Hansuli Bank – Literature & Geography
হাঁসুলী বাঁক – সাহিত্য ও ভূগোল
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Hansuli Bank – Literature & Geography । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সাহিত্য ও ভূগোলের প্রেক্ষাপটে বীরভূমের হাঁসুলী বাঁক সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

কিংবদন্তী সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) রচিত ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (Hansuli Banker Upakatha) বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী উপন্যাস। ১৯৪৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ বার্ষিক দুর্গা উৎসব সংখ্যায় এই উপন্যাসের প্রথম সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়কালে (১৯৪৬-৫১) এই উপন্যাসটি একাধিকবার সম্প্রসারিত ও সংশোধিত হয়ে বেশ কয়েকটি সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসের মূল পটভূমি হল কোপাই নদী (Kopai River)-এর তীরে কাহার জাতির বসতি বাঁশবাদি গ্রাম। লেখক তন্নিষ্ঠ বাস্তবতায় চিত্রিত করেছেন তৎকালীন সমাজ জীবন ও সংস্কৃতিকে। তবে, ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণে সবকিছু ছাপিয়ে উঠে এসেছে এ উপন্যাসের শিরোনামে ব্যক্ত নদীবাঁক, ‘হাঁসুলী বাঁক’ (Hansuli Bank)। তারাশঙ্করের এই উপন্যাসকে ভিত্তি করে ১৯৬২ সালে মুক্তি পায় তপন সিনহা (Tapan Sinha) পরিচালিত বাংলা সিনেমা ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। চলচিত্রায়িত হওয়ার পরে বহুল প্রচারে জনমানসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে হাঁসুলী বাঁক।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সময়ের সাথে হ্রাসপ্রাপ্ত সুন্দরবন
তারাশঙ্করের জন্মভিটে থেকে সাড়ে তিন-চার কিলোমিটার দূরে কোপাই নদী (Kopai River) ও বক্রেশ্বর নদী (Bakreshwar River) পরিবেষ্টিত একটি সুন্দর মনোরম জায়গার নাম হাঁসুলী বাঁক। প্রশ্ন হল, এই নদীবাঁকের নাম হাঁসুলী বাঁক কেন? এবিষয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে লিখেছেন, ‘কোপাই নদীর প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় যে বিখ্যাত বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক—অর্থাৎ যে বাঁকটায় অত্যন্ত অল্প-পরিসরের মধ্যে নদী মোড় ফিরেছে, সেখানে নদীর চেহারা হয়েছে ঠিক হাঁসুলী গয়নার মত। বর্ষাকালে সবুজ মাটিকে বেড় দিয়ে পাহাড়িয়া কোপাইয়ের গিরিমাটিগোলা জলভরা নদীর বাঁকটিকে দেখে মনে হয়, শ্যামলা মেয়ের গলায় সোনার হাঁসুলী; কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে জল যখন পরিষ্কার সাদা হয়ে আসে—তখন মনে হয় রূপোর হাঁসুলী। এই জন্যে বাঁকটার নাম হাঁসুলী বাঁক’ (হাঁসুলী বাঁকের উপকথা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)। বীরভূম জেলার লাভপুর থেকে ৩.৫ কিমি পশ্চিমে, পশ্চিম কাদিপুর গ্রামের নিকট কোপাই ও বক্রেশ্বের নদীর সঙ্গমস্থলে এই হাঁসুলী বাঁক অবস্থিত। মিলনপুরের নিকট কোপাই নদী বক্রেশ্বর নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। দুই নদীর মিলনস্থলের কাছে অবস্থান, তাই নাম হয়েছে মিলনপুর (Milanpur)। কোপাই আর বক্রেশ্বরের মিলনস্থল দুমনি ঘাট নামে পরিচিত। এরপর কোপাই ও বক্রেশ্বর নদীর মিলিত প্রবাহ কুঁয়ে নদী নামে লাঘাটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। লাঘাটা (Laghata) হল অতীতের নদীবন্দর। অতীতে এই লাঘাটা থেকে নদীপথে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় নৌকাযোগে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ওঠানামা করত।
👉 Special Post : Emerging Geographical Terms
এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নদীখাত বেশ কয়েকটি বাঁক নিয়েছে। ভূগোলের ভাষায় যাকে বলে নদীবাঁক বা মিয়েন্ডার (Meander)। এই অংশে নদী উপত্যকা যথেষ্ট সংকীর্ণ কিন্তু নদীখাতের ঢাল যথেষ্ট খাড়া। যা সম্পূর্ণ রূপে সমভূমি অঞ্চলের নদ-নদীর সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী। স্থানে স্থানে কঠিন ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার অবস্থান এই ধরনের নদীখাত সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হয়। নদীবাঁকগুলি দেখতে অর্ধচন্দ্রাকার, অনেকটা হাঁসুলী হারের মতো। ভূমিরূপগত ভাবে, এই নদীবাঁকগুলি থেকে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ (Oxbow Lake) তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, বর্ষাকালে মাত্রাতিরিক্ত জলপ্রবাহের কারণে নদীখাত দুকূল ছাপিয়ে প্লাবনের সৃষ্টি করে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে উল্লেখিত সে গ্রামের অস্তিত্ব এখন আর নেই, বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে। উপন্যাসে বর্ণিত কোপাই তীরের ঘনজঙ্গল, বাঁশবন, কুলকাঁটা ও শ্যাওড়ার ঝোপ কালের নিয়মে আজ নিশ্চিহ্ন। কিন্তু রয়ে গেছে হাঁসুলী বাঁক। তবে, বাঙালির চেতনায় ঠাঁই নেওয়া সেই হাঁসুলী বাঁকই আজ সঙ্কটে।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জীবাশ্ম উদ্যান
হাঁসুলী বাঁকের মাঝখানে তৈরি হয়েছে অতিকায় এক ইটভাটা (Brick Kiln)। অনতিদূরেই রয়েছে আরও একটি ইটভাটা। যত্রতত্ৰ নদী বাঁক থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে ভূমিক্ষয় (Land Erosion) বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিপন্ন হতে চলেছে হাঁসুলি বাঁক। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার। ইটভাটার কারনে নদীতীরে যেভাবে অবৈধ মাটিকাটা চলছে তাতে প্রশাসন উদ্যোগী না হলে হাঁসুলী বাঁকের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে বাধ্য। গত বছর জুলাইতে বীরভূম জেলা প্রশাসন হাঁসুলী বাঁক-কে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগী হয়েছিল। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, তৈরি করা হবে নদী সংলগ্ন একটি পুকুরে বোটিংয়ের ব্যবস্থা, পিকনিক স্পট, ফুলের বাগান, ওয়াচ টাওয়ার ইত্যাদি। আগত পর্যটকদের জন্য পানীয়জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থাও করা হবে। কিন্তু পরিকল্পনা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। শুধুমাত্র লাভপুর পুরানো বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁসুলী বাঁক পর্যন্ত একটি সাড়ে তিন কিমি দৈর্ঘ্যের রাস্তা প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা-তে তৈরি হয়েছে। আর একটি পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। প্রশাসন যদি ইটভাটা গুলিকে হাঁসুলি বাঁক থেকে একটু দূরে স্থানান্তরিত করে এবং পর্যটকদের জন্য সেখানে একটা টাওয়ার ও বিশ্রামঘর নির্মাণ করে এবং পানীয়জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করে, তাহলে হাঁসুলী বাঁক বেঁচে যাবে। হাঁসুলী বাঁককে একটু সাজিয়ে তুললে, পর্যটকের সংখ্যাও অনেক বাড়বে। এখানকার পর্যটন শিল্প চাঙ্গা হলে, স্থানীয় বেকার যুবসমাজেরও আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া, হাঁসুলী বাঁকের সাথে এই অঞ্চলের মানুষের আবেগ ও অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাই হাঁসুলী বাঁক-কে রক্ষা করতে প্রশাসন উদ্যোগী হোক। (Hansuli Bank – Literature & Geography)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখকঃ- সঞ্জয় দে (কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান)
তথ্যসূত্রঃ- হাঁসুলী বাঁকের উপকথা – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; সংবাদ প্রতিদিন ; এই সময় ; লেখক কর্তৃক জানুয়ারী, ২০২২-তে হাঁসুলী বাঁক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় বাসিন্দা সোমনাথ দাস (লাভপুর, বীরভূম) কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যাদি
Pingback: Past-Present-Future of Sundarban - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Israel's Salt Cave Malham - ভূগোলিকা-Bhugolika