Sunday, June 8, 2025

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভূগোলিকা-Bhugolika

ভূগোল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান

ভৌগোলিক প্রবন্ধ

Mayurjharna Elephant Reserve

ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ

ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Mayurjharna Elephant Reserve । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণবঙ্গের একমাত্র এলিফ্যান্ট রিজার্ভ — ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

Mayurjharna Elephant Reserve
বামদিকে : ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভের মানচিত্র এবং ডানদিকে : প্রদর্শন ফলক

যে সংরক্ষিত এলাকা হাতির আবাসস্থল হিসেবে ব্যবস্থাপন ও সংরক্ষণ করা হয়, তাকে হস্তী সংরক্ষিত এলাকা বা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ বলে। এলিফ্যান্ট রিজার্ভ গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্যগুলি হল — হাতির খন্ডিত আবাসস্থলকে পুনরুজ্জীবিত করা, মানুষ-হাতি সংঘর্ষ (Human-Elephant Conflict/HEC) কমানো এবং বনাঞ্চলের মধ্যেই হাতিকে আবদ্ধ রাখা। IUCN কর্তৃক বিপন্ন (Endangered) প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত ভারতীয় হাতি (বৈজ্ঞানিক নাম : Elephas maximus indicus) -কে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারত সরকার ১৯৯২ সালে ‘প্রজেক্ট এলিফ্যান্ট’ (Project Elephant) কর্মসূচী শুরু করে। এই কর্মসূচীর আওতায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এলিফ্যান্ট রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়। বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ২ টি এলিফ্যান্ট রিজার্ভ রয়েছে — তারই একটি হল ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ (Mayurjharna Elephant Reserve)। পশ্চিমবঙ্গের অপর এলিফ্যান্ট রিজার্ভটি হল পূর্ব ডুয়ার্স এলিফ্যান্ট রিজার্ভ (Eastern Dooars Elephant Reserve)। ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ হল দক্ষিণবঙ্গের একমাত্র হস্তী সংরক্ষিত এলাকা (Only Elephant Reserve in South Bengal)। আবার আয়তন অনুসারে, এটিই হল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্রতম হস্তী সংরক্ষিত এলাকা (West Bengal’s Smallest Elephant Reserve)

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – মেঘেদের পরিচিতি

জঙ্গলমহল কেন্দ্রিক এই এলিফ্যান্ট রিজার্ভটি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা — ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার ত্রিসীমানায় অবস্থিত। ঝাড়গ্রাম জেলার অরণ্যসংকুল ময়ূরঝর্ণা গ্রাম (Mayurjharna Village) -এর নামেই এই এলিফ্যান্ট রিজার্ভের নামকরণ করা হয়েছে। চাকাডোবা থেকে সড়কপথে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার পথে রয়েছে ময়ূরঝর্ণা গ্রাম। ময়ূরঝর্ণা নাম হলেও, এখানে তেমন কোনো বড়ো ঝর্ণা নেই। ময়ূরঝর্ণার পাহাড় ও জঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। অনেক পর্যটক ময়ূরঝর্ণা থেকে সূর্যাস্তের শোভা দেখতে আসেন। ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার ত্রিসীমানায় অবস্থিত এই অরণ্য অঞ্চলকে ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘এলিফ্যান্ট রিজার্ভ’ হিসেবে ঘোষণা করে। ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভের আয়তন ৪১৪.০৬ বর্গকিমি এবং সংলগ্ন ১৪৩৬ বর্গকিমি অঞ্চলকে এই রিজার্ভের ‘প্রভাবিত অঞ্চল’ (Zone of Influence) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই এলিফ্যান্ট রিজার্ভের সীমানা নির্ধারিত হয় – পূর্বদিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড় ও শালবনী ব্লক; পশ্চিমদিকে ঝাড়খন্ডের দলমা হাতি সংরক্ষণ কেন্দ্র; উত্তর দিকে পুরুলিয়ার মানবাজার ব্লক, বাঁকুড়ার সিমলাপাল, তালডাংরা ও খাতড়া ব্লক এবং দক্ষিণ দিকে ঝাড়গ্রামের বিনপুর-১, বিনপুর-২ ব্লক, বাঁকুড়ার রাইপুর ব্লক।

ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ পশ্চিমবঙ্গ বন দফতরের ঝাড়গ্রাম বিভাগ -এর (পূর্বতন পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ) কাঁকড়াঝোর, ময়ূরঝর্ণা, বাঁশপাহাড়ি ও ভুলাভেদা বন ব্লক (১৩১.৫০ বর্গকিমি এলাকা) এবং কংসাবতী সয়েল কনজারভেশন বিভাগ-২-এর পোপো, বারুডি, কুইলাপাল (পি) ইত্যাদি বন ব্লক (৮৮.৫০ বর্গকিমি এলাকা), ঝাড়গ্রাম বিভাগ -এর (পূর্বতন পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ) শিয়ারবিন্দা, ওদলচুয়া, জলপুকুরিয়া ও বেলপাহাড়ি বন ব্লক (৬৪.৫৬ বর্গকিমি এলাকা) এবং কংসাবতী সয়েল কনজারভেশন বিভাগ-২-এর কুইলাপাল (পি), নান্না, ধাদকা ও কুচিপাড়া বন ব্লক (৩৮ বর্গকিমি এলাকা) এবং বাঁকুড়া দক্ষিণ বিভাগ -এর রানিবাঁধ, মটগোদা (পি) ছেঁদাপাথর ইত্যাদি বন ব্লক (৯১.৫০ বর্গকিমি এলাকা) নিয়ে গঠিত। ১৪৩৬ বর্গকিমি আয়তনের ‘প্রভাবিত অঞ্চল’- এর অন্তর্গত অরণ্য অঞ্চলগুলি হল – ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড়; পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আরাবাড়ি, নয়াবসাত, গোদাপিয়াশাল, গড়বেতা, হুমগড়, গোয়ালতোড়; বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী, বিষ্ণুপুর, জয়পুর, মটগোদা, তালডাংরা, সারেঙ্গা।

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : অধিবর্ষের ইতিকথা

ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভে হাতির সংখ্যা ১৯৮৭ সালে ছিল ৪৫-৪৭ টি। ২০০৫ সালে ৯৬ টি। ২০১০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১১৮ টি। ২০১৭ সালের হাতি শুমারি অনুসারে, এই এলিফ্যান্ট রিজার্ভে হাতির সংখ্যা ১৯৮ টি। ইন্টারন্যাশনাল এলিফ্যান্ট ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, এর মধ্যে ১৫৩ টি পরিযায়ী হাতি (Migratory Elephant), যারা মূলত পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খন্ডের অরণ্য অঞ্চল থেকে প্রতি বছর জঙ্গলমহলের অরণ্যে পরিযান করে। ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভের অরণ্যে প্রধানত শাল, পিয়াল, কেন্দু, মহুয়া, সেগুন, শিমূল, পলাশ, সোনাঝুরি, শিরিষ, কুসুম, আকাশমণি প্রভৃতি উদ্ভিদ দেখা যায়। আর শুধু হাতি নয়, এই অরণ্যে প্রাণী বৈচিত্র্যও নেহাৎ কম নয়। শিয়াল, বাঁদর, হরিণ, ভালুক, হায়েনা, বন্য শূকর, খরগোশ, খাটাশ, বেজি, গোসাপ, অজগর সাপ, ময়ূর ও পেঁচা সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি প্রভৃতি দেখা যায়। এমনকি ২০১৮ সালে লালগড়ের জঙ্গলে রয়‍্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলেছিল, যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের হাতে বাঘটি মারা যায়। ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভের অন্তর্গত কাঁকড়াঝোর, বেলপাহাড়ি (ঝাড়গ্রাম জেলা); রানিবাঁধ (বাঁকুড়া জেলা); কুইলাপাল (পুরুলিয়া জেলা) প্রভৃতি অঞ্চলে প্রকৃতি ও অরণ্য কেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। (Mayurjharna Elephant Reserve)

ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ গঠনের মূল কারণ হল সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়ন। যাতে স্থায়ী বসবাসকারী এবং পরিযায়ী (মূলত ঝাড়খন্ডের দলমা অরণ্য থেকে আগত) হাতির দলকে ভাল ভাবে সংরক্ষণ করা যায়। একই সঙ্গে মানুষ-হাতি সংঘাত কমানো। ২০২২ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রের তথ্য অনুসারে, এপ্রিল-২০১০ থেকে মার্চ-২০১৯ পর্যন্ত সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে মানুষ-হাতি সংঘর্ষের পরিসংখ্যান হল নিম্নরূপ — ৭২৬ জন মানুষের মৃত্যু, ১২৩৩ জন মানুষ আহত, ৫১,৫৪২.০২৭ হেক্টর কৃষিজমির ফসল নষ্ট, ৩৪,৪৪৬ টি বাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণ রূপে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১৩৬ টি হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু। এই সময়কালে হাতির হানায় সরকার প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ৫৯.০৯ কোটি টাকা। ইন্ডিয়া টুডে (India Today) সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন (২০২৪) অনুসারে, ২০১৯ থেকে অক্টোবর-২০২৪ পর্যন্ত সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে ১১৬ টি হাতির মৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে ৫০ টি হাতির মৃত্যু অস্বাভাবিক। হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণগুলি হল — তড়িতাহত (Electrocution) হয়ে মৃত্যু, সড়ক ও রেলপথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হত্যা (Target Killing)। আবার এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে হাতির হানাতে ৫০৭ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের অরণ্য কেন্দ্রিক এলাকাতে মানুষ-হাতি সংঘর্ষ যে ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর এর একটা বড়ো অংশই সংঘটিত হয় জঙ্গলমহলে, যা মাঝেমধ্যেই সংবাদপত্রে টুকরো খবরের আকারে প্রকাশিত হয়। এমত পরিস্থিতিতে ময়ূরঝর্ণা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ জঙ্গলমহল এলাকাতে মানুষ-হাতি সংঘর্ষ হ্রাসকরণে বিশেষ কার্যকরী হতে পারে। তবে সেজন্য এলিফ্যান্ট করিডোর নির্মাণ, ক্ষয়িষ্ণু অরণ্যে পুনর্বনায়ন, নজরদারি ও সুরক্ষা বৃদ্ধি, অরণ্যে হাতির দলের জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোগানের ব্যবস্থা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]

লেখকঃ- অরিজিৎ সিংহ মহাপাত্র (পার্শ্বলা, বাঁকুড়া)
তথ্যসূত্রঃ- বনবিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ; হাতি শুমারি ২০১৭, ভারত সরকার ; আনন্দবাজার পত্রিকা ; India Today ; Human elephant conflict in West Bengal, India: present status and mitigation measures – Rajib Majumder – European Journal of Wildlife Research 68:33(3) – June 2022 ; Wild Bengal, Government of West Bengal ; Project Report/ Conflict to Coexistence: Securing Jharkhand-West Bengal Inter-State Elephant Corridor, India – International Elephant Foundation ; সংবাদ প্রতিদিন ; Government of West Bengal, Directorate of Forest, Wildlife Wing

👉 Special Post : Emerging Geographical Terms

ভৌগোলিক প্রবন্ধ : সময়ের সাথে হ্রাসপ্রাপ্ত সুন্দরবন

7 thoughts on “Mayurjharna Elephant Reserve

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!