) ক্যানসার প্রতিরোধ :- আমে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট (যেমন – Quercetin, Isoquercitin, Astragalin, Fisetin, Gallic Acid) রয়েছে ; যেগুলি লিউকোমিয়া, স্তন, কোলন ক্যানসার থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। (২) কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন :- আমে রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম, যা কোষের গঠনের একটি অন্যতম উপাদান। ভিটামিন C, পেক্টিন ও ফাইবারে সমৃদ্ধ এই ফল কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন করে হার্ট ভালো রাখতে ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। (৩) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন :- আমের পাতা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। (৪) চোখের জন্য উপকারী :- এই ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A, যা আমাদের চোখের জন্য খুব উপকারী। (৫) ওজন হ্রাসে সাহায্য করে :- এই ফলে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ও নিউট্রিয়েন্টস, যা আমাদের হজম ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটায় এবং অতিরিক্ত ক্যালোরি ক্ষয়ে সাহায্য করে ওজন হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। (৬) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে :- আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A ও C এবং ২৫ টি বিভিন্ন ধরনের ক্যারোটিনয়েড, যা আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। (৭) আয়রনের উৎস :- এই ফল আয়রনে ভরপুর। অ্যানিমিয়া রোগী, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এই ফল খুব উপকারী। (৮) গরমের হাত থেকে রক্ষা করে :- আম আমাদের শরীরকে শীতল রাখে ও বাইরের প্রচন্ড উত্তাপের হাত থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে।
জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (Geographical Indication) বা ভৌগোলিক নির্দেশক (সংক্ষেপে G.I.) হল এমন একটি নির্দেশক, যা কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট উৎস এবং সেই ভৌগোলিক উৎসের কারণে পণ্যটির গুনমান বা খ্যাতি বর্ণনা করে। এই নির্দেশক একটি পণ্যের উৎস হিসাবে একটি নির্দিষ্ট স্থানকে শনাক্ত করে এবং ওই পণ্যের গুনগতমান, বৈশিষ্ট্য ও খ্যাতির উপর সেই নির্দিষ্ট উৎসের প্রভাব বর্ণনা করে। সাধারণত কৃষিজাত পণ্য, খাদ্যসামগ্রী, হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে এই ভৌগোলিক নির্দেশক প্রযোজ্য। মালদায় বিভিন্ন প্রজাতির আমের ফলন হলেও, ২০০৮ সালে তিনটি প্রজাতি ভারত সরকারের জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (Geographical Indication) বা জি.আই. তকমা পেয়েছে। এই তিনটি প্রজাতি হল — ফজলি (Fazli), হিমসাগর (Himsagar), লক্ষ্মণভোগ (Lakshmanbhog)। ভৌগোলিক নির্দেশক প্রাপ্ত এই তিনটি আমের বৈশিষ্ট্যগুলি হল — (Geographical Indication – Mangoes of Malda)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ভূস্বর্গের পর্যটনে শ্রীনগর
(১) ফজলি: (ভৌগোলিক নির্দেশক নং- ১১৩)
মালদার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উৎপাদিত আম হল ফজলি। এই আমের গঠনগত ও স্থায়িত্বকালগত সাদৃশ্য রয়েছে তোতাপুরি আমের সাথে। এই আম বেশ বড় হয়, একটি আমের গড় ওজন ৭০০-১৫০০ গ্রাম হয়। আয়তডিম্বাকার এই আমের খাঁজ খুব কম বা অনুপস্থিত থাকে। এই আমের ত্বক অমসৃণ এবং মাঝারি পুরু হয়, ত্বকের উপর ছোট ছোট গোল দাগ থাকে। এই আমের শাঁস হালকা হলুদ রং-এর হয় ও অল্প আঁশযুক্ত হয়। সুন্দর গন্ধ ও সুমিষ্ট স্বাদযুক্ত এই আমের ফলন জুলাই-আগস্ট মাসে হয়। সব শেষে মালদার বাজারে আসা এই আম ৯৫৯৫ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় এবং এর বার্ষিক গড় উৎপাদন এই তিনটি আমের মধ্যে সবচেয়ে বেশী, ১০৫৮৭৬ মেট্রিক টন।
(২) হিমসাগর: (ভৌগোলিক নির্দেশক নং- ১১২)
হিমসাগর আম খিরসাপাতি নামেও পরিচিত। এই আমের আকার মাঝারি থেকে বড় ধরনের হয়। একটি আমের গড় ওজন ২৫০-৩৪০ গ্রাম হয়। ডিম্বাকৃতি এই আমের মধ্যভাগ স্ফীত এবং রং হলুদাভ সবুজ হয়। ত্বক অমসৃণ হয়। এই তিন ধরনের আমের মধ্যে এই আম সবচেয়ে বেশি মিষ্টি হয়, মিষ্টির পরিমাণ ৯-১৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। মূলত জুন মাসে ফলন হওয়া এই আম ১৭৬৭ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়, এর বার্ষিক গড় উৎপাদন ১৭৫০৬ মেট্রিক টন।
(৩) লক্ষ্মণভোগ: (ভৌগোলিক ইঙ্গিত নং- ১১১)
মালদার একটি বিশেষ আম হল লক্ষ্মণভোগ। এই আমের গঠনগত ও স্থায়িত্বকালগত সাদৃশ্য রয়েছে আলফানসো আমের সাথে। জুন মাসে এই আমের ফলন হয়। এই আমের আকার মাঝারি থেকে বড় ধরনের হয়, একটি আমের গড় ওজন ২২৫-৩৯০ গ্রাম হয়। এই আম লম্বাটে ও প্রায় ডিম্বাকার হয়। আমের বৃন্ত তির্যকভাবে সমতল ও সন্নিবিষ্ট থাকে, আমের উপরিঅংশের দুইদিক অসমান হয়, মাঝের অংশটি ফোলা ও পৃষ্ঠতলের শেষদিকটি যথেষ্ট বাঁকানো ও আমের চঞ্চুটি (Beak) যথেষ্ট ছুঁচালো হয়। ত্বক পুরু ও রং হলুদাভ সবুজ হয়, ভিতরের শাঁস কমলা ও হলুদ বর্ণের এবং মসৃণ হয়, আঁশ প্রায় অনুপস্থিত। এই আম দেখতে সুন্দর এবং মিষ্টি স্বাদ ও গন্ধযুক্ত হয়। মোট ৩০৩০ হেক্টর জমিতে এই আমের ফলন হয়, বার্ষিক গড় উৎপাদন ২৯৬১২ মেট্রিক টন।
এই তিন প্রজাতির আম ছাড়াও মালদায় আরও নানা প্রজাতির আম (যেমন — গোপালভোগ, ল্যাংড়া, রাখালভোগ, আশ্বিনা ইত্যাদি) পাওয়া যায় এবং এই আমের ফলনের ওপর মালদার অর্থনীতি অনেকখানি নির্ভরশীল। তবে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনবসতির প্রসারের জন্য বর্তমানে আমবাগানের পরিমাণ ক্রমহ্রাসমান। তবে আশা করা যায়, ভৌগোলিক নির্দেশক প্রাপ্তি মালদার আম চাষে নতুন উৎসাহের সঞ্চার করবে। (Geographical Indication – Mangoes of Malda)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- অনন্যা সরকার (মালদা)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; Mango of Malda : The Ecology and Economy – SK Acharaya, Debdyuti Talukder, Riti Chatterjee, Anannya Chakraborty ; ISBN : 978-93-85822-70-4
Pingback: DurgaPuja in Kolkata - Recognition of UNESCO - ভূগোলিকা-Bhugolika
Thank You
Pingback: Gopegarh Ecopark of Medinipur - ভূগোলিকা-Bhugolika
Khub Valo Laglo.
ধন্যবাদ ❤️