Solar Maximum & Solar Minimum
সোলার ম্যাক্সিমাম ও সোলার মিনিমাম
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Solar Maximum & Solar Minimum । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সূর্যের সোলার ম্যাক্সিমাম ও সোলার মিনিমাম সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

“রুদ্র, তোমার দারুণ দীপ্তি/এসেছে দুয়ার ভেদিয়া…” — আদি অন্তহীন মহাকাশের দিকে অনন্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে মানুষের নিরলস গবেষণা নিরন্তর চলছে। এই রহস্যময়তার আড়ালে কতকিছুই তো এখনও মানুষের অজানা। অসীম মহাকাশের কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে সূর্য হল একটি, যার অতি সামান্য অংশ, ২০০ কোটি ভাগের মাত্র ১ ভাগ তাপ পৃথিবীতে এসে ভূপৃষ্ঠ ও বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে। এই বিশ্ব সংসারকে সূর্য শুধু আলোই প্রদান করে না, সে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের ও প্রাণীর জীবনদাতা — এক তেজস্বী। সূর্যকে বাদ দিয়ে পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর চেহারা। বিশ্ব উষ্ণায়ন আর সভ্যতার দুরন্ত গতির ফলে চেনা পৃথিবীর তাল ও ছন্দ হারিয়ে হঠাৎই হয়ে যাচ্ছে অচেনা।
বেশ কয়েকবছর পিছিয়ে যাওয়া যাক, সালটা ছিল ২০১৫ — বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ ও প্রভাব নিয়ে তখন সারা বিশ্ব ব্যতিব্যস্ত। সম্মেলন, চুক্তি, বিভিন্ন দেশের মধ্যে মতানৈক্য, পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপে ব্যস্ত। সেই সময়ই ব্রিটেনের নিউ ক্যাসলের নর্থমব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী ভ্যালেন্টিনা জারকোভা সৌর মন্ডলের চৌম্বকীয় তরঙ্গের গতিপ্রকৃতির গাণিতিক হিসাব নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করার পর ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, সৌরমণ্ডলে উৎপন্ন হওয়া চৌম্বকীয় তরঙ্গ কমতে শুরু করেছে। ক্রমশঃ ঝিমিয়ে পড়ছে সূর্য, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তাই ২০২০ বা ২০২১ সালের পরবর্তী তিরিশ বছরের মধ্যে যে কোনো সময়ই ‘হাইবারনেশন’ বা ঘুমের মধ্যে চলে যেতে পারে সৌর মন্ডলের একমাত্র শক্তিশালী নক্ষত্র সূর্য। যার ফলে পৃথিবীতে ফিরে আসবে ‘Ice Age’ বা তুষার যুগ, যাকে জারকোভা ‘মিনি বা লিটল আইস এজ’ বলে অভিহিত করেছেন।
সাম্প্রতিক কালে সোলার মিনিমাম বিষয়ে কিছু বিজ্ঞানীদের মতামত:
বিজ্ঞানী ভ্যালেন্টিনা জারকোভার এই ভবিষ্যৎবাণীর পর বিভিন্ন বিজ্ঞানীমহল এই বিষয়টিতে গুরুত্ব সহকারে গবেষণা শুরু করে দেন। বিখ্যাত ফোর্বস পত্রিকায় এই কথাটি প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন আবহবিদগণও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। আবহবিদ পল ডোরিয়ানের বক্তব্য ছিল, ২০২০ সালের পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে ‘সোলার মিনিমাম ফেজ’ ; যেখানে সূর্যের প্রভাব থাকবে সর্বনিম্ন এবং এটি কয়েক দশক ধরেই চলবে — ধারণা আরও কিছু আবহবিদের। এই সময়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ কমবে এবং বায়ুমণ্ডল কিছুটা সংকুচিত হবে। পুরো পৃথিবী জুড়েই আঞ্চলিক জলবায়ুতে বিপুল পরিবর্তন দেখা দেবে। সাম্প্রতিক কালে অন্য নক্ষত্রের সাথে সূর্যের তুলনা করে জার্মান বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সূর্য তার ঔজ্জ্বল্য ক্রমেই হারাচ্ছে। নাসা-র কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সমীক্ষা যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। তাঁরা সোলার এক্টিভিটি এবং সূর্যের বাইরের স্তরে সান স্পট কম বা বেশি হচ্ছে কিনা, সেই ব্যাপারে খেয়াল রেখে গবেষণা করে যাচ্ছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুল অফ স্পেস রিসার্চের সঙ্গে ম্যাক্স প্ল্যাংকের গবেষক ড: আলেকজান্ডার শাপিরোর মতে — “আমরা বেশ অবাক হয়েছি সূর্যের মতো দেখতে অন্য নক্ষত্র গুলি সূর্যের থেকে বেশি সক্রিয় থাকে”। আরেক গবেষক ড: টিমো রিনহোল্ডের মতে — “অনুমান করা হচ্ছে সূর্য বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে খুব শান্ত একটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এই সময় সীমা ৪.৬ বিলিয়ন বছর বয়সী সূর্যের আয়ুষ্কালের নিরিখে অত্যন্ত সামান্য একটা সময় সীমা, তা বলাই বাহুল্য”। নয় হাজার বছর আগে সূর্যের সক্রিয়তা কতটা ছিল, তা খুঁজে বার করার কোনো উপায় আপাতত বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। তাই তাঁরা মিল্কিওয়ে বা আকাশ গঙ্গার অন্যান্য নক্ষত্রদের সাথে সূর্যের তুলনামূলক গবেষণা করছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে — সোলার মিনিমামের পরিস্থিতিতে সূর্যের স্বাভাবিক সময়ে সরবরাহ করা তাপমাত্রা সাধারণত অনেক কমে যায়। বর্তমানে সূর্য সোলার মিনিমাম পর্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছে। বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড: টনি ফিলিপসের মতে — “আমরা এমন গভীরতম সময়ের ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যে সময়ে সূর্যের আলো কার্যত অদৃশ্য হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে”।
সূর্য সম্পর্কে কিছু কথা:
সূর্যের সানস্পট অথবা সোলার এক্টিভিটি বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা নয়। সাধারণত এগারো বছর পর পর এরা উজ্জীবিত হয়ে পড়ে, আবার কখনো স্তিমিত হয়ে যায়, আবার কখনো কয়েক দশক ধরে চলে — এই স্বাভাবিক ঘটনাগুলি সোলার ম্যাক্সিমাম এবং সোলার মিনিমাম নামে পরিচিত।
মহাশূন্যের অন্য জ্যোতিষ্কদের মতো সূর্যও স্থির নয়। সূর্য তার পরিবার সহ ছায়াপথ আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের চারদিকে নির্দিষ্ট পথে পরিক্রমণ করে চলেছে, যা করতে সময় লাগে প্রায় ২৫ কোটি বছর। সূর্য একটি গ্যাসীয় অগ্নিপিন্ড, কোনো কঠিন পৃষ্ঠ নেই — যার কেন্দ্রস্থলের তাপমাত্রা এক কোটি পঞ্চাশ লাখ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গ্যাসীয় পদার্থের ছয়টি স্তর নিয়ে সূর্য গঠিত — (১) কেন্দ্র (Core) (২) রেডিও এক্টিভ অঞ্চল (Radio Active Zone) (৩) কনভেকটিভ অঞ্চল (Convective Zone) (৪) ফোটোস্ফিয়ার (Photosphere) (৫) ক্রোমোস্ফিয়ার (Chromosphere) (৬) করোনা (Corona)।
ফোটোস্ফিয়ারেই সৌর কলঙ্ক (Sun Spot) দেখা যায়। এর তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০℃ এবং এই ফোটোস্ফিয়ার স্তরেই বিকিরিত রশ্মি পৃথিবীতে সূর্যের আলো হিসেবে আসে। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট। ফোটোস্ফিয়ারের পরের স্তরটি হল ক্রোমোস্ফিয়ার। আর একেবারে বাইরের স্তর হল করোনা। এরা সাধারণত দৃশ্যমান থাকে না। পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণের সময় যখন চাঁদ সূর্যের ফোটোস্ফিয়ার আড়াল করে দেয়, তখন ক্রোমোস্ফিয়ার ও করোনা দৃশ্যমান হয়।
সান স্পট বা সৌর কলঙ্ক:
সূর্যের মতো মহা তেজস্বীও কিন্তু নিষ্কলুষ নয়! সূর্যের জীবনের এক আশ্চর্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল তার কলঙ্ক! সূর্য সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কার করে এবং তার সাথে কলঙ্কের কথা প্রকাশ করেই গ্যালিলিও গ্যালিলির জীবন হয়েছিল দূর্বিষহ, সে গল্প কম-বেশি সবাই জানেন। তারপর থেকে সূর্যের কলঙ্ক বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। পরবর্তী কালে সৌরপদার্থ বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, সূর্যের পিঠ বা সোলার সারফেস বা ফোটোস্ফিয়ারের তলায় প্রায় ৩০ শতাংশ গভীরতা এলাকায় তৈরি হচ্ছে অনবরত অতি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক চৌম্বক ক্ষেত্র। তা ছুটে আসছে সূর্যের পিঠের দিকে এবং তৈরি করছে অসংখ্য ছোট বড় কালো কালো দাগ। এই গুলোকেই সৌরকলঙ্ক বলা হয়। এগুলি এক একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র, যাদের আকৃতি এক মেগা মিটারও হতে পারে, আবার হতে পারে পঞ্চাশ মেগা মিটারের মত জায়েন্ট সানস্পট। এদের প্রত্যেকেরই একটি জীবনচক্র থাকে। সৌর পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘সোলার সাইকেল’ বা সৌরচক্র বলে। একক নয়, সান স্পট বা সৌরকলঙ্কগুলি গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে অবস্থান করে। সৌর কলঙ্ক বা সানস্পটগুলির আকৃতির উপর নির্ভর করে তাদের জীবন চক্রের আয়ুষ্কাল। অতীতে সৌরপদার্থ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, কিছুদিন পর পর থেকে প্রায় এগারো বছর ধরে চৌম্বকশক্তিকে ধরে রাখতে সক্ষম হয় তারা, আবার কখনো কখনো কয়েক দশক ধরে আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায় তাদের জীবনচক্র। (Solar Maximum & Solar Minimum)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : ভাটরা – মালদার মিনি দীঘা
সোলার ম্যাক্সিমাম:
কোনো ‘সোলার সাইকেল’ বা সৌরচক্র চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সানস্পট বা সৌরকলঙ্কগুলি সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে একটি শীর্ষ বিন্দুতে এসে উপনীত হয়। সৌরকলঙ্কের জীবনে এই অধ্যায়টির নামই হলো সোলার ম্যাক্সিমাম পর্যায়। সানস্পট বা সৌরকলঙ্কের সংখ্যা বাড়লে সৌর ধ্রুবকের (সোলার কনস্ট্যান্ট) পরিমাণে পার্থক্য দেখা যায়, সৌরশক্তির ক্রিয়া বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা সানস্পটের সংখ্যা গুণে ‘সূর্যের অগ্নিবর্ষণ’ বা সৌরবিকিরণ বা সোলার রেডিয়েশন কতটা বাড়বে এবং তার প্রভাব সম্পর্কে বলে দিতে পারেন। বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। সৌর পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে, সৌর কলঙ্ক (সান স্পট), সৌর বায়ু (সোলার উইন্ড), সৌর ঝড় (সোলার স্টর্ম), করোনাল মাস ইজাকশন (সি.এম.আই.) এর মত ব্যাপার-স্যাপার ঘটলে, পৃথিবীর উপর এক বিরূপ প্রভাব পড়ে। ঝড়ের প্রাবল্য, অধঃক্ষেপনের মাত্রা বৃদ্ধি, বিশ্ব উষ্ণায়ন, GPS ব্যবস্থা ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইজার-কলকাতা) -এর অধ্যাপক এবং গবেষকগণ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল নেচার কমিনিউকেশন-এ বিস্তারিত ভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, সমস্ত শক্তির উৎস সূর্যের থেকে সোলার স্টর্মের বা সৌর ঝড়ের ফলে কতটা ক্ষতি হতে পারে মহাকাশের আবহাওয়ামণ্ডলে এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। লক্ষ্য করা গেছে, ১৯৪০ সালের পর থেকে সৌরকলঙ্কের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাপক ভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে। গোটা বিশ্বে ২০১৯ সালটি ছিল গত ১৪০ বছরে দ্বিতীয় উষ্ণতম। নিউ ইয়র্কে নাসার ‘গর্ডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ (জি.আই.এস.এস.)’ এর অধিকর্তা গ্যাভিন স্মিথ বলেছেন — গত দেড়শ বছরে সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছিলো আমাদের সদ্য ফেলে আসা দশকেই। যার মধ্যে গত পাঁচ বছরের মত গরম আর কখনো পড়েনি গত দেড় শতাব্দীতে। সম্প্রতি নাসা এবং ন্যাশনাল ওশেনিক এন্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন (NOAA) -এর পরিসংখ্যান এই কথা জানিয়েছে। সেই পরিসংখ্যানে এটাও আছে যে, তাপমাত্রার নিরিখে ১৮৮০ সাল থেকে বিশ্বের উষ্ণতম বছর হল ২০১৬ এবং তারপরেই ২০১৯। এই উষ্ণতা ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে তাঁরা অবশ্য অবিমৃষ্যকারী মানুষের কার্য্যের ফলে উদ্ভূত বিশ্ব উষ্ণায়নকেও বিশেষভাবে দায়ী করেছেন। (Solar Maximum & Solar Minimum)
সোলার মিনিমাম বা মন্ডার মিনিমাম:
সোলার ম্যাক্সিমাম পর্যায়ে সানস্পটগুলি একটি নির্দিষ্ট শীর্ষে পৌঁছনোর পর আবার ধীরে ধীরে কমতে কমতে তার সংখ্যা পৌঁছায় পতনের শেষ বিন্দুতে। ন্যূনতম সৌরকলঙ্কের এই সময়কে সোলার মিনিমাম বা মন্ডার মিনিমাম (Maunder Minimum) নামে অভিহিত করা হয়। সূর্যের অভ্যন্তরের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি দূর্বল হয়ে পড়ে। ক্রমশঃ কমতে থাকে সূর্যের তেজ। এর ফলে পৃথিবী ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করে। আর এই সোলার মিনিমাইজেশন যদি এক নাগাড়ে বেশ কয়েকবছর বা কয়েক দশক ধরে চলে, তাহলে পৃথিবীতে নেমে আসে ‘লিটল আইস এজ’ বা ‘মিনি আইস এজ’ -এর মত পরিস্থিতি। ‘মিনি আইস এজ’ হল এমন একটি অবস্থা, যখন সূর্যের তেজ এবং উত্তাপ দুটোই কমতে শুরু করে এবং ফল স্বরূপ ভয়ঙ্কর ঠান্ডা হয়ে পড়ে পৃথিবী। অবশ্য এর প্রভাব পৃথিবীর সবজায়গায় সমান ভাবে পড়ে না। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল থেকে দুই মেরু অঞ্চলের দিকেই এর প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এর আগে ভয়ানক প্রভাব দেখা গিয়েছিল কানাডা, আইসল্যান্ড এবং ইউরোপের বহু দেশে। ইউরোপের টেমস সহ প্রায় সব নদীই বরফে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সেই ঝিমিয়ে পড়া সূর্য প্রায় ১৬৪৬ সাল থেকে ১৭১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ষাট বছর ধরে অর্থাৎ পর পর প্রায় পাঁচ ছয়টি সোলার সাইকেল বা সৌরচক্র ধরে বিরাজ করেছিল। অনেক বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রায় ৩০০ বছর পর পর এই ধরণের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে পারে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ২℃ থেকে ৫℃ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, মহাজাগতিক রশ্মি আসার ফলে মহাকাশে প্রভাব পড়বে, মহাকাশচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, ভূমিকম্প ও বজ্রপাতের সংখ্যাও বহুল পরিমাণে বেড়ে যেতে পারে। দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর মতো ভয়ানক দুর্যোগও বেড়ে যেতে পারে। সূর্যের এমন কর্মক্ষমতা হ্রাসের ফলে ‘ডাল্টন মিনিমাম’ -এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। নাসার বিজ্ঞানীরা একে সূর্যের এক প্রকার লকডাউন বলেই অভিহিত করেছেন। (Solar Maximum & Solar Minimum)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পুরুলিয়া জেলার জীববৈচিত্র্য
তমসো মা জ্যোতির্গময়:
পরিশেষে বলি, কিছু বিজ্ঞানী ও কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমের দাবি, এখনই এই সোলার মিনিমাইজশনের কোনো সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ ২০১৩ ও ২০১৫ সাল থেকেই এই ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রবক্তারা সৌর কলঙ্কের সাথে আবহাওয়া মন্ডলের তাপমাত্রা বাড়া কমার সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ বিগত এক শতাব্দী ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে হার লক্ষ্য করা গেছে, তাতে সৌর কলঙ্ক কমা বাড়ার সম্পর্কের চেয়ে গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। হিমবাহের গলন, বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তন, আর্দ্রতার হ্রাসবৃদ্ধি, ঋতুপর্যায়ের খামখেয়ালি ভাব — এগুলি ধীরে ধীরে পর্যায় ক্রমে আসছে, আকস্মিক ভাবে আসেনি।
তবে সমগ্র বিজ্ঞানীমহল সাম্প্রতিক কালে জলবায়ু পরিবর্তনের একটা আশঙ্কা করে চলেছেন। এই পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ ও জীবজগতের উপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। কারণ বর্তমানে পরিবেশে যে অদ্ভুত পরিবর্তন এবং প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যাচ্ছে, তা মোটেই এড়িয়ে যাবার নয়। কোনো কোনো গবেষক ২০৩১ সালকে পরবর্তী সৌর চক্র বা সোলার সাইকেলের পরিবর্তনের বছর হতে পারে বলে সময়সীমা ধার্য করেছেন। পরবর্তী সোলার মিনিমাম পর্যায়ের শুরু ২০২০, ২০২১ কিংবা ২০৩১ যাই হোক না কেন, সানস্পট বা সৌরকলঙ্ক হ্রাসের ফলে তাপমাত্রার পতন যে অনিবার্য, তা অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। সেই পতন যে আদৌ ‘গ্র্যান্ড’ হবে কিনা, তা শুধুই সময়ের অপেক্ষা। তবে সময়ের সাথে সাথেই জলবায়ুর পরিবর্তন, উষ্ণায়ন, শীতলীকরণ এগুলি প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই আসবে। মানব সভ্যতার গতি স্তব্ধ যেন না হয়, আমরা চাই উষ্ণায়ন থাকুক তার সীমারেখা মেনে। অতিরিক্ত উষ্ণতা হ্রাস বা তুষার যুগের পথে পা বাড়ানো যে মনুষ্য সভ্যতার পক্ষে মঙ্গলময় নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা সবসময়ই আলোর পথযাত্রী …‘তমসো মা জ্যোতির্গময়:…’। (Solar Maximum & Solar Minimum)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- অনিন্দিতা সাউ (খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; Forbes ; The Express (UK) ; The Daily Star (UK) ; The Pennsylvania State University ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; জি নিউজ ; বিকাশপিডিয়া ; বর্ষা বৃষ্টি নিম্নচাপ – অজয় নাথ
Khub Valo…
Pingback: Mini Sundarban of Purulia - ভূগোলিকা-Bhugolika
Awesome!
ধন্যবাদ ❤️
অনেক কিছু জানতে পারলাম প্রতিবেদনটা পড়ে। দুর্দান্ত হয়েছে এবং অত্যন্ত জরুরী এবং আকর্ষণীয় একটি বিষয় নিয়ে আজ অনেক কিছু জানতে পারলাম। খুব ভালো লাগলো পড়ে। Solar Maximum/Minimum সম্বন্ধে সেরকম কোনো Concrete Idea ছিলনা। কিন্তু বিষয়টা একটু কঠিন হলেও, আপনার লেখা ও তার সঙ্গে Proper Explanation with Reference -এর জন্য একদম সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। অসংখ্য শুভেচ্ছা রইলো এবং আগামীদিনে এরকম আরো অনেক নতুন বিষয় আপনার লেখা থেকে জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
ধন্যবাদ ❤️
Pingback: Colour Hill of Purulia - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Geographical Indication - Mangoes of Malda - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: DurgaPuja in Kolkata - Recognition of UNESCO - ভূগোলিকা-Bhugolika