Declining Sundarban Over Time
সময়ের সাথে হ্রাসপ্রাপ্ত সুন্দরবন
ভূগোলিকা-Bhugolika -এর ‘ভৌগোলিক প্রবন্ধ’ বিভাগে আপনাকে স্বাগত জানাই। ভৌগোলিক প্রবন্ধে আমরা ভূগোলের নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি, যা আমাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের বিকাশে সহায়ক হয়। আজকের ভৌগোলিক প্রবন্ধ : Declining Sundarban Over Time । আশাকরি, এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনি সময়ের সাথে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের হ্রাসপ্রাপ্তি সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন।

সুন্দরবন হল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সুন্দরবনের বর্তমান আয়তন ১০,২৭৭ বর্গকিমি (জলভাগ সহ) ; যার মধ্যে ৪২৬০ বর্গকিমি ভারতের অন্তর্গত এবং ৬০১৭ বর্গকিমি বাংলাদেশের অন্তর্গত (JISCAR-২০১৩)। প্রশাসনিক ভাবে, সুন্দরবন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় এবং বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত। প্রচলিত মতে, সুন্দরী নামক ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের নাম থেকেই ‘সুন্দরবন’ নামটি এসেছে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং রামসার সাইটের অন্তর্গত সুন্দরবন অনন্য ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র, বিপুল জীববৈচিত্র্যের কারণে সুন্দরবন সারা বিশ্বে এক প্রাকৃতিক বিস্ময় রূপে পরিচিত।
মডার্ন এনভায়রণমেন্টার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধ (২০১৭) অনুসারে, ১৭৭৩ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল প্রায় ২২,৩৫৪ বর্গকিমি, যা ১৮৭৩ ও ১৯৭৩ সালে কমে দাঁড়ায় ১৬,৪৩১ ও ১০,৮০২ বর্গকিমি। আর ২০১৬ সালে সুন্দরবনের আয়তন ৯৭২৮ বর্গকিমি। অর্থাৎ গত ২৫০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন হ্রাস পেয়েছে ১২,৬২৬ বর্গকিমি (৫৬.৫%), যার মধ্যে ১০,৬৯৫ বর্গকিমি ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এতো গেল দীর্ঘকালীন প্রেক্ষাপটে ম্যানগ্রোভ নিকেশের হিসেব। সংরক্ষিত অরণ্যের মর্যাদালাভের পরও সুন্দরবন সময়ের সাথে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বিগত কয়েক দশকের তথ্য তাই বলছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওশেনোগ্রাফিক স্টাডিজ কর্তৃক প্রকাশিত ‘Mangrove Forest Cover Changes in Indian Sundarban (১৯৮৬-২০১২) Using Remote Sensing and GIS’ রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের সুন্দরবন অংশে ১৯৮৬ থেকে ২০১২ সময়কালে ১২৪ বর্গকিমি ম্যানগ্রোভ অরণ্য উজাড় হয়েছে, যা ভারতের সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ৫%! আর বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে ২০০০-২০১০ সময়কালে ৫০ হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিনষ্ট হয়েছে (SRDI, Bangladesh)।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রাকৃতিক বর্ষাতি ঘঙ
২০১৯ সালে দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরো কর্তৃক উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত দশ বছরে (২০০৯-২০১৯) ভারতীয় সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ৩.৭% বিলুপ্ত হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষয়ের কারণে ৯৯৯০ হেক্টর ভূমিভাগ চিরতরে হারিয়ে গেছে। আর যে ‘সুন্দরী’ গাছের নাম থেকেই সুন্দরবন, তার অবস্থাও করুণ। ভারতের সুন্দরবন অংশে সুন্দরী গাছের উপস্থিতি প্রায় বিরল। অধিকাংশ সুন্দরী গাছ সুন্দরবনের পূর্বাংশে অর্থাৎ বাংলাদেশের অন্তর্গত সুন্দরবনে দেখা যায়। আর ঢাকা ট্রিবিউনের এক রিপোর্ট (জুলাই, ২০১৮) বলছে, ‘টপ-ডাইং’ রোগে গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের সুন্দরবনে ১৪.৪ লক্ষ ঘনমিটার সুন্দরী গাছ বিলুপ্ত হয়েছে। অ্যাবেরিস্টউইথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও ভূবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা (২০২০) মতে, গত ৩০ বছরে (১৯৮৮-২০১৮) সমগ্র সুন্দরবনের ২৫% ম্যানগ্রোভ অরণ্যের স্বাস্থ্য নিম্নমুখী।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – সুন্দরবনের মাছ
ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট ২০২১ অনুসারে, ভারতের সুন্দরবনে ঘন ম্যানগ্রোভ আচ্ছাদন (Dense Mangrove Cover) -এর পরিমাণ ৯৯৪ বর্গকিমি। যা ২০১৯ ও ২০১৭ সালে ছিল যথাক্রমে ৯৯৬ ও ৯৯৯ বর্গকিমি। ২০১১ সালে ভারতের সুন্দরবনে ঘন ম্যানগ্রোভ আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১০৩৮ বর্গকিমি। অর্থাৎ এক দশকে (২০১১-২১) ভারতের সুন্দরবনে ঘন ম্যানগ্রোভের পরিমাণ ৪.২৩% হ্রাস পেয়েছে। ২০২০ সালে মে মাসে আম্ফান এবং ২০২১ সালের মে মাসে ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভারতের সুন্দরবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্ব ব্যাঙ্ক (World Bank) -এর সুন্দরবন বিষয়ে এক প্রতিবেদন (২০২০) অনুসারে, ১৯০৪-২৪ সময়কালে সমগ্র সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১,৯০৪ বর্গকিমি। যা ১৯৬৭ ও ২০০১ সালে ১১,৬৬৩ ও ১১,৫০৬ বর্গকিমিতে পৌঁছেছে। এই প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০০ বছরে বাংলাদেশের সুন্দরবন ২৫২ বর্গকিমি হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২.৫ বর্গকিমি।
ভৌগোলিক প্রবন্ধ : প্রসঙ্গ – মেঘেদের পরিচিতি
সময়ের সাথে কেন হ্রাস পাচ্ছে সুন্দরবন? আর কেউ না, মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সুন্দরবনকে ক্রমশ ধ্বংস করে চলেছে। কেটে ফেলা হচ্ছে বিঘের পর বিঘে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সুন্দরবন এলাকায় বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, কাকদ্বীপ, ঝড়খালি প্রভৃতি এলাকায় বাজারে গেলে দেখা যাবে প্রচুর সংখ্যায় বড় বড় গাছের গুঁড়ি বিক্রি হচ্ছে। যা থেকে স্পষ্ট প্রতিদিন সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য হ্রাস পাচ্ছে। অরণ্য উজাড় করে সেই জমিতে মাছের ভেড়ি এবং বেআইনি নির্মাণ কাজ চলছে। গাছ পাচার, কৃষিভূমির সম্প্রসারণ, বসতবাড়ি-রাস্তাঘাট নির্মাণ সহ নানা কারণে অরণ্য উজাড়ের ফলে বন্যপ্রাণীদের বাসস্থল হ্রাস পাচ্ছে। যার কুপ্রভাব পড়ছে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্যে। আমাদের জাতীয় পশু রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার একাধিক উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে। রয়েছে চোরাশিকারের দাপট। সুন্দরবন বসতি এলাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ পড়ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ওপর। এছাড়া রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, যার কারণে ঘনঘন সৃষ্টি হওয়া আয়লা, আম্ফানের মতো শক্তিশালী সাইক্লোন গুলি সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে সমুদ্র জলস্তরের উচ্চতা এবং মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সমগ্র সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ আজ হুমকির মুখে। (Declining Sundarban Over Time)
👉 Special Post : Emerging Geographical Terms
পরিবেশ সংরক্ষণে সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই যেকোনো মূল্যে ম্যানগ্রোভের এই চাদরকে বাঁচাতে হবে। তাই, সুন্দরবনকে রক্ষা করতে গেলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন — (১) সংরক্ষিত অরণ্যে বৃক্ষচ্ছেদন ও গাছ পাচার কঠোরভাবে বন্ধ করা। (২) স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে সরকারি প্রকল্পে ম্যানগ্রোভ রোপণ। (৩) নদীবাঁধগুলি সংরক্ষণ। (৪) পরিবেশ বান্ধব টেকসই নির্মাণ বিধির প্রচলন। (৫) চোরাশিকার ও বন্যপ্রাণী পাচার রোধ করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। (৬) আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চলে স্থিতিশীল উন্নয়ন মডেল রূপায়ণ প্রভৃতি। সঠিক পরিকল্পনা, সৎ প্রচেষ্টা ও সার্বিক উদ্যোগই পারে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে। (Declining Sundarban Over Time)
উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস [XI : Semester-I]
লেখিকাঃ- সরবানী হালদার (ভুষির চক, কুলতলি, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)
তথ্যসূত্রঃ- Wikipedia ; The Times of India ; প্রথম আলো ; Two and Half Century’s Changes of World Largest Mangrove Forest: A Geo-informatics Based Study on Sundarbans Mangrove Forest, Bangladesh, India – Nur Hussain, Rozina Khanam, Ebadullah Khan – Modern Environmental Science and Engineering (ISSN 2333-2581) June 2017 ; Journal of the Indian Society of Coastal Agricultural Research ; The Daily Star ; Mongabay ; Outlook Magazine India ; The Hindu ; Hindustan Times
Pingback: Mayurjharna Elephant Reserve - ভূগোলিকা-Bhugolika
Pingback: Hansuli Bank - Literature & Geography - ভূগোলিকা-Bhugolika