Topic – Karst Landforms Speleothem
প্রসঙ্গ – কার্স্ট ভূমিরূপ স্পেলিওথেম
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Topic – Karst Landforms Speleothem । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি কার্স্ট ভূমিরূপ স্পেলিওথেম সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

প্রধানত চুনাপাথর (Limestone) শিলাগঠিত অঞ্চলে ভৌমজলের দ্রবণকার্যের ফলে ভূপৃষ্ঠীয় ও উপপৃষ্ঠীয় শিলাতে যে বৈচিত্র্যময়, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, তাকে ‘কার্স্ট ভূমিরূপ’ (Karst Landforms) বলে। কার্স্ট অঞ্চলে ক্ষয়জাত এবং সঞ্চয়জাত — উভয়প্রকার ভূমিরূপই দেখা যায়। চুনাপাথর গঠিত ভূগহ্বর বা গুহাতে চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ ও জলপ্রবাহের ক্যালশিয়াম কার্বনেট সৃষ্ট সমস্তপ্রকার সঞ্চয়জাত ভূমিরূপকে একত্রে ‘স্পেলিওথেম’ (Speleothem) বলে। অনেকে একে ‘কেভ ট্র্যাভারটাইন’ (Cave Travertine) বলে থাকেন। স্পেলিওথেম (Speleothem) শব্দটির অর্থ হল গুহা সঞ্চয়, যা দুটি গ্রিক শব্দ ‘স্পেলাইয়ন’ (Spelaion) অর্থে গুহা (Cave) এবং ‘থেমা’ (Thema) অর্থে সঞ্চয় (Deposit) থেকে এসেছে। স্পেলিওথেম প্রধানত ৪ প্রকারের হয়। যথা : পাতন প্রস্তর (Drip Stone), প্রবাহ প্রস্তর (Flow Stone), প্রান্ত প্রস্তর (Rim Stone) এবং গুহা স্ফটিক (Cave Crystal)। স্পেলিওথেম ভূমিরূপের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল পাতন প্রস্তর।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পর্যটন – রায়দিঘির জটার দেউল
ভূগর্ভে চুনাপাথরের গুহার ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে যে ভূমিরূপগুলি গঠিত হয়, তাদের ‘পাতন প্রস্তর’ বলে। উদাহরণ – স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট। ভূগর্ভে চুনাপাথরের গুহার দেওয়ালে বা মেঝেতে প্রবহমান জলের দ্বারা যে ভূমিরূপগুলি গঠিত হয়, তাদের ‘প্রবাহ প্রস্তর’ বলে। উদাহরণ – কেভ বেকন। ভূগর্ভে চুনাপাথরের গুহাবক্ষে উপচে পড়া জলপ্রবাহের দ্বারা গুহার প্রান্তদেশে যে ভূমিরূপগুলি গঠিত হয়, তাদের ‘প্রান্ত প্রস্তর’ বলে। উদাহরণ – ধাপ অববাহিকা। ভূগর্ভে চুনাপাথরের গুহার ছাদে বা দেওয়ালে গুচ্ছাকারে স্ফটিকাকার যে ভূমিরূপগুলি গঠিত হয়, তাদের ‘গুহা স্ফটিক’ বলে। উদাহরণ – অ্যানথোডাইট। (Topic – Karst Landforms Speleothem)
স্পেলিওথেম ভূমিরূপ গড়ে উঠতে সুদীর্ঘকাল সময় লাগে। যেকোনো প্রকার স্পেলিওথেম ভূমিরূপ প্রতি বছর মাত্র কয়েক মিলিমিটার বৃদ্ধি পায়। উল্লেখযোগ্য স্পেলিওথেম ভূমিরূপগুলি হল — (১) স্ট্যালাকটাইট (Stalactite), (২) স্ট্যালাগমাইট (Stalagmite), (৩) হেলিকটাইট (Helictite), (৪) হেলিগমাইট (Heligmite), (৫) ড্রেপ বা কার্টেন (Drape/Curtain), (৬) স্ট্যালাগনেট বা স্তম্ভ (Stalagnate/Column/Pillar), (৭) কেভ বেকন (Cave Bacon), (৮) ধাপ অববাহিকা (Terrace Basin), (৯) অ্যানথোডাইট (Anthodite), (১০) মুনমিল্ক (Moonmilk) প্রভৃতি। (Topic – Karst Landforms Speleothem)
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সুন্দরবনের মাতলা নদী
(১) স্ট্যালাকটাইট : ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জল চুনাপাথরকে দ্রবীভূত করে এবং চুনমিশ্রিত জল গুহার ছাদ ও দেওয়ালে অসংখ্য ফাটল ও দারণের মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে নিচে নামে। এইরূপ ঝুলন্ত ফোঁটার জল বাষ্পীভূত হলে ক্যালশিয়াম কার্বনেট সঞ্চিত হয়। এইভাবে গুহার ছাদ থেকে মেঝের দিকে সৃষ্ট ঝুলন্ত, সরু ও তীক্ষ্ণ, চুনের ঝুরি বা কীলক মতো সঞ্চয়কে স্ট্যালাকটাইট বলে। স্ট্যালাকটাইট গুহার ছাদের দিকে স্থূল এবং মেঝের দিকে তীক্ষ্ণ হয়। স্ট্যালাকটাইট (Stalactite) শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘স্ট্যালাকটস’ (Stalaktos) অর্থে ঝুলন্ত থেকে এসেছে। সপ্তদশ শতকে ড্যানিশ চিকিৎসক ওলে ওর্ম (Ole Worm) সর্বপ্রথম স্ট্যালাকটাইট শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘Stalactite’ শব্দের ‘C’ অক্ষরটি ‘Ceiling’ অর্থাৎ ছাদকে নির্দেশ করে। লেবাননের জেইটা গ্রোটোর উর্দ্ধ গুহার হোয়াইট চেম্বারে বিশ্বের দীর্ঘতম স্ট্যালাকটাইট (World’s Longest Stalactite) রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট। আয়ারল্যান্ডের ডুলিন গুহাতে দীর্ঘাকার স্ট্যালাকটাইট রয়েছে। ভারতের মেঘালয়ের মোসামাই গুহাতেও স্ট্যালাকটাইট দেখা যায়। অনেকসময় একই সাথে একাধিক খুবই সরু, লম্বা, ফাঁপা নলের মতো, ভঙ্গুর প্রকৃতির স্ট্যালাকটাইট গড়ে ওঠে। এগুলি ‘সোডা স্ট্র’ (Soda Straw) বা ‘নলাকার স্ট্যালাকটাইট’ (Tubular Stalactite) নামে পরিচিত। নিউজিল্যান্ডের গার্ডনার’স্ গাট গুহাতে সোডা স্ট্র দেখা যায়।
(২) স্ট্যালাগমাইট : চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ গুহার ছাদ থেকে গুহার মেঝেতে পড়ে এবং জল বাষ্পীভূত হলে ক্যালশিয়াম কার্বনেট সঞ্চিত হয়। এইভাবে গুহার মেঝেতে ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত ক্যালশিয়াম কার্বনেটের স্থূলাকার সঞ্চয়কে স্ট্যালাগমাইট বলে। স্ট্যালাগমাইট সাধারণত স্ট্যালাকটাইট অপেক্ষা ছোটো হয়। স্ট্যালাগমাইট গুহার মেঝের দিকে স্থূল এবং ছাদের দিকে সরু হয়। স্ট্যালাগমাইট (Stalagmite) শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘স্ট্যালাগমিয়াস’ (Stalagmias) অর্থে পতিত থেকে এসেছে। সপ্তদশ শতকে ড্যানিশ চিকিৎসক ওলে ওর্ম (Ole Worm) সর্বপ্রথম স্ট্যালাগমাইট শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘Stalagmite’ শব্দের ‘G’ অক্ষরটি ‘Ground’ অর্থাৎ মেঝেকে নির্দেশ করে। ভিয়েতনামের সন ডুং গুহাতে বিশ্বের দীর্ঘতম স্ট্যালাগমাইট (World’s Longest Stalagmite) রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ২৩০ ফুট। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কার্লসবাড গুহার ‘ডাইনির আঙুল’ (Witch’s Finger) একটি বিখ্যাত স্ট্যালাগমাইট। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের বোরা গুহাতেও স্ট্যালাগমাইট দেখা যায়।
(৩) (৪) হেলিকটাইট এবং হেলিগমাইট : অনেকসময় চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ বাষ্পীভূত হয়ে ক্যালশিয়াম কার্বনেট যখন গুহার ছাদে বা মেঝেতে উল্লম্বভাবে সঞ্চিত না হয়ে অনুভূমিক বা তির্যক বা এলোমেলোভাবে বিভিন্ন আকৃতিতে সঞ্চিত হয়। গুহার ছাদে এইরূপ সঞ্চয়কে হেলিকটাইট এবং গুহার মেঝেতে এইরূপ সঞ্চয়কে হেলিগমাইট বলে। স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট অপেক্ষা হেলিকটাইট ও হেলিগমাইট ক্ষুদ্র আকৃতির হয়। ‘Helictite’ শব্দের ‘C’ অক্ষরটি ‘Ceiling’ অর্থাৎ ছাদকে এবং ‘Heligmite’ শব্দের ‘G’ অক্ষরটি ‘Ground’ অর্থাৎ মেঝেকে নির্দেশ করে। ছোটো ও গোলাকৃতির হেলিকটাইটকে গ্লোবুলাইট (Globulite) বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সোনোরা গুহাতে হেলিকটাইট ও হেলিগমাইট দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার জেনোলান গুহাতেও হেলিকটাইট ও হেলিগমাইট দেখা যায়।
(৫) ড্রেপ বা কার্টেন : চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ যখন গুহার ছাদ থেকে পরপর একাধিক লম্বা স্ট্যালাকটাইট সৃষ্টি করে এবং সমগ্র ভূমিরূপটি দেখতে খাঁজকাটা বা ঢেউ খেলানো পর্দার মতো দেখতে হয়, তখন তাকে ড্রেপ বা কার্টেন বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের লুরে গুহাতে ; চিনের সেভেন স্টার গুহাতে ড্রেপ বা কার্টেন দেখা যায়।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – আলেয়ার আলো
(৬) স্ট্যালাগনেট বা স্তম্ভ : অনেকসময় গুহার ছাদে সৃষ্ট স্ট্যালাকটাইট এবং গুহার মেঝেতে সৃষ্ট স্ট্যালাগমাইট ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে একসাথে মিলিত হয় এবং এক বিশেষ প্রকার স্তূপাকার ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, যা স্ট্যালাগনেট বা স্তম্ভ নামে পরিচিত। একটি স্তম্ভ সৃষ্টি হলে, জলীয় দ্রবণ স্তম্ভের গা বেয়ে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে স্তম্ভের উপরের অংশটি সরু এবং নিচের অংশটি স্থূল আকৃতি ধারণ করে। স্পেনের নেরজা গুহাতে ; ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের বোরা গুহাতে স্ট্যালাগনেট বা স্তম্ভ দেখা যায়।
(৭) কেভ বেকন : চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ বাষ্পীভূত হয়ে গুহার দেওয়ালে অনেকসময় পাতলা পর্দার মতো আস্তরণ সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এই পর্দার ওপর ধূসর ও বাদামি রঙের স্তর দেখা যায়, যা অনেকটা বেকন (একপ্রকার মাংস বিশেষ) -এর মতো দেখতে হয়। এইরূপ রঙিন স্তরযুক্ত পর্দাকে কেভ বেকন বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলোসাল গুহাতে ‘কেভ বেকন’ দেখা যায়।
(৮) ধাপ অববাহিকা : চুনাপাথরের গুহাবক্ষে উপচে পড়া জলপ্রবাহ অনেকসময় গুহার প্রান্তদেশে ধাপযুক্ত অববাহিকা সৃষ্টি করে, যা ধাপ অববাহিকা নামে পরিচিত। লাওসের জে বাং ফাই গুহাতে ধাপ অববাহিকা দেখা যায়।
(৯) অ্যানথোডাইট : চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ বাষ্পীভূত হয়ে অনেকসময় গুহার ছাদে বা দেওয়ালে লম্বা সূঁচের মতো স্ফটিক রূপে গুচ্ছাকারে সঞ্চিত হয়। ফুলের পাপড়ির মতো দেখতে এইরূপ সঞ্চয়কে অ্যানথোডাইট বলে। অ্যানথোডাইট (Anthodite) শব্দটি গ্রিক শব্দ অ্যানথোস (Anthos) অর্থে ফুল থেকে এসেছে। জাপানি গবেষক এন. কাশিমা ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক রচনাতে অ্যানথোডাইট শব্দটি ব্যবহার করেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্কাইলাইন গুহাতে ; ফ্রান্সের গ্রোটে ডি মৌলিস গুহাতে অ্যানথোডাইট দেখা যায়।
(১০) মুনমিল্ক : চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ বাষ্পীভূত হয়ে সূক্ষ্ম স্ফটিক অনেকসময় গুহার ছাদে বা দেওয়ালে সাদা রঙের, ক্রিমের মতো সঞ্চয় তৈরি করে, যা মুনমিল্ক নামে পরিচিত। এটি আবার কেভমিল্ক (Cavemilk) নামেও পরিচিত। তবে অনেকের মতে, ব্যাকটেরিয়ার কার্যে মুনমিল্ক তৈরি হয়। অস্ট্রিয়ার বার্গমিলচকামের গুহাতে মুনমিল্ক সঞ্চয় দেখা যায়।
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-II]
লেখিকা : তানিয়া খাতুন (চাঁপাডাঙা, হুগলি)
তথ্যসূত্রঃ- Speleothems/Encyclopedia of Caves ; National Geographic ; Speleothem/NCEI-NOAA ; National Park Service (NPS)/USA
Pingback: Height Growth of Mount Everest - ভূগোলিকা-Bhugolika
খুব সুন্দর লেখাটা
শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো
পড়ে সমৃদ্ধ হলাম!
ধন্যবাদ ❤️
Excellent
Pingback: World's 50 Important Straits - Part-I - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Blood Falls of Antarctica - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Janda's Alur Dum's Fair of Hooghly - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: WBPSC ASSISTANT MASTER/MISTRESS GEOGRAPHY SYLLABUS - ভূগোলিকা-Bhugolika