Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Colour Hill of Purulia

পুরুলিয়ার রঙ পাহাড়

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Colour Hill of Purulia ।  আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পুরুলিয়ার রঙ পাহাড় সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Colour Hill of Purulia
রঙ পাহাড়, বলরামপুর, পুরুলিয়া

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমতম জেলা পুরুলিয়া। ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে ছোটোনাগপুর মালভূমির অন্তর্গত পুরুলিয়া মানেই রুক্ষ-শুষ্ক, খরাপ্রবণ, কৃষি অনুপযোগী এক জেলা। কিন্তু প্রকৃতি এই জেলাকে সাজিয়ে তুলতে এতটুকুও কার্পণ্য করেনি। পাহাড়-টিলা, অরণ্য-ঝর্ণা, দিগন্তবিস্তৃত টাঁড়, লাল মাটি — কি নেই! তবে আজও অধিকাংশ পর্যটকের গন্তব্য সেই অযোধ্যা-জয়চন্ডী-গড়পঞ্চকোট! যদিও, পুরুলিয়ার আনাচে-কানাচে এমন অসংখ্য স্থান রয়েছে, যা প্রকৃতির অনুপম শিল্পীসত্ত্বার নিদর্শন। তারই একটি হল পুরুলিয়া মালতি গ্রামের ‘রঙ পাহাড়’ (Colour Hill of Purulia), যা এখনও অবদি সেভাবে পরিচিতি লাভ করেনি।

পুরুলিয়া সদর মহকুমার বলরামপুর ব্লকের বেলা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মালতি গ্রাম। বলরামপুর শহর থেকে মাত্র ৮ কিমি দূরে, পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড সীমানার কাছেই অবস্থিত এই মালতি গ্রামেই রয়েছে ‘রঙ পাহাড়’। নীল আকাশের নিচে, সবুজ ঘাসের গালিচায় এক রামধনু রঙের পাহাড়। বার্নট সায়না, নেপল্‌স ইয়েলো, ইয়েলো অকার, র’ অ্যাম্বার, হোয়াইট, পেইন্‌স গ্রে…সে পাহাড়ে হরেক রঙের মেলা! প্রকৃতপক্ষে, এটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত একটি খড়ি-খাদান ; স্থানীয় নাম মালতি খাদান। খড়ি হল এক ধরনের চকজাতীয় মাটি, যা মাটির গভীরে স্তরে স্তরে সঞ্চিত থাকে ; দেখতে পাথরের মতো, কিন্তু হালকা এবং জলে গুলে যায়। মালতি খাদানে সাদা, কালো এই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা উৎসব-পার্বণে এই খাদানের রঙিন মাটি ব্যবহার করে বাড়ির দেওয়ালে চিত্র, আলপনা প্রভৃতি আঁকেন। তাই প্রাকৃতিক রঙের জোগানদার পাহাড়ের নাম ‘রঙ পাহাড়’!

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সোলার ম্যাক্সিমাম ও সোলার মিনিমাম

‘রঙ পাহাড়’ ছোট্ট এক টিলাকৃতি ভূমিরূপ, বোল্ডার-পাথরের মাঝখান দিয়ে চওড়া পায়ে চলা পথ। পাহাড়ের মাথাটা চ্যাপ্টা কিন্তু এবড়োখেবড়ো। মাঝখানে গভীর একটা গর্ত, নীচে জল। পুরো টিলা জুড়ে লাল কালো হলুদ খয়েরি রঙের মেলা। কিন্তু কিভাবে তৈরি হয়েছে প্রকৃতির এই রঙের বাহার? ভূতাত্ত্বিক, গবেষক এবং বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক গুরুপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবিষয়ে জানান, “গঠনগত বিচারে জায়গাটি ভারতের আদিমতম শিলায় গঠিত উপদ্বীপীয় মালভূমি গন্ডোয়ানাল্যান্ডের একটি অংশ। এই অঞ্চলের মূল শিলা হল আগ্নেয় শিলার পরিবর্তিত রূপ, যার ভূতাত্ত্বিক নাম নাইস”। তাঁর মতে সাদা বা হালকা খয়েরি রঙের যে পাথরগুলো রয়েছে ওখানে, সেগুলো এই নাইসিক শিলা গঠিত হওয়াই সম্ভব। গুরুপ্রসাদ বাবু আরও জানান, “লাল রঙের জায়গাগুলো আয়রন অক্সাইড সমৃদ্ধ। লোহার ভাগ বেশি থাকায় রং লাল। এই শিলাময় অংশটাকে ল্যাটেরাইট বলা চলে। সমগ্র ছোটনাগপুর অঞ্চলেই এমন ল্যাটেরাইট থেকে সৃষ্ট মৃত্তিকা অনেক জায়গায় দেখা যায়। পুরুলিয়ার বলরামপুর অঞ্চলের আশপাশ, যেমন— ঝালদা বা বাঘমুন্ডি এলাকা— প্রকৃতির এমন মিশ্র শিলা বা শিলাচূর্ণ দিয়ে গঠিত”।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পুরুলিয়ার মিনি সুন্দরবন

রঙ পাহাড়ে আরও দু’রকম পাথর দেখা যায় — কালো আর সাদাকালো। অতীতে বিভিন্ন সময়ে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসার লাভা বাইরে এসে জমাট বেঁধে কালো ব্যাসল্টে পরিণত হয়েছে। আর এখানে সাদা ও আংশিক কালো খনিজের মিশ্রণে তৈরি আগ্নেয় শিলা গ্রানাইট পাথরও প্রচুর রয়েছে। কিভাবে এইসব পাথর থেকে রঙ তৈরি করা হয়? প্রথমে এই পাথরকে ভালোভাবে গুঁড়ো করে, তা চালুনি দিয়ে চেলে নেওয়া হয়। এবার পাথরের গুঁড়োকে মিহি কাপড়ে ফের ২-৩ বার চেলে নেওয়া হয়। তারপর ওটাকে জল দিয়ে গুলে নিলেই রঙ তৈরি! এবার রঙকে টিকসই করতে পানিয়ালতা গাছের ডাল গরম জলে ফোটালে যে আঠা বেরোয়, তা রঙের সঙ্গে মেশানো হয়। খাদান থেকে প্রাপ্ত খড়ি সিমেন্ট শিল্পে এবং সেরামিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়। বাড়তি, অব্যবহৃত অংশই স্থানীয় বাসিন্দারা রঙ হিসেবে ব্যবহার করেন।

প্রকৃতির কোলে শান্ত, নির্জন ‘রঙ পাহাড়’। এখানে পর্যটকদের ভিড় নেই, দোকান-বাজারের পসার নেই। শুধু স্থানীয় এলাকার ঘরবাড়ির দেওয়ালে রঙিন চিত্রকলার নেপথ্যে দাঁড়িয়ে থাকে এই ‘রঙ পাহাড়’। ভয় একটাই, পাথর-মাফিয়াদের কবলে পড়ে প্রকৃতির এই রঙমহল যেন হারিয়ে না যায়! অজানা-অচেনা পুরুলিয়ার অখ্যাত প্রান্তরে প্রকৃতি সেজে থাক আপন সাজে। যা দেখে কোনো ভ্রমণপিপাসুর হৃদয় রঙিন হয়ে উঠবে। তাই তো মধুকবি যথার্থই বলেছেন,
“পাষাণময় যে দেশ, সে দেশে পড়িলে
বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে?
কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে,
হে পুরুল্যে!…”

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]

লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- Official Website of Purulia District, West Bengal, India ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; রঙ পাহাড় – উজ্জ্বল কুমার দাস – PURULIA-Purulia ফেসবুক পেজ ; Google Map

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ভূস্বর্গের পর্যটনে শ্রীনগর

9 thoughts on “Colour Hill of Purulia

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!