Srinagar – Tourism in Kashmir
ভূস্বর্গের পর্যটনে শ্রীনগর
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Srinagar – Tourism in Kashmir । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পর্যটনে শ্রীনগর সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

‘সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই
নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি,
হঠাৎ জেগে উঠেছে-
সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ।
দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে
মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে,
ডেকেছে রৌদ্রকে,
ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে,
পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর।’
— সুকান্ত ভট্টাচার্য (ছাড়পত্র, ১৯৪৮)
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর হল শ্রীনগর (Srinagar – Tourism in Kashmir)। পৃথিবীর ভূস্বর্গ নামে পরিচিত কাশ্মীর উপত্যকায় ঝিলাম নদীর তীরে অবস্থিত শ্রীনগর শহরটি ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ (Venice of The East) নামেও পরিচিত। প্রায় ১২ লক্ষ জনসংখ্যার (২০১১ জনগণনা অনুসারে) শ্রীনগর শহর নেপালের কাঠমান্ডুর পরই হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেট্রোপলিটন শহর এবং ১০ লক্ষের বেশি জনসংখ্যাযুক্ত ভারতের উত্তরতম শহর। দ্বাদশ শতকে সংস্কৃত ভাষায় কলহন রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে শ্রীনগর নামটির উল্লেখ রয়েছে। পন্ডিতেরা শ্রীনগর শব্দটির অর্থ মূলত দুইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এক, শ্রীনগর অর্থাৎ সূর্যের নগর (City of the Sun) ; দুই, শ্রী অর্থাৎ হিন্দু ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর নগর। অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, উদ্যান, হ্রদ-হাউসবোট-শিকারার জন্য পরিচিত শ্রীনগর শহর ঐতিহ্যবাহী কাশ্মীরি হস্তশিল্প (যেমন : পশমিনা শাল) এবং শুকনো ফলের জন্য বিখ্যাত। (Srinagar – Tourism in Kashmir)
শ্রীনগর শহর এবং তার আশেপাশে প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় নানাপ্রকার বিবিধ পর্যটনস্থল রয়েছে। এই প্রবন্ধে শ্রীনগর শহর এবং তার আশেপাশে অবস্থিত ৫ টি নির্বাচিত পর্যটনস্থল (যথা : ডাল হ্রদ, নাগিন হ্রদ, ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি টিউলিপ উদ্যান, মুঘল উদ্যান এবং দাচিগ্রাম জাতীয় উদ্যান) আলোচনা করা হল। (Srinagar – Tourism in Kashmir)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সিকিয়াঝোরা – ডুয়ার্সের আমাজন
(১) ডাল হ্রদ (Dal Lake):
ডাল হ্রদ জম্মু ও কাশ্মীরের দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ। ‘কাশ্মীরের মুকুটে রত্ন’ (Jewel in the crown of Kashmir) নামে পরিচিত এই হ্রদের সর্বাধিক দৈর্ঘ্য ৭.৪ কিমি, সর্বাধিক প্রস্থ ৩.৫ কিমি এবং আয়তন ১৮ বর্গকিমি। তবে সন্নিহিত এলাকায় পদ্মফুলের ভাসমান উদ্যান (যা স্থানীয়ভাবে ‘রাদ’ নামে পরিচিত) সহ ডাল হ্রদের আয়তন ২১.১ বর্গকিমি। ডাল হ্রদের গড় গভীরতা ১.৪ মিটার এবং সর্বাধিক গভীরতা ৬ মিটার। শীতকালে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা চলে গেলে, এই হ্রদের জল জমে বরফে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, কাশ্মীরি ভাষাতে ‘ডাল’ শব্দের অর্থই হ্রদ। যেকোনো পর্যটকের কাশ্মীর ভ্রমণের অবিচ্ছেদ্য অংশ শিকারা বা হাউসবোটে চড়ে ডাল হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করা৷ ডাল হ্রদে ভাসমান বাজার রয়েছে, যেখানে শাকসবজি, ফল, শুকনো ফল, কাশ্মীরি শাল সহ নানা রকম দ্রব্য বেচা-কেনা চলে৷ ডাল হ্রদের ‘চার চিনার’ কৃত্রিম দ্বীপ বিখ্যাত। উল্লেখ্য, ডাল হ্রদেই রয়েছে ভারত তথা বিশ্বের একমাত্র ভাসমান পোস্ট অফিস (World’s Only Floating Post Office) রয়েছে। ২০১১ সালে এই ভাসমান পোস্ট অফিসটি উদ্ধোধন করা হয়। এই ভাসমান পোস্ট অফিস পরিসরে একটি ডাকটিকিট সংগ্রহালয় রয়েছে। ২০২১ সালে ডাল হ্রদে ভারত তথা এশিয়ার প্রথম ভাসমান থিয়েটার (Open Air Floating Theatre) চালু হয়। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ২০২১ সালে ডাল হ্রদে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম ভাসমান এটিএম (Floating ATM) চালু করে৷ প্রতি বছর ডাল হ্রদে শিকারা উৎসব পালিত হয়।
(২) নাগিন হ্রদ (Nigeen Lake):
শ্রীনগর শহরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য হ্রদ হল নাগিন হ্রদ। নাগিন নামটি উর্দু শব্দ ‘নাগিনা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল রত্ন। অনেক সময় নাগিন হ্রদকে ডাল হ্রদেরই অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়, কেননা একটি সঙ্কীর্ণ প্রণালী দ্বারা নাগিন হ্রদ ও ডাল হ্রদ পরস্পর যুক্ত রয়েছে। নাগিন হ্রদের সর্বাধিক দৈর্ঘ্য ২.৫ কিমি, সর্বাধিক প্রস্থ ০.৫ কিমি এবং আয়তন ০.৮৯ বর্গকিমি। নাগিন হ্রদের সর্বাধিক গভীরতা ৬.২ মিটার এবং এটি শ্রীনগরের ডাল হ্রদ অববাহিকার গভীরতম হ্রদ। শিকারা ও হাউসবোটে চড়ে উইলো ও পপলার বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত নাগিন হ্রদ ভ্রমণ বিশেষ উপভোগ্য, কেননা ডাল হ্রদের তুলনায় এখানে পর্যটকদের ভিড় তুলনামূলক কম থাকে।
(৩) ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি টিউলিপ উদ্যান (Indira Gandhi Memorial Tulip Garden):
এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো টিউলিপ উদ্যান (Asia’s Largest Tulip Garden) হল ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি টিউলিপ উদ্যান। জবরওয়ান পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে প্রায় ৩০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই টিউলিপ উদ্যানটি ২০০৭ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই টিউলিপ উদ্যানে ৬৮ রকমের টিউলিপ ফুলের দেখা মেলে। এই উদ্যানে বিভিন্ন রঙের মোট ১৫ লক্ষ টিউলিপ ফুলের গাছ রয়েছে। শুধু টিউলিপ নয় ; এই উদ্যানে ড্যাফোডিল, রানানকুলাস সহ আরও ৪৬ রকমের ফুলের দেখা মেলে। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ পর্যটক এই উদ্যানে আসেন। উল্লেখ্য, বসন্তকালে টিউলিপ ফুল ফোটে এবং টিউলিপ ফুলের আয়ু মাত্র ৩-৪ সপ্তাহ। তাই শ্রীনগরের এই টিউলিপ উদ্যান ভ্রমণের সময় হল মার্চের শেষভাগ থেকে এপ্রিলের প্রথমভাগ। বসন্তে প্রতি বছর এই উদ্যানে টিউলিপ উৎসব পালন করা হয়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ভাটরা – মালদার মিনি দীঘা
(৪) মুঘল উদ্যান (Mughal Gardens):
শ্রীনগর ও তার আশেপাশে ৫ টি মুঘল উদ্যান রয়েছে ; যথা : নাসিম বাগ, শালিমার বাগ, চশমে শাহী, নিশাত বাগ ও পরী মহল। ১৫৮৬ সালে মুঘল সম্রাট আকবর নাসিম বাগ নির্মাণ করেন। এই উদ্যানে ৭০০ টিরও বেশি চিনার বৃক্ষ রয়েছে। এটি শ্রীনগরের প্রাচীনতম মুঘল উদ্যান। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এখানে চিনার হেরিটেজ পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। ১৬১৯ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর শালিমার বাগ নির্মাণ করেন। ১২.৪ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত তিন ধাপযুক্ত এই উদ্যানটি শ্রীনগরের বৃহত্তম মুঘল উদ্যান। ১৬৩২ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে চশমে শাহী উদ্যানটি নির্মিত হয়। একটি স্বাদুজলের প্রস্রবণকে কেন্দ্র করে ধাপে ধাপে জলাধার, ফোয়ারা ইত্যাদি দ্বারা উদ্যানটি সজ্জিত রয়েছে। ১৬৩৩ সালে আসফ খাঁ (শাহজাহান পত্নী মমতাজের পিতা) নিশাত বাগ নির্মাণ করেন। ১২ টি ধাপযুক্ত, চিনার ও সাইপ্রাস গাছের সারিযুক্ত এই উদ্যানে ফোয়ারা ও জলাধারে সুসজ্জিত রয়েছে। পরী মহল হল ১৬৫০ সালে মুঘল সম্রাট শাহাজাহান কর্তৃক নির্মিত একটি সুদৃশ্য উদ্যান।
(৫) দাচিগাম জাতীয় উদ্যান (Dachigam National Park):
শ্রীনগর থেকে মাত্র ২২ কিমি দূরে রয়েছে দাচিগাম জাতীয় উদ্যান। দাচিগাম শব্দটির অর্থ হল দশটি গ্রাম, যেগুলি এই উদ্যানটি নির্মাণের কারণে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদাপ্রাপ্ত দাচিগাম জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১৪১ বর্গকিমি। মূলত সরলবর্গীয় অরণ্য আবৃত এই জাতীয় উদ্যানের প্রধান আকর্ষণ হল বিপন্ন প্রজাতির একপ্রকার হরিণ — হাঙ্গুল (Kashmir Stag)। হাঙ্গুল ছাড়াও এই জাতীয় উদ্যানে তুষারচিতা, কস্তুরী মৃগ, বাদামী ভালুক, কালো ভালুক, শিয়াল, জংলী বিড়াল প্রভৃতি প্রাণী দেখা যায়। এছাড়া দাচিগাম জাতীয় উদ্যানে খঞ্জনা, কাঠঠোকরা, পিগমি পেঁচা, হলদে বেনেবউ, কালো বুলবুল সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায়।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- তাহামিনা হোসেন (বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- The Hydrochemistry of a Himalayan Lake Nigeen (2018) – Adnan Abubakr, M. H. Balkhi & Ashwani Kumar – Nature Environment and Pollution Technology – Vol-17, No-2 ; Unacademy ; Wikipedia ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; The Indian Express ; The Hindu ; The Times of India ; নিউজ ১৮ বাংলা ; India Today ; Srinagar and Its Environs: Kashmir, India (1962) – Samsar Chand Koul ; Encyclopaedia of Kashmir (1996) – Suresh K. Sharma ; Official Website of Srinagar District, Government of Jammu and Kashmir, India
Outstanding!
ধন্যবাদ ❤️
খুব সুন্দর
Pingback: Colour Hill of Purulia - ভূগোলিকা-Bhugolika
Fabulous…
Pingback: Geographical Indication - Mangoes of Malda - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: DurgaPuja in Kolkata - Recognition of UNESCO - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Gopegarh Ecopark of Medinipur - ভূগোলিকা-Bhugolika